আবু আফজাল সালেহ

  ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

নিম্নমানের ওষুধে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

নকল ওষুধ উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় দেশ বা জোন হলো পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, লাতিন আমেরিকা, পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের অনেকগুলো দেশ, আফ্রিকা এবং ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন। দেখা যায়, বিভিন্ন সময় অভিযান চালানোর পরও বাংলাদেশে নকল ও নিম্নমানের ওষুধের উৎপাদন ও বিপণন অব্যাহত থাকার বিষয়টি উদ্বেগজনক।

বস্তুত একটি চক্র ও অসাধু ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতার কারণেই নকল ও নিম্নমানের ওষুধের উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ হচ্ছে না। মানুষের মৌলিক অধিকারের একটি হচ্ছে চিকিৎসা। আর এ ক্ষেত্রে প্রাণ হচ্ছে ওষুধপত্র। কিন্তু ভেজাল, নিম্নমানের, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে সয়লাব দেশ। আর ভেজাল ওষুধে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে গ্রামের মানুষ। গ্রামের মানুষ সচেতনার অভাবের কারণেই এ দুর্ভোগের শিকার বেশি। এখনই লাগাম টেনে ধরতে না পারলে ভয়াবহভাবে বেড়ে যাওয়া এ প্রবণতা মারাত্মক রূপ ধারণ করবে।

নিম্নমানের ওষুধের কারণে শিল্পের সঙ্গে জনগণও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে যারা মানসম্মত শিল্প-কারখানা করতে বিনিয়োগ করেছেন, তারা ক্ষতির মুখে পড়ছেন। জানা যায়, ওষুধের চাহিদার ৯৮ শতাংশ দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। দেশের চাহিদা পূরণ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্বের উন্নত দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রফতানি হচ্ছে। ভবিষ্যতে ওষুধ খাতের রফতানি আরো বাড়াতে হবে। চিকিৎসাসেবার পরিধি বাড়ার কারণে ওষুধের চাহিদাও বাড়ছে। স্বাধীনতার পর প্রায় দেড় দশক বাংলাদেশ ওষুধ আমদানি করত। কিন্তু বর্তমানে নিজেদের চাহিদা পূরণ করে ১৫১টি দেশে ওষুধ রফতানি করা হচ্ছে। ৯ বছর ধরে সরকারের অব্যাহত সহযোগিতার কারণে ওষুধ খাতে গতি এসেছে। ওষুধ রফতানির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। পত্রিকা সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে বছরে উৎপাদন হয় পঁচিশ হাজারের বেশি ওষুধ।

এর মধ্যে মাত্র চার হাজার ওষুধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ব্যবস্থা বা সামর্থ্য আছে প্রশাসনের। আর এর ২-৩ শতাংশই ভেজাল। আর বাইরের থাকা ওষুধের মান সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। ভয়াবহ চিত্র হচ্ছে, ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল। এই তিন বছরের ব্যবধানে মানহীন ও ভেজাল ওষুধের সংখ্যা বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। এখন এ হার আরও বেশি বলে মনে হয়। বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে মোট উৎপাদিত ওষুধের অন্তত দুই শতাংশ পরিমাণ ভেজাল। নকল ও মানহীন হয়ে থাকে। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। তবে ওষুধ সমিতির নেতারা বলে থাকেন, তাদের সদস্যরা এ অনৈতিক কাজে জড়িত নন। তারা বলে থাকেন, চোরাগুপ্ত পথে ভেজাল ও মানহীন ওষুধ তৈরি হয়।

