প্রতীক ইজাজ

  ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

মামলাজটে খালেদা জিয়া

সময় লাগতে পারে কারামুক্তিতে

জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড নিয়ে পাঁচ দিন ধরে কারাগারে খালেদা জিয়া। এখনো রায়ের সার্টিফায়েড কপি বা প্রত্যয়িত অনুলিপি পাননি তার আইনজীবীরা। অনুলিপি পেলে হাইকোর্টে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ও জামিন চেয়ে পৃথক আবেদন করবেন তারা। একইভাবে রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করবে। আপিল আবেদনে লড়বে। শুরু হবে দুপক্ষের আইনি লড়াই।

আইনজ্ঞরা বলছেন, ৬৩২ পৃষ্ঠার এ বিশাল রায়ের সার্টিফায়েড কপি পেতে এক-দুই সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। কপি পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে হবে। তবে আপিল নিষ্পত্তির নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা না থাকায় তা নির্ভর করছে আদালতের ওপর।

আইনজ্ঞরা বলছেন, এই মামলায় খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর সাজা হয়েছে। সাধারণত সাত বছর পর্যন্তও জামিন দেন হাইকোর্ট। তবে হাইকোর্ট যদি জামিন দেয়ও রাষ্ট্রপক্ষেরও এই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করার এখতিয়ার রয়েছে। তবে খালেদা জিয়ার বয়স, মর্যাদা সবকিছু বিবেচনায় এই মামলা থেকে জামিন পেতে পারেন। আদালত চাইলে দন্ড স্থগিত করতে পারেন, যত দিন না হাইকোর্টের মামলার নিষ্পত্তি হয়।

তবে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হাইকোর্ট সাজা স্থগিত করে জামিন দিলেও খালেদা জিয়ার কারাবাস দীর্ঘ হতে পারে বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা। তাদের মতে, রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার পর খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা তার মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করবেন, এটা ঠিক। সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষও তো তার জামিনের বিরোধিতা করবে। আপিল আবেদনেও লড়বে। হাইকোর্টে যে পক্ষেরই হার হোক, তারা আবার সুপ্রিম কোর্টে যাবে। উচ্চ আদালত পর্যন্ত সব প্রক্রিয়া শেষ করে খালেদা জিয়ার মুক্তি পেতে বেশ বিলম্বই হতে পারে বলে মত তাদের।

এ ছাড়া জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট মামলার বাইরে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরো পাঁচটি মামলায় ইতোমধ্যেই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। সেসব মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হলে তাকে পুনরায় কারাগারেই থাকতে হবে। এসব মামলার আলাদাভাবে জামিন নিতে হবে। এতেও সময় লাগবে। বিশেষ করে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিচারও শেষ পর্যায়ে। যদি এর মধ্যে ওই মামলায় রায়ও হয়ে যায়, আর খালেদা জিয়া যদি নতুন করে দণ্ডিত হন তাহলে আরো সময় লাগবে মুক্তি পেতে। ফলে সবগুলো মামলায় জামিন নিয়ে খালেদা জিয়ার কারামুক্তির ফয়সালা এখন সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। ফলে কবে নাগাদ খালেদা জিয়া কারাগার থেকে বের হবেন, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউ-ই।

স্বয়ং খালেদা জিয়ার আইনজীবীরাই খালেদা জিয়ার কারামুক্তিতে সময় লাগতে পারে বলে মনে করছেন। বিএনপির একাধিক আইনজীবী জানিয়েছেন, তারাও মনে করছেন খালেদার কারামুক্তি বিলম্ব হতে পারে। কারণ হিসেবে তাদের মতে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ের প্রত্যয়িত অনুলিপি এখনো খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা পাননি। অনুলিপি না পাওয়ায় পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। আবার এই মামলার বাইরে অন্য মামলায় খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার দেখানো হলে আলাদাভাবে তাকে জামিন নিতে হবে। এতেও সময় লাগবে।

এ ব্যাপারে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, রায়ের পরই আমরা সার্টিফায়েড কপির জন্য আবেদন করেছি। আজ (গতকাল সোমববার) পর্যন্ত আমাদের কপি সরবরাহ করা হয়নি। সার্টিফায়েড কপি পাওয়ার পরই আমরা আপিল ও জামিনের বিষয়ে প্রক্রিয়া শুরু করব। অন্য পাঁচটি মামলার গ্রেফতারি পরোয়ানা কীভাবে নিষ্পত্তি করা যায়, সে বিষয়টি আমরা দেখছি। এর মধ্যে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ তাদের যুক্তিতর্ক শেষ করেছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আমরা আমাদের বক্তব্য তুলে ধরব। মামলার বিষয়ে আমাদের পক্ষে থাকা যুক্তিগুলো উপস্থাপন শেষ হলেই এ মামলার বিচার শেষ হবে।

