শাম্মী তুলতুল

  ১২ মে, ২০২০

ভালোবাসা ও নির্ভরতার নাম মা

আমরা ছয় ভাই-বোনের মধ্যে আমি মেঝো। সব সময় শুনি, মেঝো ছেলে-মেয়ে একটু ডানপিটে হয়। আমিও ব্যতিক্রম ছিলাম না। খুব দুষ্ট ছিলাম। পড়ালেখায় মনোযোগ ছিল না বললেই চলে। টিচার এলে নানা অজুহাতে বিদায় করতাম। গান-নাচ, খেলা, ছড়া-কবিতা লেখায় খুব আগ্রহ ছিল।

সবাই বিরক্ত হলেও হাল ছাড়েননি মা। এতটুকু বিরক্তি নেই তার। এই দুষ্ট-দুরন্ত মেয়েটিকে আজ তুলে ধরার পেছনে রয়েছে মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম।

আমার পড়ালেখার সাথে সাথে আমার প্রতিভাকেও তিনি বিকশিত করার সুযোগ করে দেন। আমার মা খুব কড়া এবং রক্ষণশীল ছিলেন। প্রতিটি ধাপে আদরে আদর শাসনের সময় শাসন করতেন। মা তৎকালীন পাকিস্তান আমলে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। রাউজান কলেজ ছাত্র সংগঠনের সভাপতি ছিলেন। যার জন্য একটি ঠাট মেজাজের মানুষ ছিলেন মা। ছিলেন সুন্দরী আর স্মার্টও।

তিনি দৌলত কবির একজন বংশধরও ছিলেন। রক্ষণশীল হয়েও তার সাহিত্য আর রাজনীতির পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে ছেলে-মেয়ের যেকোনো প্রতিভাকে গুরুত্ব দিতেন। আমার জন্ম একটা সাহিত্য, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক আর অভিজাত পরিবারে। তাই চারপাশের পরিবেশ ছিল অনেক সুন্দর আর শিক্ষণীয়। দ্রুত প্রতিভা বিকাশের সুবিধাটা বেশি পেয়েছিলাম শিশু বয়সেই।

তাছাড়া অনেকে রক্ষণশীল শব্দটাকে নিজেকে থামিয়ে দেওয়াকে বুঝত। কিন্তু আমাদের পরিবারে এই শব্দটি নিরাপদ আর নিরাপত্তার অর্থে ব্যবহার হতো। থামিয়ে দেওয়া অর্থে না। ১৩ বছর বয়সে মায়ের বিয়ের পর পর পড়ালেখা আর রাজনীতি করার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলেন শিক্ষক শ্বশুরের কাছে। তখন যা খুব কম নারীরাই পায়।

তাই মা বুঝতেন—একটা পরিবারে শিক্ষা যেমন দরকার, তেমনি নিজের প্রতিভাকে কাজে লাগানো সমান দরকার। কিন্তু সন্তানের জন্য সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করার জন্য গ্র্যাজুয়েশন শেষ করলেও প্রিয় রাজনীতি ছাড়তে বাধ্য হন। নিজের ইচ্ছা-শখকে চাপা দিয়ে তিনি চেষ্টা করেছেন আমি তুলতুলকে নিজের নাম আলাদা করে প্রতিষ্ঠিত করতে। মা না হলে কখনোই নিজের ভিত্তি তৈরি করা সম্ভব হতো না। ভয় যেমন পেতাম, তার প্রতিটি কথাও মানার চেষ্টা করতাম। বড় হয়ে ভাবি, একদিন যেসব বাধায় বিরক্ত হতাম আজ তা কাজ দিচ্ছে এই যুগের জীবনে। মা শিখিয়েছেন দানশীল হতে, মা শিখিয়েছেন নমনীয় হতে। শিখিয়েছেন নিজের ভেতরে থাকা অহংকারকে প্রশ্রয় না দিতে। মা শিখিয়েছেন ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেকে সব সময় যুক্ত রাখতে। শিখিয়েছেন বড়দের সম্মান আর ছোটদের আদর করতে। তিনি সব সময় একটা কথা বলতেন, যত বড় হবে তত ছোট হওয়ার প্রবণতা যেন থাকে। তবেই তুমি প্রকৃত মানুষ হওয়ার যোগ্য। একদিন নানা বাড়ির পুকুরে পড়ে গিয়েছিলাম, মা আর খালার জন্য সেদিন বেঁচে গিয়েছিলাম। সেই থেকে মা আর চোখের আড়াল হতে দেন না। মায়ের কি কান্না, সেই অসহায় মুখ এখনো আমাকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে তার দান-খয়রাতের শেষ নেই। একটু সর্দি হলেই মানত করতেন। দান করেন। দেখেছি, সন্তান অসুস্থ হলেই রাতের পর রাত চোখ দুটো জাগিয়ে রেখে প্রার্থনায় মগ্ন।

