বিল্লাল বিন কাশেম

  ১০ মে, ২০২০

আজ বিশ্ব মা দিবস

বিশ্বের সকল মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা

আজ বিশ্ব মা দিবস। শ্রদ্ধা চিত্তে স্মরি বিশ্বের সকল মাকে। পৃথিবীতে এত সুন্দর আর মধুর ডাক আছে কিনা জানি না। তবে আমাদের মা শুধু মাই না, তিনি একাধারে বাবা, মা, বন্ধু—এক কথায় আমাদের পৃথিবী। সংসারে আমার বাবা ছিলেন না। আমরা তিন ভাই, দুই বোন। এখনও যদি পাঁচটি আপেল ডাইনিং টেবিলে থাকে, মা পাঁচজনকে একটি করে সবগুলো আপেল দিয়ে শূন্য হাতে নিজ থেকেই বলতে থাকবেন আমি আপেল খাই না রে! আপেল খেলে আমার পেটে খুব গ্যাস হয়, ব্যথা হয়।

জর্জ ওয়াশিংটন বলেছিলেন, আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা আমার মা। মায়ের কাছে আমি চিরঋণী। আমার জীবনের সমস্ত অর্জন তারই কাছ থেকে পাওয়া নৈতিকতা, বুদ্ধিমত্তা আর শারীরিক শিক্ষার ফল। এটা বাস্তবিক জীবনে প্রায় সকলের জন্যই প্রযোজ্য। নেপোলিয়ান বোনাপার্ট বলেছিলেন, আমাকে একটি ভাল মা দাও, আমি তোমাদের একটি ভাল জাতি দেবো। একজন মাই পারে তার সন্তানদের আদর্শবান করে গড়ে তুলতে। বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায়, সন্তানদের বাবা হয়তো থাকে জন্মদাতা হিসেবেই। সন্তানের লালন পালন, পড়াশোনা ও সার্বিক খোঁজ মাকেই নিতে হয়। সন্তানের গতিপথ ও নব-নব সবই শেখে মায়ের কাছ থেকে। খুব ছোটবেলায় আমার মনে আছে যে, আমি ভাবতাম আমার মাই বিশ্বের সব চাইতে জ্ঞানী মানুষ। অবশ্য বড় বেলায় এখনো আমার ভাবনা একই রকম রয়েছে। আমাদের সব ভাই-বোনের আজকের যে অর্জন, সবই তার কারণেই। মায়ের শিক্ষাই শিশুর ভবিষ্যতের বুনিয়াদ, মাই হচ্ছেন শিশুর সর্বোৎকৃষ্ট বিদ্যাপীঠ।

আমার বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবা ছিলেন সংসার বৈরাগী মানুষ। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে কর্মকালীন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের করাচি থেকে দেশ মাতৃকার ক্রান্তিলগ্নে দেশে এসে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং স্থানীয়দের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন। আমার ফুপাতো ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কমান্ডার মোহাসীন ভাইয়ের কাছ থেকে শুনি বাবার গল্প। কিভাবে পালিয়ে পাকিস্তান থেকে দেশে আসছিলেন, আর একজন সৈনিক হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধে কি করেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি আবার বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে বিমান বাহিনী থেকে অবসর নেন। আমার বাবাকে কখনো দেখিনি কারও সাথে বীরত্ব দেখাতে। সংসার বৈরাগ্যের কারণে যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন, আমাদের নিয়ে তার ভাবনা ছিল না বললেই চলে। আমার বাবার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের কাজিরগাঁও গ্রামে। ১৯৯০ সালে বাবা আবুল কাশেম মৃত্যুবরণ করলে আমার মা আমাদের সব ভাই-বোনকে নিয়ে যশোরের কেশবপুর উপজেলার মঙ্গলকোট গ্রামে নিয়ে আসেন। কেশবপুর উপজেলা শহরেও আমার নানার বাড়ি আছে। তবে তিনি সেখানে আমাদের রাখেননি যে, আমরা বাজারের ছেলেদের সাথে মিশে বখে যাবো।

রাজধানী ঢাকা থেকে মঙ্গলকোট গ্রামে এসে আমার মা অনেকটাই দিশেহারা হয়ে পড়লেও আমাদেরকে কখনোই বুঝতে দেননি। প্রতিদিনই তিনি কাঁদতেন আমাদের অগোচরে। সেই সময় আমার মাকে আমি দেখেছি একদিকে তিন প্রচণ্ড কড়া একজন মা, একজন সফল মালিক ও অভিভাবক। আমরা যে বাবাকে হারিয়ছি কখনো বুঝতে দেননি। বাবা থাকতেও আমরা যে আদর ভালবাসা পাইনি আম্মা তার সবটাই দিয়েছেন। বাবার পেনশন রেশন ইত্যাদির জন্য আমার বড় ভাইটাকে ও আমাকে নিয়ে যেতেন ঢাকাতে। আমার মায়ের খালু একসময়ে যশোর ৬ আসনের সংসদ সদস্য গাজী এরশাদ আলী নানার মাধ্যমে একটি মালবাহী ট্রাক কেনা হয়েছিল, যা ট্রাক ব্যবসায়ীদের কাছে ইজারা দেয়েছিলেন তিনি। আম্মা প্রায় প্রতিদিনই কেশবপুরে নানার বাসায় যেতেন টাকা পয়সার হিসাব করতে।

