শিমুল হোসেন শূন্য

  ১২ নভেম্বর, ২০১৯

বঙ্গের প্রখর বাগ্মী-সাহিত্যিক ও কর্মবীর মুন্সী মেহেরুল্লাহ

আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সাধক, বঙ্গের বিখ্যাত সুবক্তা, সমাজ সংস্কারক, বাংলা সাহিত্যের একজন খ্যাতিমান লেখক এবং ইসলাম ধর্ম প্রচারক মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ। তিনি তার সমাজ সংস্কার ও বহুবিধ জনকল্যাণকর কর্মের মাধ্যমে সমাজে কর্মবীর মুন্সী মেহেরুল্লাহ হিসেবে পরিচিতি পান।

মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ ১৮৬১ সালের ২৬ ডিসেম্বর অবিভক্ত যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহুকুমার কালিগঞ্জ থানাধীন ঘোপ গ্রামে নানার বাড়িতে জন্ম নেন। তার পৈতৃক নিবাস যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটির ছাতিয়ানতলায়। তার পিতার নাম মুন্সী মোহাম্মদ ওয়ারেস উদ্দীন। মাত্র সাত বছর বয়সে পিতার অকাল মৃত্যু এবং দারিদ্রতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার তেমন সুযোগ হয়নি তার। তিনি পেশায় সামান্য একজন দর্জি ছিলেন। তবে জ্ঞান অন্বেষণে তার প্রবল ইচ্ছা শক্তি ছিলো। মুন্সী মেহেরুল্লাহ শুধুমাত্র প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর গভীর জ্ঞানতৃষ্ণা মেটানোর অভিপ্রায়ে নিজগৃহ ত্যাগ করেন। এ সময় তিনি মোসহাব উদ্দীন এবং মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন নামে দুজন শিক্ষকের কাছে আরবে- ফারসি ও উর্দু ভাষা শিক্ষালাভ করেন।

ছোটবেলা থেকে তার সাহিত্যের প্রতিও ছিলো এক অসামান্য টান। তাই তিনি আরবি- ফারসি ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চাও করতে থাকেন। তিনি তার কাব্যের মাধ্যমে অসামান্য প্রতিভার নিদর্শন রেখে গেছেন। তিনি তার একটি কবিতায় লিখেছেন- ‘ভাব মন দমে দম রাহা দূর বেলা কম,ভুক বেশী অতি কম খানা, সামনে দেখিতে পাই পানি তোর তরে নাই, কিন্তু'রে পিয়াসা ষোল আনা। দেখিয়া পরের বাড়ী জামা জোড়া ঘোড়া গাড়ি, ঘড়ি ঘড়ি কত সাধ মনে, ভুলেছ কালের তালি, ভুলেছ বাঁশের চালি,ভুলিয়াছ কবর সাসনে।’

তার এই লেখা আজো অম্লান হয়ে আছে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে। আজো তাকে স্মরণ করে গভীর শ্রদ্ধা ভরে। তৎকালীন সময়ে বিশ্ববরেণ্য কবি শেখ সাদীর পান্দেনামা, গুলিস্তা ও বুস্তা গ্রন্থগুলোর উপর জ্ঞানার্জন ও পারদর্শিতাই ছিলো কোন ব্যক্তির জ্ঞান পরিধির মাপকাঠি। সত্যিই বই দুটি তার জীবন বদলে দেয়ার মতই প্রভাব ফেলেছিলো। পরবর্তীকালে মুন্সী মেহেরুল্লাহ শেখ সাদীর পান্দেনামা গ্রন্থটি অনুবাদও করেছিলেন। সেটি ছিলো তৎকালীন সময়ে তার নজিরবিহীন সৃষ্টি।

পলাশীর প্রান্তরে নবাবের ভাগ্য অবনতির পর থেকেই সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষ বিশেষ করে বাংলার মুসলমানরা চরম দুর্দশায় পতিত হয়। ইংরেজদের শোষণ, দমন-পীড়ন এবং খ্রিষ্টান পাদ্রিদের ইসলাম বিদ্বেষী বক্তৃতা বঙ্গের মুসলমানদের বিভ্রান্ত ও অতিষ্ঠ করে তোলে। এমন অবস্থা মহামারি ধারণ করে উনিশ শতকের শেষের দিকেও। মানুষ বিভ্রান্ত ও ঈমানহারা হয়ে অনেকেই খ্রিষ্টানদের প্ররোচনায় খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে। ধারণা করা হয়, পাদ্রিদের এমন অপপ্রচারের ফাঁদে পড়েই যশোরে জন্ম বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি মধুসূদন দত্ত নিজধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান হয়ে নামের পূর্বে মাইকেল নাম ধারণ করেছিলেন।

এ সময় মুন্সী মেহেরুল্লাহর একজন সহযোগী মুন্সী জমির উদ্দীনও ধর্মত্যাগ করে নবী ও ইসলামের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতে থাকলে তিনি দেখলেন এমন অবস্থা চলতে থাকলে বাংলায় ইসলাম ধর্ম টিকিয়ে রাখা অসাধ্য হয়ে উঠবে। তিনি তার তেজদীপ্ত কন্ঠে আওয়াজ তোলেন এবং খ্রিষ্টান পাদ্রিদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে হাতে কলম তুলে নেন। পত্র-পত্রিকার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তিনি কোলকাতা হতে প্রকাশিত `সুধাকর, ইসলাম প্রচারক ও মিহিরসহ বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন।

মুন্সী মেহেরুল্লাহ তার পাশের গ্রাম মনোহরপুরে ইসলামী শিক্ষা প্রসার এবং দিশেহারা মুসলিম সম্প্রদায়কে মুক্ত করতে ‘মাদ্রাসায়ে কারামাতিয়া’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। যেটা বর্তমানে তার স্মৃতি স্মরনে "মুন্সী মেহেরুল্লাহ একাডেমি" নামে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত। এছাড়া তিনি ধর্ম প্রচারের উদ্দ্যেশে ১৮৮৯ সালে ‘ইসলাম ধর্মোত্তেজিকা সভা নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।

তিনি যশোর হতে দার্জিলিং, কোলকাতা হতে আসাম সমগ্র বাংলায় বিভিন্ন স্থানে তার প্রখর বাগ্মীতায় খ্রিষ্টান পাদ্রিদের ঘুম হারাম করে দিলেন। মুসলমানদের প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে অবিহিত করে তাদেরকে ভ্রান্ত ও অপপ্রচারের পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে এবং বক্তৃতায় প্রকাশ্যে পাদ্রিদের সাথে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বিভিন্ন মঞ্চে বিতর্কে তাদেরকে পরাজিত করতে লাগলেন। এক বিতর্ক মঞ্চে মেহেরুল্লাহর সাথে কোনো অবস্থায় পেরে না উঠে তারা উদ্ভট কথাবার্তা ও প্রশ্ন করেন। তারা প্রশ্ন করেছিলো- তোমাদের দেশের মানুষ কেউ লম্বা-খাটো বেটে কেউ ধলা, কালো এমন কেন? আমাদেরতো সবাই সাদা। উত্তরে মেহেরুল্লাহ রাগান্বিত স্বরে বলেছিলেন- শূয়রক্য বাচ্চা এক কিসিম হ্যায়, টাট্টুক্য বাচ্চা হ্যারেক রকম হ্যায়।তার এমন সব অগ্নিঝরা লেখা আর বাগ্মিতায় ইংরেজ পাদ্রিরা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলো।

মুন্সী মেহেরুল্লাহর প্রথম লেখা বই ‘খ্রীষ্ট ধর্মের অসারতা’(১৮৮৭) ও "রদ্দে খ্রীষ্টান" বইদুটি সবচেয়ে বেশি কার্যকর যা ইংরেজ খ্রিষ্টান পাদ্রিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ভূমিকা রেখেছিলো।

মুন্সী মেহেরুল্লাহ ধর্মান্তরিত বেভারেন্ড জন জমির উদ্দীনকেও পুনরায় ইসলামের ছায়াতলে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। এসময় জমির উদ্দীন তার লেখা ‘মেহের চরিত’ প্রবন্ধে মেহেরুল্লাহর ইসলাম প্রচার এবং পাদ্রিদের অপপ্রচার হতে যেভাবে মুসলমানদের আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন তার ভূয়সী প্রশংসা করেন।

মুন্সী মেহেরুল্লাহকে বলা হয় মুসলমানদের রামমোহন। কেননা রাজা রামমোহন রায় উনিশ শতকের প্রথমে হিন্দু সম্প্রদায়কে জাগিয়ে তুলে বিভিন্ন কুসংস্কার দূর করে সমাজ সংস্কারে অবদান রেখেছিলেন। তেমনি উনিশ শতকের শেষের দিকে মুন্সী মেহেরুল্লাহ বিভ্রান্ত দিশেহারা কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলমানদেরকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মুন্সী মেহেরুল্লাহর লিখিত ‘হিন্দুধর্ম রহস্য ও দেবলীলা, বিধবা গঞ্জনা, বিষাদ ভান্ডার, মেহেরুল এসলাম, মুসলমান ও খ্রীষ্ঠান তর্কযুদ্ধ’ বইগুলো সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। তবে তার হিন্দুধর্ম রহস্য ও দেবলীলা এবং বিধবা গঞ্জনা বইদুটি তৎকালিন সরকার কতৃক বাজেয়াপ্ত হয়।

মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ ১৯০৭ সালে ৭ জুন শুক্রবার জুম্মার সময় ৪৭ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। আগামী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় করতে ১৯৯৭ সালে তার ছবি সম্বলিত ডাক টিকিট ও স্মারক খাম চালু করা হয়।

এছাড়া যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত টাউন হল ময়দানকে ‘মেহেরুল্লাহ ময়দান’ এবং তার গ্রামের উপরে স্থাপিত চুড়ামনকাটি রেলওয়ে স্টেশনকে ‘মেহেরুল্লাহ নগর’ নামকরন করা হয়। তার স্মৃতির স্মরণে প্রতি বছর ‘মুন্সী মেহেরুল্লাহ ফাউন্ডেশন’ কতৃক ‘ছাতিয়ানতলা চুড়ামনকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ প্রাঙ্গনে এক মিলন মেলা ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। বঙ্গের এই বাগ্মী কর্মবীরের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তিনি বাঙালির হৃদয়ে চিরদিন অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মুন্সী মেহেরুল্লাহ,সাহিত্যিক,মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close