আমার অনেক ভাইবোন মারা গিয়েছিলেন, তাই মা সব সময় একটু বেশিই সন্তানদের নিয়ে চিন্তিত থাকেন। থাকতেন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। যতক্ষণ সন্তানরা বাসায় ফিরবে না, ততক্ষণ মুখে খাবার দিতেন না। ভাইবোন প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে পরিপূর্ণভাবে গড়ে তোলার যুদ্ধটা আম্মাকেই বেশি করতে হয়েছে। আমার লেখক হওয়া আর শিশুদের নিয়ে গবেষণা করার পেছনে প্রকৃতির বড় অবদান রয়েছে, আর এই অবদানের সান্নিধ্য পেয়েছি মায়ের কারণেই। বাবা-মা খুব শৌখিন ছিলেন, তাই দেশ-বিদেশে প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেড়াতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল ছোট থেকেই।

পাহাড়-নদী-সমুদ্রের সাথে আমার জন্ম থেকেই গভীর মিতালি। মিটমিট করে চোখ খুলতেই প্রথম পাহাড় আমাকে প্রথম অভ্যর্থনা জানায় মায়ের পর। মিটমিট করা চোখ আরেকটু বড় হলেই গ্রামে আসা-যাওয়ার পথে সাক্ষাৎ হয় নদী হালদার সাথে। চোখ একদম বড় হতেই হাত বাড়ালেই সমুদ্র। ধীরে ধীরে মহাসমুদ্র, রাঙ্গাপাহাড়, বান্দরপাহাড় আর খাগড়াপাহাড়।

মায়ের হাত ধরে হয়তো পাহাড়ে ওঠা, নয়তো সমুদ্রে পা ভেজানো। জীবনটাই তখন অসম্ভব ভালো লাগার চরম মূল্যবান মুহূর্ত। সমুদ্রের চিরচেনা গর্জন বলে যায় আমি ফুরাবার নয়। আনন্দ নিতে পারি, দিতেও পারি।

মা বলতেন, সমুদ্র হজম করছে আমাদের কান্না, আমাদের হাসি, নয়তো মৃত্যু। সুযোগ পেলেই সে গ্রাস করে। ভয় পেয়েও তার সৌন্দর্যের কাছে আমরা বার বার হার মানি। এই হারমানা সকল সমুদ্রপ্রেমীর কাছে অতি তুচ্ছ, ঠিক তোমার-আমার মতো।

মা অস্তিত্বের সহযাত্রী। মা যখন স্ট্রোকে বিছানায় তখন বুঝেছি, মা হারানোর বেদনা কি। মায়ের কোনো বিকল্প নেই। নেই কারোর সাথে তুলনা। সন্তানের উহ শব্দও মা তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে টের পান, এমন শক্তি একমাত্র মাকে দিয়েছেন স্রষ্টা। দিয়েছেন একমাত্র মায়ের পায়ের নিচেই সন্তানের বেহেশত।

লেখক : গল্পকার ও শিশুসাহিত্যিক [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মা,ভালোবাসা,শাম্মী তুলতুল,আমার আমি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close