এস এম মুকুল

  ০৫ জুন, ২০১৭

গবেষণা

গড় আয়ু এবং দীর্ঘায়ু

সুন্দর এই পৃথিবী আর মায়াময় জীবন-সংসার ছেড়ে কেউ কি চলে যেতে চায়? হাজারো বিষাদ, অতৃপ্তি আর ব্যর্থতার যাতনায় কখনো কখনো জীবন বিষিয়ে উঠলেও এ মানবজীবন সত্যিই আমাদের পরম প্রিয়। বিধাতার সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে এ ধরায় জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেতে কত না নিরন্তর প্রচেষ্টা আমাদের। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত এ মানবজাতি চাঁদে কিংবা মঙ্গলেও বসতি গড়ার কথা ভাবে। মানুষ কেন মরে যায় অথবা মানুষ কিভাবেই বা বেঁচে থাকে-এসব নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণার অন্ত নেই। মানুষের জীবন আর দীর্ঘকাল বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা তথ্য বিশ্লেষণে আজকের কলাম-গড় আয়ু এবং দীর্ঘায়ু।

আনন্দের খবর, আরেক ধাপ বেড়ে বতর্মানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু হয়েছে ৭১ বছর ৬ মাস। ২০১৬ সালে ছিল ৭০ বছর ৯ মাস। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে পুরুষের গড় আয়ু ৭০ বছর ৩ মাস এবং নারীদের ৭২ বছর ৯ মাস। ২০১১ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৬৯ বছর। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি বৈশ্বিক গড়ের দ্বিগুণ। কারণ দেশের মানুষের গড় আয়ু গত ৪৫ বছরে বেড়েছে ২৪ বছর। একই সময়ে বিশ্বে গড় আয়ু বেড়েছে মাত্র ১২ বছর। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ১৯৭১ সালে দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছর, যা ২০১৬ সালে ৭১ বছরে উন্নীত হয়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অভিমত, শিশুমৃত্যু হ্রাস পাওয়া এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের দেরিতে মৃত্যু গড় আয়ু বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। তবে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে খবরটি আশাব্যঞ্জক হলেও ঝুঁকির মুখে পড়বে বয়স্ক নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা। কারণ দেশে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষের বয়স এখন ৬০-এর বেশি। ২০৫০ সালে এই হার ২০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ালে সহজাত প্রশ্ন দেখা দেবে, বয়স্ক মানুষের এই চাপ অর্থনীতি টানতে পারবে কি না। মানুষের গড় আয়ু বাড়তে থাকায় বাংলাদেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা। দেশের অর্থনীতিসহ প্রায় সব সামাজিক ক্ষেত্রেই এর প্রভাব পড়বে। আশঙ্কা হয়, তখন কি বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা অনেক অনেক বেড়ে যাবে! আশার খবর হলো বয়স্ক জনগোষ্ঠী যাতে জাতীয় অর্থনীতির জন্য বোঝাস্বরূপ না হয় সেজন্য সরকার বয়স্কদের ব্যাপারে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে পিতা-মাতার ভরণ-পোষণে সন্তানদের বাধ্যকরণ, সরকারি বেতন স্কেলে পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের খরচ, কেউ এই দায়িত্ব পালন না করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া প্রভৃতি।

ত্রিশ লাখেরও বেশি মানুষের ওপর পারস্পেকটিভ অন সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স নামে এক গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, যারা নিঃসঙ্গ থাকেন তাদের মধ্যে ২৬ শতাংশ বেশি মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। যারা একা বাস করেন তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি যারা কারো সঙ্গে থাকেন তাদের তুলনায় ৩২ শতাংশ বেশি। তাই গবেষকের পরামর্শ, বন্ধু ও পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে থাকা এবং তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা দীর্ঘজীবন লাভের সহায়ক। অস্ট্রেলিয়ায় এক দশক ধরে একদল গবেষক কিছু বয়স্ক মানুষের ওপর গবেষণা চালিয়ে মানুষের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধিতে বন্ধুত্বের উপকারিতা প্রমাণিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা কম বয়সে এবং বেশি বয়সে বন্ধুদের কাছে পেয়েছেন তারা অন্যদের তুলনায় বেশ কিছু বছর বেশি বাঁচেন। সুইডেনে এমন একটি জরিপে জানা গেছে, যারা সারা জীবন বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করে জীবন কাটিয়েছেন তাদের মস্তিষ্ক অন্যদের তুলনায় বেশি ভালো থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা ‘নেচার’ জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধে জানিয়েছেন, দীর্ঘায়ুর নিশ্চয়তা তিন খাবারে- অলিভ অয়েল, বাদাম ও অ্যাভাকোডা। খাদ্য তিনটির মধ্যে স্বাস্থ্যকর মনো-আল্ট্রাস্যাচুরেটেড ফ্যাট নামে স্নেহজাতীয় পদার্থ রয়েছে প্রচুর, যা মানুষের আয়ু বাড়ানোয় কার্যকর। নিবন্ধে গবেষকরা দাবি করেন, জীবন দীর্ঘায়িত করে তোলায় কার্যকর ম্যাজিক পানীয়টি আমাদের অনেকের ঘরেই রয়েছে, আর তা হলো অলিভ অয়েল। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিনের গবেষকদের ধারণা, দক্ষিণ ইউরোপভুক্ত দেশগুলোর বাসিন্দাদের দীর্ঘায়ু হওয়ার রহস্য অনেকটাই পরিষ্কার, কারণ এসব দেশের বাসিন্দাদের খাদ্যতালিকার নিয়মিত অনুষঙ্গ হচ্ছে অলিভ অয়েল।

বেঁচে থাকা বা আয়ুষ্কাল নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা পর্যালোচনা মানুষের মাঝে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। ‘দ্য ল্যানসেট’ নামে একটি ইংরেজি স্বাস্থ্য পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এইডস এবং ম্যালেরিয়ার মতো সংক্রামক মরণব্যাধিগুলো মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তারই সুফলই পাচ্ছে মানুষ। গবেষণায় বলা হয়, পৃথিবীর ১৮৮টি দেশের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে ১৯৯০ সালের পর থেকে পৃথিবীর মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৬ বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষণায় আরো দেখানো হয়েছে, আফ্রিকার দক্ষিণে অবস্থিত লেসোথো নামক দেশের প্রত্যাশিত গড় আয়ু মাত্র ৪২ বছর আর সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশিত গড় আয়ু জাপানে- ৮৩ বছর। জাপানের মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে থাকে গড়ে ৭৩ বছর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যানে জাপানের নারীরা (৮৬ বছর) এবং সুইজারল্যান্ডের পুরুষরা (৮১ বছর) সবচেয়ে বেশি আয়ুষ্কালের অধিকারী। ১৭৪টি দেশের স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, নারীরা এখনো পুরুষদের চেয়ে গড়ে সাড়ে চার বছর করে বেশি আয়ুর অধিকারী। মজার ব্যাপার হচ্ছে, রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা মানুষের বুড়ো হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া বিলম্বিত করতে পারে, এমন এক পদ্ধতির খোঁজ পেয়েছেন। মানুষের আয়ু ১২০ বছর পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব বলে আশা করছেন রুশ বিজ্ঞানীরা। ইঁদুর, মাছ এবং কুকুরের ওপর এরই মধ্যে নতুন এ প্রক্রিয়ার পরীক্ষা চালানো হয়েছে।

অবাক করা খবরটি হলো, ডেথ অ্যাসোসিয়েটেড প্রোটিন বা ডিএপি জিন নামে ‘আয়ুষ্মান’ জিনের সন্ধান পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা। গবেষণাগারে প্রমাণিত হয়েছে, এটি কোষের মধ্যে উৎপাদনশীল হরমোন আইজিএফআইর পরিমাণ অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়। ফলে কোষগুলো সবল থাকে, প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট তৈরি করে। আর এভাবে পুরনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো নতুন জীবন পায়। বিজ্ঞানীরা বলেন, প্রত্যেকটি প্রাণীর ক্ষেত্রে তাদের শরীরের কোষগুলো কতদিন বাঁচবে, তা নির্ভর করে কোষের মধ্যে থাকা একটা আশ্চর্য ‘জৈবিক ঘড়ি’ বা ‘বায়োলজিক্যাল ক্লক’-এর ওপর। এ ঘড়ির চলা শেষ হলেই কোষগুলোর মৃত্যু হয়। গত কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞানীরা কোষের ভেতরকার সেই জিনকে চেনার চেষ্টা করছেন, যা মানুষের আয়ু অনেক বাড়াতে পারে। তবে বিজ্ঞানীরা এও বলছেন যে, মানুষের আয়ুর ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পরিবারের গড় আয়ুর ওপরই নির্ভর করে। নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং মানসিক চাপ, ধূমপান ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকা আয়ু বাড়াতে ভূমিকা রাখে।