অন্যদিকে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, রায়ের সার্টিফায়েড কপি দেওয়ার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। এটা আদালতের ওপর নির্ভর করে। রায়ের অনুলিপি প্রস্তুত হওয়ার পর সবার স্বাক্ষর হলেই সার্টিফায়েড কপি সরবরাহ করা হয়। তবে মুক্তি পেতে হলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জারি থাকা পাঁচ গ্রেফতারি পরোয়ানায়ও পৃথক করে জামিন নিতে হবে।

এই আইনজীবী জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা প্রসঙ্গে বলেন, মামলাটি শেষ পর্যায়ে থাকলেও কবে শেষ হচ্ছে তা আসামিপক্ষের ওপর নির্ভর করছে। আমরা আমাদের যুক্তি উপস্থাপন সমাপ্ত করেছি। এখন আসামিপক্ষ শেষ করলেই রায়ের জন্য দিন ঠিক হবে।

খালেদার কারাবাস দীর্ঘ হতে পারে কি না—জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, কারাবাস দীর্ঘ হবে কি না, তার নির্ভর করবে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের আপিল করার ওপর ও আদালতের ওপর। খালেদা জিয়ার মামলা তো চলছেই, এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির আরেকটি মামলা আছে। নাইকোর মামলাও চলছে। তার নামে বাস পোড়ানোর মামলার পরোয়ানা আছে। দুর্নীতির মামলা আছে। দেখা যাক কী হয়।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। দলের বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অন্য পাঁচ আসামির অর্থদণ্ডসহ ১০ বছর করে কারাদণ্ড হয়েছে। রায় ঘোষণার পর সেদিনই খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়া হয়। ডিভিশন পাওয়ার পর তাকে নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো কারাগারে প্রশাসনিক ভবনের কক্ষ থেকে ডে কেয়ার সেন্টার বলে পরিচিত মহিলা কারাবন্দিদের ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বাইরেও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরো ৩৪টি মামলা রয়েছে। দুর্নীতি, যানবাহনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা, সহিংসতা, নাশকতা ও রাষ্ট্রদ্রোহ এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে এসব মামলা হয়। এর মধ্যে ১৯টি মামলা বিচারাধীন আছে। এসব বিচারাধীন মামলার মধ্যে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নাশকতা ও মানহানিসহ পাঁচটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। মামলাগুলো হচ্ছে—ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে পেট্রলবোমায় আটজনকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের দুটি মামলা, যুদ্ধাপরাধীদের মদদ দেওয়ার একটি মানহানির মামলা, ভুয়া জন্মদিন পালন করে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সুনাম নষ্টের একটি মামলা এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের একটি মামলা।

আইন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার পর খালেদা জিয়া এসব মামলায় জামিন নেননি। তাই জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় জামিন পাওয়ার পর আবার এই পাঁচ মামলায়ও তাকে জামিন নিতে হবে। এ ছাড়া শেষ পর্যায়ে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাও। এই মামলায় সাজা হলে খালেদা জিয়ার কারামুক্তিতে সময় লাগতে পারে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, যে মামলায় কারাগারে, সে মামলা থেকে জামিন পেতে হলে আগে রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পেতে হবে। সে ক্ষেত্রে বেশ কিছু সময় বিলম্ব হতে পারে। এ ছাড়া আরো যে পাঁচ মামলা, পুলিশ চাইলে এসব মামলায়ও শ্যোন অ্যারেস্ট দেখাতে পারে। যদি দেখায় তাহলে অবশ্যই জামিন নিতে হবে।

একইভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, আইনজীবীরা আপিল করলে সার্বিক বিবেচনায় খালেদা জিয়া জামিন পেতে পারেন। হাইকোর্ট চাইলে যত দিন পর্যন্ত না মামলা নিষ্পত্তি হয়, তত দিন খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করতে পারেন। তবে অন্য যে মামলাগুলোয় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা হয়েছে, সেগুলোতে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে কারাগারে রাখা যাবে। এগুলোর এসব মামলা থেকে জামিন পেতে হলে আলাদাভাবে আপিল করতে হবে। সে ক্ষেত্রে কারগার থেকে বের হতে সময় লাগতে পারে। ফলে খালেদা জিয়ার কারামুক্তির বিষয়টি নির্ভর করছে আইনি প্রক্রিয়ার ওপর। সবশেষে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে কারামুক্তির বিষয়।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি,খালেদা জিয়া,মামলাজট
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist