সাদিয়া আফরিন

  ২৫ জুলাই, ২০২০

করোনার সাথে একুশ দিন

২০ জুন আব্বুর অবস্থার অবনতি হচ্ছে ধীরে ধীরে। বুঝতে পারছিলাম না কি করবো, আমি বা আম্মু তেমন কিছুই চিনতাম না ঢাকার। দুদিন আগে এসেছি বাবার কাছে। যেহেতু বাবার করোনা পজিটিভ তাই আত্মীয়স্বজনও তেমন ছিলনা কেউ সাহায্য করার। রাতের বেলায় যখন বাবা বিছানা ছেড়েই উঠতে পারছিলো না তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করাই। এই রাতটা যে কিভাবে কেটেছিল এখনও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। সারারাত আব্বুর দিকে তাকিয়েছিলাম, মাথায় হাত বোলাচ্ছিলাম আর ডাক্তারের পিছু ছুটছিলাম। মনে হচ্ছিল এই বুঝি বাবা নেই। খাওয়া ঘুম দুদিন আগেই চুকে গেছে। আব্বুর নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছিল আর অনর্গল ঢেকুর তুলছিল, হাত পা ফুলে গিয়েছিল। আগে থেকেই কিডনি, ডায়াবেটিসের সমস্যা থাকায় আব্বু সুস্থ হচ্ছিল না। মাকে বাবার পাশে রেখে পুরো হাসপাতালের আটতালা থেকে দশতালা, নিচতালা করে বেরিয়েছি একেকটা টেস্ট করানোর জন্য। আব্বু কিছু খেতে পারছিলোনা, স্যালাইন চলছিল। আম্মু আর আমারও খাওয়া বন্ধ। পাশের বেডে এক ডাক্তার ভাইয়া ছিলেন তার বাবাকে নিয়ে, প্রেসক্রিপশন থেকে শুরু করে আব্বুর অক্সিজেনটা দেয়া অবধি তিনি অনেক সাহায্য করেছিলেন। ওই ভাইয়ার বাবা তখন অনেকটা সুস্থ, তিনি নাকি বাবার থেকেও সিরিয়াস অবস্থায় ছিলেন। তার কথা শুনে মনে অনেকটা সাহস পাই যে আব্বুও ওনারই মত সুস্থ হয়ে উঠবে। আমাদের বেডের অপজিটেই ঢাবিতে পড়েন এক আপু ছিলেন তার বাবাকে নিয়ে, তাকে দেখেও সাহস পাই। কথা হয় অনেক বলেন, ‘ভয় পেয়ো না, আঙ্কেল সুস্থ হয়ে উঠবে। তারা অনেক সাহস দিয়েছে, কথা শুনতো খেয়াল দিয়ে। দেখতে দেখতে মুখ চিনে ফেলেছিল আমার। দেখা হলেই জিজ্ঞেস করতো, কি? বাবার অবস্থা কেমন এখন? আমি কেঁদে দিতাম। বলতাম, এখনো ভালো দেখছি না। ডাক্তার আর ওনারা বলতেন ধৈর্য ধরো।

২২ জুন আব্বু চোখ তুলে তাকাচ্ছে, সাড়া দিচ্ছে। স্যালাইন দেয়ার পরে ভাল অনুভব করছিলো বুঝতে পারলাম। খাওয়ানোর চেষ্টা করি, খেতে পারেনা। তাকিয়ে দেখি চোখের সামনে কত কষ্ট পাচ্ছে আব্বু। প্রতিদিনই এই ফ্লোর থেকে ভোরবেলা লাশ বেরোয়। কান্নার আর্তনাদে ঘুম ভাঙে। এক রোগীর সাথে কেউ নেই ছেলেমেয়ে ফেলে রেখে চলে গেছে। স্যালাইনের সাথে রক্ত উঠে সারা বিছানা জামাকাপড় রক্ত মেখে গেছে। কেউ দেখারও নেই। নার্সরা এসে শেষ চেষ্টা করেছিল বাঁচানোর, কিন্তু বাঁচেনি। অপজিটের বেডের আপুরা চলে গেছে, নতুন এসেছে। তার অবস্থা আব্বুর থেকেও খারাপ। এসব দেখে দেখেই দিন পার হয়ে যায়।

২৩ জুন অন্যান্য দিনগুলোর তুলনায় আব্বু কিছুটা ভাল, টুকটাক কথা বলছে আমাদের সাথে। চোখ মেলে দেখছে সব। নতুন রোগীটার অবস্থা ভালোনা, সেচুরেশন বাড়ছেনা। আব্বু তাকে দেখে আরও ভয় পাচ্ছে। রাত বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ওই রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। একসময় সেচুরেশন ৩৫ এ নেমে গেল। ডাক্তার- নার্স এসে দাঁড়িয়ে আছে কিছু করার নেই স্রষ্টাকে ডাকা ছাড়া। লোকটা আব্বুর চোখের সামনেই মারা গেল! আব্বু ভয়ে চোখ বুজছেনা, আমাকে ধরে আছে। রাতটা পার হলো কোনোভাবে।

২৬ জুন কিছুই বুঝতে পারছি না। আব্বুর অবস্থা দিনের বেলায় ভালো হয়, আবার রাতের বেলায় খারাপ। অজ্ঞান হয়ে যায় কখনো। তখনই শরীর অবশ হয়ে আসে আমার, হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। ১০৪ ডিগ্রি জ্বর আসে আব্বুর রাতের বেলাতেই। নিঃশ্বাস নিতে পারেনা, ভয়ে কুঁচকে যাই। ভোর হয় ।আব্বুও একটু চোখ মেলে তাকায়। আব্বুকে দেখতে দেখতে নিজের দিকে খেয়াল নেই, শরীর দুর্বল হয়ে গেছে। ভুলেই গেছিলাম বাবা কোভিড পজিটিভ। আমি ঢাকা মেডিকেলের করোনা ইউনিটে আছি আর আমারও যে কোভিড পজিটিভ হতে পারে। ধীরে ধীরে অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়ি, হাঁটার শক্তি পাই না, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

২৭ জুন

ডাক্তার ভাইয়াও তার বাবাকে নিয়ে চলে যায়। আরেকজন নতুন রোগী আসে, অনেকটাই ভাল অবস্থা, বসতে পারে বেশ। কিন্তু হায়! রাতের দিকে তারও সেচুরেশন নেমে যায়। ডাক্তারও এসে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু করার নেই। তার সাথে তার বউ ছিল, দুটো বাচ্চা আছে। শেষ পরিণতিতে লোকটা ও চলে গেল ফুটফুটে দুটো বাচ্চা রেখে। সারারাত লাশটা রুমে চোঁখের সামনে পরে থাকে, লাশ নেয়ার মতো জায়গা খুঁজে পাওয়া যায় না। কেউ কাছেও যায় না লাশের, আত্মীয় স্বজন কেউনা! শেষ সৎকারও কোভিড রোগীদের কপালে থাকেনা। এর চেয়ে নির্মম দৃশ্য আর নেই!

আব্বুর সামনে এগুলো ঘটছে আর সে ভীত হচ্ছে। সাহস দিচ্ছি , তাও কতটুকই বা দেব? আমিও তো ভয় পাচ্ছি। সাথে তো মা ছাড়া আর কেউ নেই! মা যে খুব একটা সুস্থ আছেন তাও নয়!

৭ জুলাই

আম্মু আর আমি ডাক্তার দেখাই। এক্সরেতে আম্মুর থেকে আমার অবস্থা বেশি খারাপ। আমাকে ডাক্তার ভর্তি হতে বললেন সাসপেক্টেড ওয়ার্ডে। ভর্তি হলাম। নতুন করে আম্মুর ওপর প্রেশার পড়লো। আমার কাছে কিছুক্ষণ থাকতে হয়, আবার কিছুক্ষণ আব্বুর কাছে । ভাবলাম এভাবে চললে আম্মুকেও ভর্তি করতে হতে পারে। তাই আব্বুর কাছে গিয়েই থাকতাম। আর ডাক্তারের লেখা ঔষধ আম্মুকেও খাওয়াতাম।

এভাবেই দিন কাটছিল একের পর এক। ফুরাচ্ছিল না। আব্বু আস্তে আস্তে সুস্থের দিকে যাচ্ছে, এটাই ভরসা। ফ্লোরের বাকি রুমগুলোতে দেখা যেত বৃদ্ধ বাবা মায়েদের রেখে সন্তানেরা কিভাবে পালিয়ে যায় । আবার স্বামী স্ত্রী র ভালবাসাও দেখতাম। দুজনই ভর্তি হয়ে দুজনেই দুজনকে দেখছে। বুয়েটের এক আপুর সাথে পরিচয় হয়েছে। মাকে নিয়ে ত্রিশ দিন যাবৎ হসপিটালে।

১১ জুলাই শেষ দিন ভোরবেলা থেকেই আব্বু ছটফট করছে হসপিটালে আর থাকবেনা। অক্সিজেন লাগাবেনা, বাসায় গেলেই সে সুস্থ হয়ে যাবে। ডাক্তারকে নিজেই বলছে আমি বাসায় যেতে চাই। পরে ডাক্তার বলল আচ্ছা আপনাকে ছুটি দিচ্ছি অনেকদিন তো হলো। আব্বু সে কি খুশি! এ আনন্দ বলে বোঝানোর নয়! আব্বুর ছাড়পত্র পাওয়ার পরে আমারটাও নিয়ে আসি । ঔষধ লিখে দেয় দুজনকেই। বেশ এবার তবে বাসায় ফেরার পালা । এতদিনের কষ্টের দিনগুলি এবার তবে শেষ৷ চোখ বুজলেই ভয়াল স্মৃতি গুলো তাড়া করে বেড়ায়। এখনো হসপিটালের প্রতিটি রাতের কথা মনে পড়ে। কোভিড রোগীদের মস্তিষ্কের কিছুটা ক্ষতি হয়ে যায়।

মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে আব্বুর। আমিও টের পাই, সব ভুলে ভুলে যাই। মনে থাকেনা কিছু এখন আর আগের মতো। শরীরে জ্বর আসে, ঠান্ডা অনুভব করি। ফুসফুস দূর্বল, একটু হাটঁতেই হাঁপিয়ে যাই। আব্বুও পুরো সুস্থ নয়। তবু ভাল। বেঁচে তো আছে। শুকরিয়া স্রষ্টার নিকট, তিনজনই যে বেঁচে ফিরেছি এই ই ঢের! বাসায় আসতেও ঝামেলা কোভিড রোগীদের, বাড়িওয়ালারা ভয় পায়। প্রতিবেশীরা নাক সিটকায়। আপনজনেরাও এখনো কাছে আসেনা। এ বড় ভয়ানক ব্যাধী, যার ঘরে হয় সে বোঝে। ২০২০ সালে এসেও যদি করোনা ভাইরাসের জন্য বিনা চিকিৎসায় এত মানুষের প্রাণ যায়। তাহলে এই পৃথিবীর এত এত মহাকাশ সমুদ্রতল আবিষ্কারের কোনো মুল্যই নেই এই জগৎ-সংসারে। স্রষ্টার কাছে হাজার শুকরিয়া আমার বাবাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, যুদ্ধে আমাকে জিতিয়ে দিয়েছেন, জিতে তবেই বাড়ি ফিরেছি।

লেখক: শিক্ষার্থী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
করোনা,একুশ দিন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close