যেসব ওষুধে চাহিদা বেশি, সেসব ওষুধের নকল বেশি তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের কথা বলা যায়। হারবাল নামে মানহীন ওষুধে ছেয়ে গেছে দেশ। গ্রামে ও অশিক্ষিত/অর্ধশিক্ষিত লোকের কাছে এর চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। এগুলোর বেশির ভাগই ভেজাল। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইচ্ছামতো লেবেল করে মূল্য নির্ধারণ/পরিবর্তন করা হয়। সচেতনতার অভাব ও বিনা প্রেসক্রিপশনে ওষুধ বিক্রি করা এ হারকে বাড়িয়ে তুলছে বলে মনে করি। ভেজাল ওষুধে মালিক, কমিশনখোর কিছু ডাক্তার, জড়িত ফার্মেসি ও বিক্রয় প্রতিনিধিরা লাভবান হচ্ছেন। ফলে ভেজালপ্রবণতা বেড়েই যাচ্ছে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধের ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের বিস্তার রোধ কোনো ক্রমেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। প্রতিরোধের কার্যকর তদারকি ও পদক্ষেপের অভাবে ওষুধ খাতে চলছে ভয়াবহ নৈরাজ্য। যে কারণে দেশের মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়তে চলেছে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি ওষুধের সুনাম ও রফতানির সাফল্যের পরও দেশজুড়ে ওষুধের এই নৈরাজ্য বন্ধ করা যাচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবচেয়ে হতবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে শুধু রোগী নয়, অনেক সময় চিকিৎসকদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, কোনটি ভেজাল ওষুধ। ফলে ওইসব প্রতিষ্ঠানের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ অল্পই রয়েছে। অভিজ্ঞতার অভাবে রোগীরা নির্ভর করছে কমিশননির্ভর ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশনের ওপর। অন্যদিকে অনেক ডাক্তার খেয়ালখুশিমতো ওষুধ কোম্পানিগুলোর চাপিয়ে দেওয়া ওষুধ লিখে দিচ্ছেন। ওষুধ কো¤পানিগুলো দাবি করছে, গণমাধ্যমগুলোতে ওষুধের প্রচারের সুযোগ না থাকায় তারা মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ দিয়ে ওষুধের মার্কেটিং করান।

১৯৮২ সালের ওষুধ নীতিতে ওষুধ বিপণনে প্রচারের আইনের সুযোগ করে তা রোহিত করা হয়। পাশাপাশি আইন লঙ্ঘন করে বিজ্ঞাপন দিলে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এ কারণে কোম্পানিগুলো প্রচার ও প্রসারের জন্য ডাক্তারদের কমিশন বা বিনামূল্যে ওষুধ দিয়ে প্রচার কাজটি করতে চায়। এ অপচয় পুষিয়ে নিতে অনেক সময় নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি করে তাদের মাধ্যমে। অনেক বড় কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি ছোট কোম্পানিগুলোও পাশাপাশি নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রিতে পিছিয়ে নেই। শহরের বাইরে অপেক্ষাকৃত প্রত্যন্ত অঞ্চল, বস্তি ও গার্মেন্ট এলাকার ওষুধের দোকানগুলোতে ছোট কোম্পানিগুলোর ওষুধ বেশি বিক্রি হয়। ওষুধ সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা না থাকায় সুযোগ নেন হাতুড়ে ডাক্তার ও ওষুধের দোকানদাররা।

পরিসংখ্যান মোতাবেক বিশ্বের ১৫ শতাংশ ওষুধ নকল। এশিয়া ও আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে নকল ওষুধের পরিমাণ ৫০ শতাংশ। অ্যাঙ্গোলায় নকল ওষুধের পরিমাণ মোট ওষুধের ৭০ শতাংশ। ২০০৫ সালে ওইসিডি (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের) হিসাব মতে, সারা বিশ্বে নকল ওষুধের বিক্রীত অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার। নকল ওষুধ উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলো হলো পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, লাতিন আমেরিকা, পূর্ব মধ্য ইউরোপের অনেক দেশ, আফ্রিকা এবং ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন।

এসব দেশে বেশি নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদিত হয় যেসব দেশে ওষুধশিল্পে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত শিথিল এবং আইনগত বাধ্যবাধকতার অভাব রয়েছে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার ও নীতিনির্ধারকদের দুর্নীতির কারণে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ ও পণ্যের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, নিউজিল্যান্ড, পশ্চিম ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোয় নকল, ভেজাল নি¤œমানের ওষুধের পরিমাণ ১ শতাংশেরও কম। কারণ এসব দেশে ওষুধ এবং ওষুধশিল্পের ওপর সরকারের কঠোর আইন ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত আছে।

