দলিতদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ভারত উত্তাল : নিহত ৫
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ ভারতে দলিত বা নিম্নবর্ণের মানুষদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আজ সোমবার ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। এই ঘটনায় মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে সহিংসতায় অন্তত ৫ জন নিহত হয়েছেন। পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খন্ড ও ওড়িশার মতো বিভিন্ন রাজ্যও দলিত বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে। দেশে দলিত সুরক্ষার জন্য যে কঠোর আইন আছে, তা সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক এক নির্দেশে শিথিল হয়ে পড়েছে- এই অভিযোগেই আজ ভারত বনধের ডাক দিয়েছিল দলিতদের নানা সংগঠন।
বিরোধী রাজনীতিকরা অবশ্য মনে করছেন ভারতে গত বেশ কিছুকাল ধরে দলিতদের ওপর অত্যাচারের যে একের পর এক ঘটনা ঘটছে, সেই পটভূমিতেই এদিনের বিক্ষোভ এরকম ব্যাপক সহিংসতার চেহারা নিয়েছে। পাঞ্জাবের ভাতিন্ডায় তরোয়াল, লাঠিসোঁটা, বেসবল ব্যাট নিয়ে এদিন তুমুল বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন শত শত দলিত- যে প্রতিবাদে আজ দিনভর অচল হয়ে ছিল গোটা রাজ্যই।
ভারতে তফসিলি জাতি ও উপজাতিভুক্ত মানুষদের সুরক্ষার জন্য যে আইন আছে, গত ২০শে মার্চ তাতে দুটো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করে সুপ্রিম কোর্ট। যার ফলে দলিতদের নির্যাতনে অভিযুক্তদের আর সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা যাবে না এবং তাদের জামিনেরও সুযোগ থাকবে। দলিত সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ ছিল এই রায়ের বিরুদ্ধেই।
দলিত সমাজের আন্দোলনকারী কুমার শ্যাম বলছিলেন, এই তো সেদিন ঘোড়ায় চড়ার অপরাধে এক দলিতকে মেরে ফেলা হল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর সেই হত্যাকারীদের গায়েও হাত দেওয়া যাবে না - যতক্ষণ না সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অনুমতি লিখিয়ে আনা যাবে। আরে, কোন আইনের না একটু-আধটু অপব্যবহার হয়? কিন্তু তাই বলে দলিত সুরক্ষার এই আইনটাকেই আপনি দুর্বল করে দেবেন?
এই প্রতিবাদকে ঘিরেই মধ্যপ্রদেশে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে এদিন একজন ছাত্রনেতা-সহ অন্তত চারজন নিহত হন। রাজস্থানের আলোয়াড়ে পুলিশের গুলিতে মারা যান আরও একজন। ভিন্ডে পরিস্থিতি সামলাতে ডাকা হয় সেনাবাহিনীকে। বিহার, ওড়িশা, রাজস্থানের নানা জায়গায় বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন চলাচল - চন্ডীগড়ের কাছে স্তব্ধ হয়ে পড়ে জাতীয় সড়ক।
শতকরা হিসেবে যে রাজ্যে দলিতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, সেই পাঞ্জাবে স্কুল-কলেজ, দোকানপাট এমন কী মোবাইল ইন্টারনেট পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে হরিয়ানা, বিহারের পাটনা- এমন কী কলকাতাও। এই আন্দোলনকে সমর্থন করছে যে বামপন্থী দল সিপিআই (এম এল), তাদের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলছিলেন দলিতদের ক্ষোভের আগুন কিন্তু ধিকিধিকি জ্বলছিল বেশ কিছুদিন ধরেই।
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, পটভূমিটা যদি আপনি দেখেন, তাহলে দেখবেন উনাতে দলিতদের নির্মমভাবে পেটানোর ঘটনা দিয়েই এর শুরু। তারপর উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর সাহরানপুরে দলিতদের হত্যাকান্ড এবং দলিত সংগঠন ভীম আর্মির নেতাদের গ্রেফতার করা হল। এরপর মহারাষ্ট্রে ভীমা কোরেগাঁও কান্ড- দলিতদের ওপর অত্যাচারের একের পর এক ঘটনা তো ঘটেই যাচ্ছে।
দীপঙ্কর বলেন, একদিকে যেমন নির্যাতন বাড়ছে- তেমনি দলিতদের যেটুকু আইনি সুরক্ষা ছিল সেটাকেও এখন দুর্বল করার চেষ্টা চলছে। ঠিক এই কারণেই আমার মনে হয় কোনও রাজনৈতিক দলের কর্মসূচী না-হওয়া সত্ত্বেও এই প্রতিবাদ এত ব্যাপক আকার নিয়েছে, বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলেছে।
দেশ জুড়ে দলিতদের এই ব্যাপক বিক্ষোভ সামলাতে সরকার এদিন তড়িঘড়ি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে- আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ জানিয়েছেন তারা রায় পুনর্বিবেচনার জন্য শীর্ষ আদালতে একটি পিটিশন দাখিল করেছেন। মূল মামলাটিতে ভারত সরকার কোনও পক্ষ ছিল না, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, সামাজিক ন্যায় মন্ত্রণালয় এই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন জমা দিয়েছে। এই রায় দেওয়ার সময় সুপ্রিম কোর্ট যে যুক্তি দিয়েছে সরকার তার সঙ্গে একমত নয়- এবং আদালতের এটা আবার ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে।
বিজেপির বিভিন্ন শরিক দল অবশ্য অনেক আগেই সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। রামবিলাস পাসোয়ান বা নীতিশ কুমারের মতো শরিক নেতারা এই ইস্যুতে প্রকাশ্যেই দলিতদের পক্ষ নিয়েছেন- বিরোধী কংগ্রেসও একই সুরে কথা বলছে। নরেন্দ্র মোদী সরকারের একটা দলিত-বিরোধী ভাবমূর্তি আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল, এদিনের ব্যাপক বিক্ষোভ তাদের অবশ্যই আরও চাপের মুখে ফেলে দিয়েছে।পিডিএসও/মুস্তাফিজ