সিরিয়া যুদ্ধের ৭ বছর: হতাহত হয়েছে ৫ লক্ষাধিক মানুষ
দীর্ঘ ৭ বছর ধরে যুদ্ধ চলছে সিরিয়ায়। অথচ ৭ বছর আগে এর শুরুটা ছিল শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শনের মাধ্যমে। সেই বিক্ষোভ পরবর্তীতে রূপ নেয় গৃহযুদ্ধে। এখন সেই যুদ্ধই পরিণত হয়েছে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর নিজেদের মধ্যে প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক মনাবাধিকার সংস্থা সিরিয়ান অবজার্ভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত ৩৫৩,৯০০ মানুষ মারা গেছে সিরিয়ায়। যাদের মধ্যে ১০৬,০০০ জনই বেসামরিক। এর বাইরেও সংস্থাটির ভাষ্য অনুযায়ী নিখোঁজ রয়েছেন আরও ৫৬,৯০০ জন। সংস্থাটির মতে আরও ১,০০,০০ জনের মৃত্যুর তথ্য নথিভুক্ত করা হয়নি। সব মিলিয়ে ৫ লক্ষাধিক মানুষ হতাহত হয়েছে।
পশ্চিমা গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, সিরিয়া যুদ্ধের কেন্দ্রে রয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। রাশিয়া ও ইরানের পাশাপাশি তাঁকে সমর্থন দিচ্ছে কয়েকটি শক্তিশালী সশস্ত্র শিয়া জঙ্গী গোষ্ঠী। এই শিয়া জঙ্গীগোষ্ঠী গুলোকে বিভিন্ন সময়ে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো। আসাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দী কয়েকটি বিদ্রোহী দল। যাদের মধ্যে প্রধান জাইশ আল-ইসলাম ও আহরার আল-শাম। যুদ্ধে এই বিদ্রোহী দলগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এখনও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
খবরে প্রকাশ, সরকারি বাহিনী সরে আসার পর সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের বড় একটি অংশের দখল নেয় কুর্দি বিদ্রোহীরা। এই কুর্দি বিদ্রোহীদের সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্র। কুর্দিরা নিজেদের জন্য একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের দাবীতে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। ইসলামিক স্টেট জঙ্গীদের বিপক্ষেও যুদ্ধ করছে কুর্দিরা। আবার এই কুর্দিদের বিপক্ষে যুদ্ধ করছে তুরস্ক। আর সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলে ও ইরাকে একসময় বিশাল জনপদ দখল করে রাখা ইসলামিক স্টেট জঙ্গীদের কাছে কোনো অঞ্চলের কর্তৃত্ব না থাকলেও তারা এখনও বড় একটি হুমকি।
শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী ইরানের বিরুদ্ধে শক্তি সঞ্চয় করার উদ্দেশ্যে বিদ্রোহী দলগুলোকে অস্ত্র ও অর্থ জোগান দিচ্ছে সৌদি আরবও। শিয়া জঙ্গীগোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে অস্ত্র সহায়তা দিচ্ছে ইরান। এই অস্ত্র সহায়তা বন্ধ করতে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে সম্প্রতি বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।
জানা যায়, ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হয় সিরিয়ার দক্ষিণের শহর ডেরা’য়। বিক্ষোভ শুরুর অনেক আগে থেকেই কর্মসংস্থানের অভাব, দুর্নীতির মত নানা কারণে অস্থিরতা বিরাজ করছিল সিরিয়ায়। এই বিক্ষোভকে বিদেশী মদদপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ আখ্যা দেন প্রেসিডেন্ট আসাদ। বিক্ষোভ দমন করতে আসাদ সরকারের বাহিনী অভিযান চালায় বিক্ষোভকারীদের ওপর। এই আন্দোলন বিরোধী অভিযান ছড়িয়ে পরলে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের জন্য আন্দোলন শুরু হয় পুরো দেশে।
ওই সময় দ্রুত অস্থিরতা ছড়িয়ে পরে, বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের অভিযানও জোরদার হয়। বিদ্রোহীরা শুরুতে নিজেদের জীবন রক্ষার্থে অস্ত্রধারণ করে। পরে তার একত্রিত হয়ে নিজেদের এলাকার সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। সহিংসতা ছড়িয়ে পরে সিরিয়াকে গৃহযুদ্ধের মুখে ফেলে দেয়।
এদিকে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে সমর্থন দেয়ার পেছনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। সিরিয়া মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার সবচেয়ে বন্ধুভাবাপন্ন দেশ। আসাদ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে সিরিয়ার সাথে রাশিয়ার সন্ধি টিকে থাকবে না। আসাদ যুদ্ধে পরাজিত হলে ভূমধ্যসাগরে সিরিয়ার তারতুস নৌঘাঁটিও হাতছাড়া হয়ে যাবে। আসাদকে সমর্থন দিয়ে এসেছে ইরানও। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের প্রতিপত্তি ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে সিরিয়ার সরকারকে সমর্থন দিয়েছে ইরান।
তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও কয়েকটি পশ্চিমা রাষ্ট্র বিভিন্ন সময় সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু রাশিয়ার বিমান সহায়তা আর ইরানের সেনা সমর্থনে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী বিদ্রোহীদের দমন করতে সক্ষম হয়েছে। সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস নামের একটি প্রশিক্ষিত ও সশস্ত্র বাহিনীকে সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই বাহিনীর অধিকাংশই ছিল কুর্দিশ বাহিনী ওয়াইপিজি'র সদস্য। সিরিয়ার উত্তর-পূর্ব অংশ থেকে ইসলামিক স্টেট জঙ্গীদের বিতারিত করার পেছনে বড় ভূমিকা পালন করে এই বাহিনী।
সিরিয়া থেকে পালিয়ে যাওয়া লক্ষাধিক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে তুরস্ক। তবে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি নামের একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সহায়তা করছে তারা। ইসলামপন্থী জঙ্গীদের সহায়তা করার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তুরস্ক মনে করে কুর্দিশ বিদ্রোহীদের উত্থান হলে ও তারা সার্বেভৗমত্ব পেলে তা তুরস্কের স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলবে। তারা কুর্দিশ বাহিনী ওয়াইপিজি'কে জঙ্গী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে এই ওয়াইপিজি যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট। এর ধারাবহিকতায় ন্যাটো'র সদস্য তুরস্ক এখন রাশিয়ার সাথে বন্ধুভাবাপন্ন। আর সিরিয়ার দক্ষিণে থাকা ইসরায়েলের প্রধান চিন্তা সিরিয়ার ভেতরে ইরানের শক্তিবৃদ্ধি। একইসাথে শিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর কাছে আধুনিক অস্ত্র সরবরাহও চিন্তায় ফেলছে ইসরায়েলকে।পিডিএসও/মুস্তাফিজ