মো. কায়ছার আলী

  ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

ভালোবাসা এবং ভালোবাসা

প্রেমের সার্থকতা বা পরিপূর্ণতা বিরহে (ত্যাগে), না মিলনে (প্রাপ্তিতে)। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘ভালোবাসা বিবাহের সূর্যোদয়, কিন্তু বিবাহ ভালোবাসার সূর্যাস্ত।’ এর শেষ উত্তর বা সমাধান জটিল। অতীত থেকে আজ পর্যন্ত বা ভবিষ্যতেও লেখা, গান, সাহিত্য, নাটক, কাব্যে এর পক্ষে বা বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। অদেখা বা অচেনা এই ভাইরাসটিকে নিয়ে পারস্যের কবি হাফিজ তার কবিতায় তার প্রিয়ার গালের একটি তিলের অপরূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা করেছেন। তৈমুরের রাজধানী ছিল সমরখন্দ (জ্ঞানী, বিজ্ঞানী, কবি, চিত্রশিল্পী, লেখক আর স্থাপত্যশিল্পীদের মিলনকেন্দ্র)। পাশেই ছিল জ্ঞানের আরেক পীঠস্থান বোখারা শহর। কবি হাফিজ আবেগময় কবিতায় প্রিয়ার গালের একটি তিলের জন্য বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন এই দুই বিখ্যাত শহর। লোকের মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে কথাটি গেল তৈমুরের কাছে।

তৈমুর কবিকে ডেকে বললেন, ‘এই দুই শহরকে আমার জয় করতে অনেক ক্ষয়ক্ষতি, অপরিমেয় সোনা-দানা খরচ হয়েছে। আর তুমি কি না আমার রাজ্য দুটোকে তুচ্ছ মনে করলে।’ পরে মৌখিক ভয় দেখিয়ে বললেন, ‘এত বড় সাহস তোমার হলো কেমন করে?’ আসলে তার কবিতায় অভিভূত হয়েছিলেন তৈমুর। তিনি খতিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন তার প্রতিভা। কবি বললেন, ‘আমি তো এক সামান্য কবি, দিনে ভিক্ষা করে তনু রক্ষা করি। ফকিরের কি আসে-যায় মুখের কথায়। সারাটি দুনিয়া বিলিয়ে দেওয়া কি আমার পক্ষে সম্ভব? আমার মতো একজন সামান্য লোক বিশ্বজয়ী রাজার কষ্ট কেমন করে বুঝবে? রাজ্যের দামইবা কেমন করে পরীক্ষা করবে সর্বহারা এক ফকির। তাই আবেগতাড়িত হয়ে বিলাতে চেয়েছিলাম আমি আপনার প্রিয় দুই শহর।’ আরো বললেন, ‘হে মান্যবর, আবেগ তো আবেগই।’ কবি হাফিজের বাকচাতুর্যে খুশি হলেন তৈমুর। বিদায়ের সময় একতোড়া স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে পুরস্কৃত করলেন কবিকে আর হেসে হেসে বললেন, ‘অত বড় দরাজ দিল আর হয়ো না কবি। তাহলে তো গোটা সাম্রাজ্যই আমার পানির দামে বিক্রি হয়ে যাবে।’

কবি হাফিজ এবং তৈমুর কেউই বেঁচে নেই। কিন্তু তাদের কাহিনিটি আজও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। পৃথিবীর মানুষরা তাদের ভালোবাসার প্রিয় মানুষটিকে আকাশ, চাঁদ, সমুদ্র, সূর্য, পর্বত, হীরা, সোনা আর মূল্যবান সম্পদ বা সৌন্দর্যের সঙ্গে উপমা দিয়ে বর্ণনা দেন। গতকাল চলে গেল ১৪ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’। পৃথিবীতে এর চেয়ে জনপ্রিয় দিবস আর নেই। বিশ্বে এটি ভ্যালেনটাইনস ডে নামে সর্বাধিক পরিচিত। প্রাচীন রোমে বিয়েকে ঈশ্বরের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হতো। রোমের কুমারী রমণীরা কাগজে ভালোবাসার কাব্যকথা লিখে মাটির হাঁড়িতে জমা করতেন। যুবকরা হাঁড়ি হতে তুলে নিতেন কাগজের টুকরা। যুবকের হাতে যে রমণীর লেখা উঠত, সে রমণীই হতো ওই যুবকের স্ত্রী। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিয়ের এ দৈবচয়ন অনুষ্ঠিত হতো। তাই বহুকাল হতে ১৪ ফেব্রুয়ারি অনানুষ্ঠানিক ভালোবাসা দিবস পালিত হয়ে আসছিল। খ্রিস্টান চার্চের প্রাথমিক যুগে দুজন খ্যাতিমান সেন্ট ছিলেন। রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস মনে করলেন, অবিবাহিত যুবকদের মাধ্যমে সর্বোত্তম সেনাবাহিনী গঠন করা যায়। তিনি ২০০ খ্রিস্টাব্দে রাজকীয় ফরমানের মাধ্যমে সাম্রাজ্যের যুবকদের বিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেন। এ অপরাধে সম্রাট এই দিনে যাজক ভ্যালেনটাইনের শিরশ্ছেদ করেন এবং তার বিবাহিতা স্ত্রীকে জোর করে বিয়ে করে ফেলেন। একই দিন অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারি যুবতী আত্মহত্যা করেন। ঘটনাটি এত করুণ ও হৃদয়বিদারক ছিল যে, রোম সাম্রাজ্যের সকলের মনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তবে সেকালে এ নিয়ে আন্দোলন করার মতো কোনো সুযোগ ছিল না। কথিত হয়, ভ্যালেনটাইন দম্পতির ভালোবাসা ও ত্যাগের স্মরণার্থে এই দিনে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালন করা হয়।

অন্য প্রবাদ মতে, ভ্যালেনটাইন ছিলেন খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের প্রাথমিক যুগে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণকারী একজন ধার্মিক। শিশুদের প্রতি ছিল তার অনুপম ভালোবাসা ও গভীর মমতা। তৎকালীন রোম সাম্রাজ্যের প্রচলিত ধর্মীয় দেবতাদের পুজো করতে অস্বীকার করায় তাকে কারাগারে একটি প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রাখা হয়। হাজার হাজার শিশু ও ভক্ত সেলের জানালা দিয়ে ভ্যালেনটাইনের প্রতি ফুলের তোড়া নিক্ষেপ করেন। কথিত হয়, ভালোবাসার ছোঁয়ায় ভ্যালেনটাইন জেলারের অন্ধ কন্যার দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি তাকে হত্যা করা হয়। পরবর্তীকালে ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ জেলির্সিয়াস ভ্যালেনটাইনের হত্যার দিনটিকে ভ্যালেনটাইন দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের প্রথমার্ধ হতে ইংল্যান্ডে ভ্যালেনটাইন ডে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, জনৈক ফ্রেন্সম্যান অরল্যান্সের ডিউক চার্লস ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দে এপিনকোর্টর যুদ্ধে ইংরেজদের নিকট পরাজিত ও ধৃত হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। ভ্যালেনটাইন দিবসে তিনি কারাগারে তার সেল হতে তার স্ত্রী-পুত্রদের উদ্দেশ গভীর ভালোবাসায় পূর্ণ একটি কবিতা লিখে লন্ডন টাওয়ারে প্রেরণ করেন। সে হতে ইংল্যান্ডে ভ্যালেনটাইন ডে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

ষোড়শ শতক হতে আধুনিক ভ্যালেনটাইন দিবসের যাত্রা হয়। আশি এবং নব্বইয়ের দশকে এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘যায়যায়দিন’-এর মাধ্যমে এবং বর্তমানে মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির (ফেসবুক) দ্বারা এই দিবসের অবাধ বিস্তার ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের এক সখী আরেক সখীকে জিজ্ঞেস করছে, সখী ভালোবাসা কারে কয়? দিবস রজনী সবাই ভালোবাসার কথা বলে, কিন্তু সেটা কী? পৃথিবীতে এর চেয়ে আর কোনো গভীর ক্রন্দন আছে কি না, জানি না। বৃদ্ধ সম্রাট শাহজাহান জীবনের শেষ আট বছর ছেলে আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দি অবস্থায় কাটান। শুধু একটি দয়া তিনি পিতাকে করেছিলেন। যে আগ্রা দুর্গে পিতাকে বন্দি রেখেছিলেন, সেখানে একটা গবাক্ষ রাখলেন, যেখান থেকে যমুনা নদীর পাড়ে শুভ্র সমুজ্জ্বল তাজমহলকে দেখা যেত, যার পাষাণ বেদির তলায় চিরশায়িত ছিলেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ জাহান।

নজরুল লিখেছেন, ‘যমুনার তীরে শাহজাহান স্বপ্ন শতদল/তাজমহল।’ ইংল্যান্ডের দুর্ধর্ষ রাজা চন্ড স্বভাবের অষ্টম হেনরি প্রেমে পড়লেন অ্যান বলিন নামের এক প্রটেস্ট্যান্ট রমণীর। রমণীর মন গলাতে তিনি ঘোড় সওয়ারের দ্বারা দীর্ঘ দীর্ঘ প্রেমপত্র পাঠাতে লাগলেন। ওই চিঠিগুলো রমণীর মন গলাল, কিন্তু বাদ সাধলেন রোম থেকে পোপ। ইংল্যান্ড তখনো ক্যাথলিক রাজ্য। রোমের পোপ হচ্ছে এর ধর্মীয় গুরু। কিন্তু রাজা হেনরি পোপের কথা শুনবেন কেন? ইংল্যান্ডকে তিনি প্রটেস্ট্যান্ট দেশ করলেন। বললেন, ইংল্যান্ড একটি স্বাধীন দেশ, কাজেই এর চার্চও স্বাধীন। আসল কারণ প্রটেস্ট্যান্ট রমণী অ্যান বলিনকে তিনি বিয়ে করবেনই। বিয়ের কারণে রাষ্ট্রের ধর্ম বদল হয়ে গেল। সহসা অ্যান এলিজাবেথের জন্ম দিলেন। এলিজাবেথ পরে ১৫৫৮ সালে ইংল্যান্ডের রানি হন, কিন্তু তার বহু আগেই তার পিতা রাজা হেনরি তার মাকে দুশ্চরিত্র রমণী অভিধা দিয়ে গিলোটিনে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এককালের প্রেমিকা এবং পরে রানি অ্যান বলিন তার স্বামীর কাছে ব্যভিচারিণী আখ্যা পেয়ে নিহত হলেন। ভালোবাসার সঙ্গা এখানেই। আর এখানেই ভালোবাসার বিস্ময়।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ভালোবাসা,ভ্যালেনটাইনস ডে,ভালোবাসা দিবস
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist