আদিল মাহমুদ

  ২৮ জুলাই, ২০২০

মানবজাতি এবং শান্তিতত্ত্ব

শান্তি শব্দটা আপেক্ষিক। এর অর্থ বিশ্রাম, নিস্তব্ধতা, প্রশান্তি, আরাম, সান্ত্বনা, নীরবতা, স্থিরতা, অচলতা, স্বচ্ছতা, নিরাপদ রাখা। ব্যাপক অর্থে, সংঘাত বা যুদ্ধবিহীন সময়কাল। বৃহৎ পরিসরে শান্তি বলতে, দেশের ঐক্য, শান্ত অবস্থা এবং বৈরী পরিবেশ দ্বারা রাষ্ট্র আক্রান্ত না হওয়াকে বুঝায়।

আসলে শান্তির প্রতীক বড় মনোরম কিন্তু সে দুর্বল, তবু মানুষের মধ্যে যা কিছু মহৎ এই শাস্তির আশা তাকে অনুপ্রাণিত করে; মানুষ যদি তার পেছনে সঙ্ঘবদ্ধ হয় তবে শান্তির রূপক এই পবিত্র কপোত সিংহ বা সাপের বিরোধিতা করে অবশ্যই জয়ী হবে। যে পদ্ম সূৰ্যকিরণের স্পর্শে বিকশিত হয়, যার কোনো চোখ ধাঁধানো চমৎকারিত্ব নেই, আছে নীরব শান্ত সৌন্দর্য আর স্নিগ্ধ সুবাস, তাকেই প্রাচীন ভারতবর্ষবরণ করেছিল শান্তি আর সমৃদ্ধির প্রতীক রূপে। পদ্ম বিকশিত হয় প্ৰভাতে আর সন্ধ্যায়। তবু এর মধ্যে আছে অমরত্বের ইঙ্গিত, কারণ প্রতিদিনই সে একটু করে ফুটে ওঠে, এ ফুল আকাশ-মাটি-জলের মধ্যে মালিন্য আর পবিত্রতার মধ্যে বিচরণশীল; এ ফুল নিজে এক শান্তিপূর্ণ মর্যাদাময় তৃপ্ত জীবনবোধের পবিত্র প্রতীকস্বরূপ।

তবে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে শান্তির বিভিন্ন মূল্যায়ন হয়ে থাকে। কোথাও কোথাও মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়ে শান্তির প্রত্যাশা করা হয়, আবার কোথাও নিজেদের মৃত্যুর বিনিময়ে শান্তি স্থাপন করা হয়। এ পৃথিবীতে এমন অনেকেই আছেন, যারা শান্তির জন্য নিজের জীবন উৎর্সগ করেছেন। আবার অনেকে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অশান্তিকে স্বাগত জানান। তাই, শান্তির মর্মবাণী এক-একজনের কাছে এক-এক রকম। কেউ মানুষকে হত্যা করে শান্তি পান, কেউ বাঁচিয়ে। তবে যারা মানুষকে বাঁচিয়ে শান্তি খোঁজেন, তারা কখনো কখনো নিজের প্রাণও বিসর্জন দিয়ে থাকেন।

বিশ্বে শান্তির জন্য অনেকেই জীবনবাজি রেখেছেন। পবিত্র আল-কোরআনে উল্লেখ আছে, ‘নিশ্চয়ই সীমা লংঘনকারীকে আল্লাহ ভালবাসেন না।’ শান্তির জন্য নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘প্রতিশোধ গ্রহণের মাধ্যমে তুমি যতটা শান্তি পাবে, তার চেয়ে ঢের বেশি পাবে ক্ষমা করার মাধ্যমে।’ আবার আল হাদিসে আছে, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে দয়া করে না, আল্লাহ তায়ালা তার ওপর রহমত বর্ষণ করেন না।’ অপরদিকে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বলেছেন, ‘হাত ধরো, হাত ধরো—আমি যুদ্ধের বদলে এনে দেব শ্রেণিহীন কবিতার ভুবন।’

এভাবে পৃথিবীর বুকে প্রত্যেক মানুষই সুখ-শান্তি পাওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের মতবাদ, জাতি, বর্ণ, উৎপত্তি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এই শান্তি ঘিরেই। আবার অভ্যন্তরীণ শান্তি বা মানসিক শান্তি বলতে মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে অর্জিত শান্তিকে বুঝায়। কাজের প্রভাব, বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্তি লাভের মাধ্যমে মানসিক শান্তি আসে। প্রশিক্ষণ, সাধনা, প্রার্থনা, মন্ত্র বা যোগ ব্যায়ামেও শান্তি খুঁজে বেড়ান অনেকে।

যদি আমি কোনো লোককে জিজ্ঞেস করি, তুমি এ কাজটি কেন করো? কি কারণে করো? উত্তর আসবে, শান্তির জন্য!