মানুষের মৃত্যুরহস্য আর বেঁচে থাকার দুই বিপরীত কেন্দ্রে গবেষকদের অক্লান্ত সাধনা হয়তো চলবে পৃথিবীর শেষ অবধি। মার্কিন গবেষকরা দাবি করছেন, দৈহিক গড়নে কিছুটা ছোট, অর্থাৎ বেঁটে মানুষ সমবয়সী লম্বা মানুষের চেয়ে বেশি দিন বাঁচে। গবেষকরা ৫ ফুট ২ ইঞ্চি থেকে খাটোদের এক দলে এবং ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি থেকে ৬ ফুট লম্বাদের আরেক দলে ভাগ করে পর্যবেক্ষণে রাখেন। প্লস ওয়ান সাময়িকীতে প্রকাশিত নিবন্ধে এ বিষয়ে গবেষকরা জানান, বেঁটে মানুষের দেহে রয়েছে দীর্ঘায়ুর জিন ফক্স জিরো থ্রি। এ জিনটি কৈশোরেই মানুষকে লম্বা হতে বাধা দেয় এবং একই সঙ্গে আয়ুকে দীর্ঘ করে। তাছাড়া বেঁটে মানুষদের রক্তের ইনসুলিন লেভেলও কম থাকে এবং ক্যানসারের মতো রোগও কম হয়। সব মিলিয়ে বেঁটে মানুষ বাঁচে দীর্ঘদিন। এমন খবর শুনে বেঁটেরা হয়তো খুশিতে আটখানা হবেন। তবে বলা যায় না, তার বিপরীত খবরও নতুন কোনো গবেষণায় চলে আসতে পারে। স্টামফোর্ড স্কুল অব মেডিসিন থেকে একটি সমীক্ষার ফলাফলে বলা হয়েছে, যারা জগিং করেন তারা দীর্ঘদিন বাঁচেন। জগিংকারীদের মধ্যে হৃদরোগ ও স্নায়ুজ রোগ, সংক্রমণ ও ক্যানসারজনিত মৃত্যু কম ঘটে। তবে তার চেয়ে চমৎকৃত হওয়ার মতো খবরটি হচ্ছে- বিজ্ঞানীদের গবেষণা মতে, মানুষ যদি তার লক্ষ্য ঠিক করতে পারে তাহলে সে আরো কয়েক বছর বেশি বাঁচবে সুন্দর এ পৃথিবীতে। এক গবেষণায় জানা গেছে, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যহীন মানুষের তুলনায় জীবনে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য রয়েছে এমন মানুষ দীর্ঘায়ু হন। গবেষণা দলের প্রধান কানাডার কার্লেটন ইউনিভার্সিটির ডক্টর প্যাট্রিক হিল বলেন, জীবনে নির্দেশনা খুঁজে পাওয়া ও আকর্ষণীয় উদ্দেশ্য নির্ধারণ করার মাধ্যমে যেকোনো বয়সেই লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে জীবন আয়ুতে যোগ করে নেওয়া সম্ভব আরো কয়েকটি বছর।

আপনি মানুন অথবা না মানুন, দীর্ঘায়ু হতে চাইলে থাকুন পরিবারের সঙ্গে। ওয়াশিংটনে আমেরিকান সোসিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (এএসএস) গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বৃদ্ধ বয়সে যারা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধন রাখেন এবং বন্ধু পরিবেষ্টিত থাকেন তার দীর্ঘায়ু হন। যাদের নেটওয়ার্কে এমনকি ঘনিষ্ঠতা ছাড়াই পারিবারিক সদস্যের সংখ্যা বেশি তাদের অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি কম। গবেষণায় বলা হয়েছে, আবেগগত বন্ধন ছাড়া সাধারণ সামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমেও দীর্ঘায়ু হওয়ার মতো উপকারিতা লাভ করা যায়। পারিবারিক সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং বেশি সংখ্যক আত্মীয়-স্বজনকে আস্থাভাজন হিসেবে পেলে মৃত্যুর ঝুঁকি কমে আসে। পিতৃত্ব এবং মাতৃত্বের সঙ্গে মানুষের বেশি দিন বেঁচে থাকার সম্পর্ক নিয়ে জার্নাল অব এপিডেমিওলজি অ্যান্ড কমিউনিটি হেলথে সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়, সন্তান থাকলে আয়ু বাড়ে মা-বাবার। ১৪ লাখ বয়স্ক নারী-পুরুষের জাতীয় নিবন্ধন তথ্য থেকে তাদের বয়সসীমা, বৈবাহিক অবস্থা এবং সন্তান আছে কি না বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্ত সামনে তুলে এনেছেন গবেষক দল। এবার নিজেই ভেবে দেখুন দীর্ঘায়ু লাভের কত রকমের গবেষণা সূত্র রয়েছে আপনার চারপাশে। নিজেই বেছে নিন এবং দীর্ঘজীবী হোন।

লেখক : উন্নয়ন গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

পিডিএসও/মুস্তাফিজ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist