আবুল খায়ের

  ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৯

নারী জাগরণে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

দিনটি ছিল ১৮৮০ সালের ০৯ ডিসেম্বর। এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মহীয়সী নারী। যাকে বলা হয় বাংলাদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত। রংপুর জেলার আওতাধীন মিঠাপুকুর থানার অন্তর্গত পায়রাবন্দ গ্রাম। তাঁর পিতার নাম-জহিরউদ্দীন আবু আলী হায়দার সাবের এবং মাতার নাম-রাহাতুন্নেসা চৌধুরী। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল রোকেয়া খাতুন এবং বৈবাহিক সূত্রে রীতি অনুযায়ী নাম রাখতে হয়েছে-রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তবে তিনি সাহিত্যসেবী মহলে বেগম রোকেয়া হিসেবেই অধিক পরিচিত। রোকেয়ার পিতা বহু ভাষায় পন্ডিত ছিলেন বটে। কিন্তু মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন অনেকটা রক্ষণশীল। ঘরে পাঁচ দেয়ালের মধ্যে রেখেই ‘আরবি’ ও ‘উর্দু’ শেখানো হতো মেয়েদের। তৎকালীন মুসলিম সমাজব্যবস্থার প্রচলিত প্রথাকে ভেঙে বেগম রোকেয়া ও তাঁর বোনদের বাড়ির বাহিরে পাঠানো ছিল একেবারে নিষিদ্ধ। তবে তাঁর বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের ছিলেন আধুনিক মানসিকতার। তিনি বেগম রোকেয়া ও করিমুন্নেসা’কে ঘরেই গোপনে বাংলা ও ইংরেজি শেখার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করেন। তিনি ভাগ্যবতী যে তাঁর বড়ভাই-বোন’দের পর্যাপ্ত সহযোগীতা পেয়েছেন। ফলে বেগম রোকেয়া, বাংলা ও ইংরেজি ভাষা ভালোভাবেই রপ্ত করার সুযোগ কাজে লাগাতে সক্ষম হন। দিনে দিনে জ্ঞানার্জনের প্রতি আরো আগ্রহী হয়ে উঠেন তিনি। ১৮৯৮ সালে ১৮ বছর বয়সে ভাগলপুরের অধিবাসী উর্দুভাষী ও বিপত্নীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন-এর সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শুরু করেন এক নতুন জীবন, নতুন অধ্যায়। স্বামী শিক্ষিত এবং বড় চাকুরিজীবি হওয়ার সুবাধে তিনি এক সম্ভ্রান্ত ও সম্মানীত মহিলা হয়ে ওঠেন খুব দ্রুত। পেশায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বামী মুক্ত মনের মানুষ হিসেবে খ্যাতি ছিল। তাঁর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় বেগম রোকেয়ার জ্ঞানার্জনের পথ অধিকতর সুগম হয়। স্কুল প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিশেষ অর্থ বরাদ্ধ দেন। স্বামীর আর্থিক অনুদান পেয়ে বেগম রোকেয়ার কাজের অনুপ্রেরণা আরো বেড়ে যায়। বিরূপ সমালোচনা ও নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার মুখেও তিনি কখনই নারী শিক্ষার লক্ষ্য থেকে একটুও সরে যাননি। বরং পর্দাপ্রথা ও শিক্ষাবিমুখ মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে ছাত্রী সংগ্রহ করেছেন। রোকেয়া বাংলা গদ্যের বিশিষ্ট শিল্পী। ১৯০২ সালে পিপাসা নামে একটি বাংলা গল্প লিখে সাহিত্যজগতে তাঁর অবদান রাখার প্রয়াস পান। নারীদের জাগ্ররত করার জন্য চালিয়েছেন কলম নিরলসভাবে। সমাজের কুসংস্কার ও জড়তা দূর করার জন্য তিনি অসাধারণ পান্ডিত্যপূর্ণ ও হৃদয়গ্রাহী গদ্য রচনা করেন একের পর এক। তাঁর সব রচনাই সমাজ জীবনের গভীর উপলব্ধি থেকে উৎসারিত। ‘মতিচুর’ ও ‘অবরোধবাসিনী’ তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ গদ্যগ্রন্থ। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ ও ‘পদ্মরাগ’ নামে দুটি উপন্যাসও তিনি রচনা করেন। যা এখনো পাঠকের পছন্দের তালিকায় ও গবেষণার বিষয় বস্তু হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।

১৯০৯ সালে সাখাওয়াত হোসেন মৃত্যুবরণ করেন। ভেঙে পড়েননি বেগম রোকেয়া। যদিও তাঁর স্বাভাবিক জীবনের গতি কিছুটা হলেও চাপের মধ্যে বাঁধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু তিনি থেমে থাকার পাত্র নন। সাহস নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন, অজানা গন্তব্যে। লক্ষ্যে পৌঁছুতে চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। পাঁচ মাসের মাথায় বেগম রোকেয়া ভাগলপুরে প্রতিষ্ঠা করেন একটি গার্লস স্কুল। স্বামীকে ভালোবাসতেন। আর তাইতো স্বামীর নাম চিরস্মরণীয় করার মানসে নাম দিলেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’। স্বামীর নাম যেন ছড়িয়ে পড়ে, সে প্রত্যাশায় তাঁর এই কঠিন ও মহতি কাজটি করার সাহস পেয়েছেন। ১৯১০ সালে আরো একটি প্রচন্ড ধাক্কা খেতে হয় বেগম রোকেয়া’কে। সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলার কারণে স্কুল বন্ধ করতে বাধ্য হন। সিদ্ধান্ত নিলেন কলকাতায় চলে আসার। কিন্তু দমে যান নি তিনি। নিজের প্রতি অবিচল বিশ^াস তাকে তাড়া করে ফেরে। ১৯১১ সালের ১৫ মার্চ আবারও চালু করলেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’। মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি চার বছরের মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৮৪ জনে পৌঁছুতে সক্ষম হন। ১৯৩০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠানটি পুর্ণাঙ্গ উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ নামে প্রতিষ্ঠা করেন একটি নারী সংগঠন। নারী নেত্রী হিসেবে চারিদিকে পরিচিতি বাড়তে থাকে তাঁর। নারীদের সচেতন করার লক্ষ্যে নারী বিষয়ক বক্তব্য রাখার জন্য বিভিন্ন সভা, সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে থাকেন তিনি এবং নিজের আদর্শের জায়গা থেকে নিজেকে উপস্থাপন করার সুযোগ কাজে লাগান। তখনকার সময়ে এটা চিন্তাই করা যেতো না।

শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, ভীরু, দূর্বল নারীদের জাগাতে যিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন নিজের আরাম আয়েস ও সুখ বিসর্জন দিয়ে। মাত্র ৫২ বছর বয়সে এই ক্ষণজন্মা নারী কলকাতা থাকা অবস্থায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ১৯৩২ সালের ০৯ ডিসেম্বর তারিখে। তিনি যেমন একদিকে সমাজ কর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তেমনি লেখিকা হিসেবেও বাংলা সাহিত্যে নিজের অবস্থান তৈরী করে গেছেন। এই মহীয়সী নারী’র জীবনীকে আরো ব্যাপকভাবে প্রচার করা উচিত। বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষীর্থীদের উপযোগী করে পাঠ্যবইয়ে বেগম রোকেয়ার জীবনী পাঠদান করতে হবে।

রংপুর শহর থেকে মাত্র ২৫-৩০ (অটো বা বাসে) মিনিটের পথ। পায়রাবন্দ গ্রাম। আর দশটা গ্রামের মতোই এ গ্রামটিও গাছপালা ও পাখিদের কলকাকলিতে সুমধুর পরিবেশ এখনও প্রকৃতি প্রেমিকদের নজর কাড়বে। গ্রাম হলেও শহরের নিকটে হওয়াতে নগর জীবনের ছোঁয়ায় এখন আর সে আগের মতো গ্রাম নেই। উপশহরে উপনিত। সব সময় পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র’ নামে সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর খ্যাতিমান বাঙালি সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নামে স্থাপিত একটি গণউন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান। এটি একটি মহতি উদ্যোগ। তাঁর নিজের পৈতৃক ভিটায় ৩.১৫ একর ভ‚মির ওপর এই কেন্দ্রটি অবস্থিত। একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান ও অফিস ভবন, সর্বাধুনিক গেস্ট হাউজ, ৪লা বিশিষ্ট ডরমেটরি ভবন, মসজিদ, গবেষণার জন্য আলাদা কক্ষ, অডিটোরিয়াম, লাইব্রেরি ইত্যাদি। প্রায়শই বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন কর্তৃক সভা, সেমিনার, আলোচনা সভা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শিক্ষামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখার মাধ্যমে বেগম রোকেয়ার বাড়িটি এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছে। কবি আড্ডা, মিলন মেলা, বনভোজনের স্পট হিসেবেও ব্যবহার করার সুযোগ আছে।

তবে কিছু সমস্যাও আছে। রংপুর শহর থেকে কাছে হলেও রাস্তাঘাটের উন্নয়ন সেভাবে হয়নি। বিশেষ কোন যানবাহনের ব্যবস্থা নাই। বাড়িটি এখনও ভালোভাবে প্রাচীর দিয়ে সুরক্ষিত করা যায়নি। পর্যাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর অভাব। দূর থেকে আসা দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের জন্য খাবার ও থাকার মানসম্মত এবং পর্যাপ্ত কোন ব্যবস্থা সেভাবে নেই। ব্যক্তিগত উদ্যোগেও হতে পারতো। নিরাপদ আবাসন ব্যবস্থা যেমন দরকার তেমনি আরো সহজ ও পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন সকল শ্রেণির মানুষের জন্য। নিরাপত্তা এবং খাবারের হোটেল ছাড়াও রাস্তাঘাটের উন্নয়ন জরুরি। অসুবিধাগুলো দূর করে প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র’ হতে পারে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ঐতিহাসিক শিক্ষামুলক দর্শনীয় স্থান। নান্দনিক পর্যটন শিল্প বিকাশের অন্যন্য সুযোগ।

‘বেগম রোকেয়ার স্মৃতি কেন্দ্র, আরো ব্যাপকভাবে ব্যবহার উপযোগি, পর্যটকদের জন্য সহজীকরণ ও গবেষণার কাজে ব্যবহার করার জন্য উন্মুক্তকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। দর্শনার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি দেখতে হবে। বখাটেদের আনাগোনা বন্ধ করতে হবে। পুরাতন মসজিদটির সংস্কার করলে মসজিদটি হতে পারে একটি ঐতিহ্যবাহী ও দর্শনীয় স্থাপনা। এব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আর্কষণ করছি। নারীরা তাঁদের নিজের অবস্থান নিজেরা তৈরি করবে নিজেদের বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে। পুরুষের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। নারীদের এগিয়ে নিতে বিশেষভাবে সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। অনুকুল পরিবেশ ও পুরুষ কর্তৃক প্রয়োজনীয় সহযোগিতা নিশ্চিত করতে পারলে, নারীরা এগিয়ে যাবে প্রত্যাশিত লক্ষ্যে। গৃহে, অফিসে, রাজনৈতিক মাঠে নারীর অংশগ্রহণ নারীকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে গৌরবের সাথে।

লেখক: কবি, কলামিস্ট ও ঊন্নয়ন কর্মী

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বেগম রোকেয়া,নারী জাগরণ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close