জুবায়ের চৌধুরী

  ২৭ নভেম্বর, ২০১৯

হলি আর্টিজান হামলার রায়

সবার চোখ আজ আদালতে

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৬ সালের ১ জুলাই। মূলত এই ঘটনার মধ্য দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব ও সক্ষমতার জানান দেয় নব্য জেএমবি। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় সেই হামলায় ১৭ জন বিদেশি নাগরিক ও দুজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ নিহত হন ২২ জন। কয়েক ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস কমান্ডো অভিযানে মারা যায় পাঁচ হামলাকারীও। জীবিত উদ্ধার হয় বেশ কয়েকজন জিম্মি। ঘটনার পর মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটকে। প্রায় ৩ বছর তদন্ত শেষে ২১ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়ার তথ্য জানায় সংস্থাটি। তবে হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরী, মারজানসহ ১৩ জন বিভিন্ন সময় অভিযানে মারা গেলে ৮ জনকে আসামি করে চার্জশিট দেওয়া হয়। নানা ধাপ পেরিয়ে আজ বুধবার ঘোষিত হতে যাচ্ছে আলোচিত সেই মামলার রায়।

এদিকে ভয়াবহ সেই হামলার পর টানা ২ বছর দেশব্যাপী জঙ্গিবিরোধী ১৮টি বড় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় বেশ কয়েকটি জঙ্গি আস্তানা। গ্রেফতার করা হয় সহস্রাধিক জঙ্গি। এসব অভিযানে গুলশান হামলা মামলার চার্জশিটভুক্ত ১৩ আসামিসহ নিহত হয় ৭৯ জঙ্গি। দেশজুড়ে আলোচিত এই জঙ্গি হামলা মামলার রায় জানতে দেশের আপামর মানুষের চোখ আজ আদালতে। রায়কে ঘিরে পুরান ঢাকার আদালত চত্বরে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

৫২ কার্যদিবসের কার্যক্রম শেষে গত ১৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান রায়ের জন্য আজকের তারিখ নির্ধারণ করেন। রায়ে মামলার কারাবন্দি আট আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গোলাম সরোয়ার খান জাকির। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন আদালতের কাছে আসামিদের ন্যায়বিচার আশা করেন। এদিকে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার পর সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে দেশে জঙ্গি হামলা কমেছে। তবে বেড়েছে উগ্রবাদী মনোভাবাপন্ন মানুষের সংখ্যা। জঙ্গি সংগঠনে নেতৃত্ব সংকট থাকায় উগ্রবাদীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়াতে পারছে না। তবে তারা বিভিন্নভাবে তৎপর রয়েছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এদের ডিরেডিক্যালাইজড করতে সরকার নানা ধরনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

আদালতে বিচার কাজের পর্যায়ক্রম : ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ মামলার বাদী এসআই রিপন কুমার দাসের সাক্ষ্য নেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া। প্রায় এক বছর পর গত ২৭ অক্টোবর মামলাটিতে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। এরপর গত ৩০ অক্টোবর আত্মপক্ষ শুনানিতে আট আসামি নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। ৬ নভেম্বর মামলার রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক শুরু হয়ে ১৭ নভেম্বর শেষ করে রায়ের জন্য তারিখ নির্ধারণ করেন বিচারক। মামলাটিতে চার্জশিটভুক্ত ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্য নেয় ট্রাইব্যুনাল। মামলার আট আসামির মধ্যে ছয়জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বাড়ির মালিক ও কেয়ারটেকাররা আসামিদের শনাক্ত করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

এর আগে ২০১৮ সালের ১ জুলাই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের পরিদর্শক হুমায়ূন কবির ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিম (সিএমএম) আদালতে মামলার চার্জশিট দাখিল করেন। এরপর ২৬ জুলাই সিএমএম আদালত মামলাটি ট্রাইব্যুনালে বদলির আদেশ দেন। চার্জশিটে ২১ জন আসামির নাম থাকলেও তাদের মধ্যে ১৩ জন বিভিন্ন সময় জঙ্গিবিরোধী অভিযানে মারা যাওয়ায় তাদের অব্যাহতি দিয়ে অভিযুক্ত করা হয় আটজনকে।

মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী নব্য জেএমবি নেতা হাদিসুর রহমান সাগর, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরীর সহযোগী আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররা ওরফে র‌্যাশ, নব্য জেএমবির অস্ত্র ও বিস্ফোরক শাখার প্রধান মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী, হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আবদুস সবুর খান (হাসান) ওরফে সোহেল মাহফুজ, মামুনুর রশিদ ও শরিফুল ইসলাম। সব আসামিই কারাগারে রয়েছে। এদিকে, মামলাটির চার্জশিট দাখিলের সময় এ ঘটনায় আলোচিত ব্যক্তি, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিমকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, তার বিরুদ্ধে এই হামলায় জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