চীনে ওষুধ ও খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল এবং নকলের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করার বিধান আছে। নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করে কার্যকারিতা না পেয়ে চিকিৎসক বা রোগী একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক পরিবর্তন করতে থাকে। এভাবে নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে জীবাণু ওষুধের কার্যকারিতাকে নিষ্ফল করে দিয়ে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে শরীরে বহাল তবিয়তে টিকে থাকতে পারে। অন্যদিকে বেশি পরিমাণে সক্রিয় উপাদান থাকলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, বিষক্রিয়ায় রোগীর অবস্থার অবনতি হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে রোগী মারাও যেতে পারে। আসল ওষুধের নামে ও অবয়বে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রতারণামূলকভাবে নকল উপকরণ দিয়ে, না দিয়ে বা ভেজাল দিয়ে উৎপাদিত ওষুধকে নকল ওষুধ বলে। ব্র্যান্ড ওষুধের মতো জেনেরিক ওষুধও নকল হয়। অনেক ওষুধে ঠিক উপকরণটি ব্যবহার করা হলেও তা পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে না। এসব ওষুধকে নি¤œমানের ওষুধ বলা হয়।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ চতুর্থ অধ্যায়ের (অপরাধ, দণ্ড, ইত্যাদি) ধারা ৪১ (ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রয়ের দণ্ড) অনুসারে- ‘কোনো ব্যক্তি জ্ঞাতসারে ভেজালমিশ্রিত পণ্য বা ওষুধ বিক্রয় করিলে বা করিতে প্রস্তাব করিলে তিনি অনূর্ধ্ব তিন বৎসর কারাদ-, বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ ভেজালমুক্ত ও মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকার সব সময় কঠোর অবস্থানে রয়েছে। ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ সরবরাহ ও বিক্রির সঙ্গে জড়িতরা কোনোভাবেই রোগী মৃত্যুর দায় এড়াতে পারে না। জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মান নিয়ে কোনো আপস করা যাবে না। আইনের প্রয়োগে আরো কঠোর হতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত আরো বাড়াতে হবে।

আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশে তৈরি ওষুধের চাহিদা বাড়ছে। দেশে নকল ও নিম্নমানের ওষুধের উৎপাদন ও বিপণন পুরোপুরি বন্ধ না হলে ওষুধের আন্তর্জাতিক বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এতে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ। কতিপয় মালিক লাভবান হলেও পিছিয়ে পড়বে দেশ। সরকার চেষ্টা করছে। আরো কঠোর মনোভাব দেখাতে হবে। আদালতও মাঝেমধ্যে এ ব্যাপারে ইতিবাচক নির্দেশনা দিচ্ছেন। বাস্তবায়ন আমাদেরই করতে হবে এবং তা শক্ত হাতেই। ব্যর্থ হলে পরবর্তী প্রজন্ম পিছিয়ে থাকবে। প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বাড়বে, মেধা হ্রাস হতে থাকবে শিশু-তরুণদের। ফলে পিছিয়ে পড়বে দেশ।

ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের সমস্যা অত্যন্ত গুরুত্ববহ। কারণ এটি মানব স্বাস্থ্যঝুঁকির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের প্রভাব মাদক, ম্যালেরিয়া, এইডস বা অস্ত্রের সহিংসতার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধে প্রয়োজনমতো উপাদান না থাকায় তা রোগ সারাতে ব্যর্থ হয় এবং রোগের তীব্রতা বাড়তে থাকে। ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ সেবনে রোগীর শরীরে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হতে পারে, যার মধ্যে কিডনি বিকল হওয়া, দৃষ্টিশক্তি হারানো, ফুসফুসের অসমর্থতা এবং মৃত্যু উল্লেখযোগ্য। আর এসব রুগী বৃদ্ধি পাচ্ছে দেশে! ভেজাল খাদ্যের পাশাপাশি ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ সেবন বড় একটি কারণ বলে প্রমাণিত সত্য বলে ধরা হয়। তাই জনস্বাস্থ্যের বিশাল হুমকি ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের বিরুদ্ধে সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

Email : [email protected]

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ওষুধ,নিম্নমানের ওষুধ,স্বাস্থ্যঝুঁকি,নকল ওষুধ উৎপাদন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close