সর্বকনিষ্ঠ নোবেল শান্তি বিজয়ী কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং, জুনিয়র বলেছিলেন, ‘যদি উড়তে না পার তবে দৌঁড়াও, যদি দৌঁড়াতে না পার তবে হাঁটো, হাঁটতে না পারলে হামাগুড়ি দাও, যে অবস্থাতেই থাকো, এগিয়ে চলা বন্ধ করবে না।’

আবার সতীদাহ প্রথা, দাস প্রথার বিলুপ্তি শান্তির অনেকটা নিদর্শন। আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), মক্কা বিজয়ের পর প্রথম দাসপ্রথা বিলোপের ঘোষণা দেন। দাস যায়েদ (রা.)-কে সেনাপতি নিয়োগ দিয়ে তিনি তার প্রমাণ করেন।

আবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন ১৮৬৩ সালের ১ জানুয়ারি দাস প্রথার আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটান। অন্যদিকে, রাজা রামমোহন রায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে আনুষ্ঠানিকভাবে সতীদাহ প্রথা বাতিল করা হয়। এসব কুক্ষ্যাত, নোংরা নিয়ম বিলোপ করে অনেকেই শান্তির মুখ দেখেছিলেন, শান্তির আশা করেছিলেন। কিন্ত এসেছি কি শান্তি!

আসেনি, আসবেও না! কারণ, মানুষ শান্তিপ্রিয় নয়। একটি যুদ্ধবিহীন বিশ্ব প্রতিষ্ঠার (যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই স্লোগানে) লক্ষ্যে প্রতিবছর বিশ্ব শান্তি দিবস পালিত হয়। কিন্তু এতে কি যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে, শান্তি এসেছে?

এখন বিশ্ব আরেক অশান্তির ঘোরে পড়ে আছে। সেটা প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯। এই ভাইরাসের কারণে হুমকির মুখে বিশ্বের শান্তি-নিরাপত্তা।

বিশ্বে করোনা আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছেই। মৃত্যু ছাড়িয়েছে সাড়ে ছয় লাখ আর আক্রান্তের সংখ্যা পৌনে দুই কোটির কাছাকাছি। এই অবস্থায় সামাজিক স্তরে অশান্তি ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এখনই করোনার প্রাণঘাতী শক্তি বিনাশ করা না গেলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।

বিশ্বের ২১৫টি দেশ ও অঞ্চলে করোনার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে। বলতে গেলে বিশ্বেই বিপর্যয় তৈরি করেছে করোনা। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, স্পেনের মতো দেশগুলোও করোনার সঙ্গে পেরে উঠছে না। বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ করোনার কারণে চাকরি হারাচ্ছে। এই পরিস্থিতি বেশিদিন স্থায়ী হলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মারাত্মক সঙ্কট তৈরি হবে। তাহলে শান্তি কোথায়?

আসলে শান্তি কল্পনাপ্রসূত। অশান্তি, ক্লেশ, ঝগড়া, বিবাদ, লোভ, লালসা, ধ্বংসযজ্ঞ, ক্রোধ, হিংসা, রাহাজানি, খুন অশান্তি ডেকে আনছে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে।

পরিশেষে কবিতায় বলতে গেলে—সকাল গড়িয়ে দুপুর আসে/বিকেলের পর রাত/সপ্তাহ মাস বছরজুড়েই/সবখানে সংঘাত।/আলোর পথে-মুক্ত আকাশে/ছুটে দিগ্বিদিক/শান্তির গান গেয়ে যান কবি/প্রতিক্ষণে ঠিকঠিক।/আহা! কি শান্তি- ক্লান্তি, ক্লান্তি/কষ্টের ভীড়ে হাসে ভ্রান্তি!/শান্তি, শান্তি!

লেখক : পরিদর্শক (তদন্ত) পরশুরাম থানা, ফেনী

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
শান্তি,মানবজাতি,কোভিড-১৯,করোনা,যুদ্ধ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close