রায়ে আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের প্রত্যাশা : মামলার আট আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গোলাম সরোয়ার খান জাকির। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন আদালতের কাছে আসামিদের ন্যায়বিচার আশা করেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গোলাম সরোয়ার খান জাকির বলেন, ‘বহুল আলোচিত এ মামলা রাষ্ট্রপক্ষ সম্পূর্ণভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। মামলায় ছয় আসামি আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আশা করছি, সব আসামির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত হবে।’ অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আসামিদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ রয়েছে তা রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি। সাক্ষীদের জেরা ও আসামিদের ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারার জবানবন্দি পর্যালোচনায় করলে দেখা যায় আসামিরা নির্দোষ। আশা করছি, তারা ন্যায়বিচার পাবে।’

কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে যাদের যে ভূমিকা ছিল, সেগুলো আমরা চার্জশিটে উল্লেখ করেছি। আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণের মাধ্যমে আদালতে প্রেরণ করেছি। আশা করছি, একটা ভালো রায় পাব। এই প্রেক্ষাপটে জঙ্গিবাদ নিয়ে ভাবেন এমন ব্যক্তিরা বলেন, দীর্ঘ মেয়াদে এটি নির্মূল করতে গেলে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা।

আদালত চত্বরে নিরাপত্তা জোরদার : বহুল আলোচিত গুলশানের হলি আর্টিজান হামলা মামলার রায় ঘোষণাকে ঘিরে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত চত্বরে বিশেষ নিরাপত্তা জোরদারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ডিএমপির অপরাধ তথ্য প্রসিকিউশনের উপকমিশনার জাফর হোসেন জানান, মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার দিকে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত চত্বর ঘুরে দেখেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় ও মীর রেজাউল আলম। তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তাসংক্রান্ত নানা দিকনির্দেশনা দেন।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁটি দখলে নেয় জঙ্গিরা। তাদের সশস্ত্র হামলায় রেস্টুরেন্টে খেতে আসা ইতালির ৯ জন, জাপানের সাতজন, ভারতীয় একজন ও বাংলাদেশি তিন নাগরিকসহ রেস্তোরাঁর কর্মচারীদের মধ্যে দুজন প্রাণ হারান। অভিযানের সময় জঙ্গিদের ছোড়া গ্রেনেডের আঘাতে রেস্তোরাঁর বাইরে মারা যান গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার রবিউল করিম ও বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন খান। ঘটনাস্থলে তাণ্ডব চালানোর পর রাতভর রেস্তোরাঁয় আসা বাকি অতিথি ও রেস্তোরাঁর কর্মচারীদের জিম্মি করে রাখে জঙ্গিরা। পরদিন সকালে সেনাবাহিনী পরিচালিত অপারেশন থান্ডার বোল্ট অভিযানের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে। হামলার সাত দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো একজনের মৃত্যু হয়। পাঁচ জঙ্গিসহ শেফ সাইফুল ইসলাম ও সহকারী শেফ শাওনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে দীর্ঘদিন পরে থাকার পর বেওয়ারিশ ঘোষণা করে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।

এদিকে পুলিশের চার্জশিটে ২১ জনের মধ্যে ১৩ জন মারা যাওয়ায় তাদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। নিহত ১৩ জনের মধ্যে ৮ জন বিভিন্ন অভিযানে এবং পাঁচজন ঘটনাস্থলে নিহত হয়। চার্জশিটের আট আসামি হলো হামলার মূল সমন্বয়ক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরীর সহযোগী আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররা, অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী নব্য জেএমবি নেতা হাদিসুর রহমান সাগর, নব্য জেএমবির অস্ত্র ও বিস্ফোরক শাখার প্রধান মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী, হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আবদুস সবুর খান (হাসান) ওরফে সোহেল মাহফুজ, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ। তারা সবাই কারাগারে।

ঘটনাস্থলে নিহত পাঁচ আসামি হলো রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল। এছাড়া বিভিন্ন ‘জঙ্গি আস্তানায়’ অভিযানের সময় নিহত ৮ আসামি হলো তামিম চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, তানভীর কাদেরী, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ, রায়হান কবির তারেক, সারোয়ার জাহান মানিক, বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আদালত,হলি আর্টিজান,হামলা,রায়
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close