ছোটবেলায় আমার কখনো মনে পড়ে না আমাদের ভাই-বোন কাউকে তিনি টাকা আনতে পাঠিয়েছেন। তখন আমার নানার বাড়ির গ্রামে জমিতে প্রচুর ফসল উৎপাদিত হতো। সেগুলো আমাদের নানির ভাগরাদার ছিল তাদের দিয়েই বিক্রি করাতেন। পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটবে এ কারণে কখনো আমাকে বা অন্য ভাইদের বাজারে পাঠাতেন না। তবে আমার ছোটভাইটা ভাল বাজার করতে পারতো বলে সে মাঝে মাঝে বাজার করতো বিকেলে। আমাদের সন্ধ্যার পরে কখনো বাড়ির বাইরে যেতে দিতেন না। আজ আমরা যখন আমাদের সেসব দিনের কথা ভাবি মা অনকটাই আপ্লুত হয়ে পড়েন! গ্রামে আসার পর আমাকে গ্রামের বাড়ির পাশে একটা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। ভর্তি করিয়ে দিলেন আমার ছোট ইলিয়াস বিন কাশেম রাসেলকেও। আমার ছোট বোন ফারহানা তখন খুব ছোট, স্কুলে যাওয়ার মতো বয়স হয়নি। প্রতিদিনই নিজে আমাদের পড়াতেন এবং কড়া শাসনের মধ্যে জীবন চলতে লাগলো। আমি সে বছর গ্রামের ওই প্রাইমারির মধ্যে মাত্র তিন মাস পড়াশোনা করে রেকর্ড সংখ্যক মার্কস পেয়ে স্কুল ফার্স্ট হই। ক্লাস থ্রী থেকে সরাসরি ক্লাস ফাইভে। আমরা তিন ভাই-বোন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়েছি।

আমাদের পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে চারজনই সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। আমার বড়ভাই মুহাম্মদ বিন কাশেম জুয়েল রাজধানীতে ঠিকাদারি করেন করেন। বড় বোন ছামিয়া খাতুন গরুর ফার্ম গড়ে তুলেছন। ছোটভাই ইলিয়াস বিন কাশেম স্কয়ার গ্রুপের মাছরাঙা টেলিভিশনে কাজ করছে। ছোট বোন ফারহানা আফরোজ ঢাকা ব্যাংকে কর্মরত। আজ আমরা যে যেখানেই আছি সব কিছুর কৃতিত্ব আমার মায়েরই। পরপর চারবার আমার মা স্ট্রোক করেছেন বটে, তবে আজো আমাদের সব কিছুরই নির্দেশনা তিনিই দেন। এখনো কিছুতে ঠেকলে তিনিই আমাদের একমাত্র ভরসা। মাই আমাদের পৃথিবী। বিশ্ব নারী দিবসে এমন একজন মহিয়সী মাকে জানাই শ্রদ্ধা, ভালাবাসা ও সালাম।

একজন লেখক বলেছিলেন, আমি বোকা হতে পারি, অনেক খারাপ ছাত্র হতে পারি, দেখতে অনেক কালো হতে পারি, কিন্তু আমার মায়ের কাছে আমিই শ্রেষ্ঠ সন্তান। মা মানে আদর, মা মানে শান্তি, মা মানে ছায়া। কখনও কি একবার ভেবে দেখেছি, একজন মা কতটা অসহায় হতে পারে? অথচ শত শত মা অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন, বাসস্থানের অভাবে রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকেন। এ গুলো তো আমাদের জন্যই হচ্ছে। কত না কষ্টে তারা আমাদের গর্ভে ধারণ করেছেন, বিনিময়ে আমরা তাকে কিছুই দিতে পারিনি। তাই আসুন আমরা সবাই মাকে ভালোবাসি, যেন বৃদ্ধাশ্রম বা রাস্তায় কোনো মায়ের স্থান না হয়। যেন কোনো মা অনাহারে দিন না কাটায়। পৃথিবীর সকল মাকে Mother's Day-এর সহজ শ্রদ্ধা ও ভুবন ভোলানো ভালবাসা জানাই।

লেখক : কবি ও গল্পকার [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নারী দিবস,শ্রদ্ধা,আমার আমি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close