ইসমাইল মাহমুদ, গণমাধ্যমকর্মী

  ০২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

বাল্যকালের দুটি অনুঘটন

বাল্যকালে বাসায় যতোক্ষণ থাকতাম ততোক্ষণ আমি একবারে ভেজা বেড়াল। আমার সামনে কেউ কিছু বললে বা কেউ কিছু নিয়ে আলোচনা করলেও আমি এমন ভাব ধরে চলতাম মনে হতো কিছুই বুঝতে পারছি না। ভাব ছিলো এমন ‘যেন ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানি না।’ বাবা প্রায়ই বলতেন ‘পরিবারের বড় ছেলেরা বোকা হয়! আমার বড় ছেলেটাও বোকার হদ্য। এ ছেলেকে নিয়ে বড়ই দুশ্চিন্তা হয়। আমার অবর্তমানে ছেলেটি কি করে সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলবে?’ কিন্তু মা জানতেন আমি কতোটা দুরন্ত-দুর্বার ছিলাম। বাবার এসব চিন্তার কথা শুনে মা শাড়ির আচলে বা জামার ওড়নায় মুখ লুকিয়ে মিটি মিটি হাসতেন। কোনদিনই আমার ধীরে ধীরে দুষ্টের শিরোমনি হয়ে ওঠার কথা বাবাকে বলেননি মা। হয়তো মা হাসতেন আর নিজের মনেই বলতেন ‘আমি তো জানি তোমার বড় ছেলে কতো সুবোধ বালক?’

আমার বাল্যকালের অসংখ্য দুরন্ত ঘটনার মধ্যে দুটি ঘটনা আপনাদের জানাতে চাই। তবে শর্ত হলো আমার বাল্যকালের এসব ঘটনা তোমরা কখনোই অনুকরণ বা অনুসরণ করবেন না, শিশুদেও অনুকরণ বা অনুসরণ করতে দেবেন না। কারণ সমাজ ও রাষ্ট্র শিশুদের কাছ থেকে অনেক ভালো কিছু প্রত্যাশা করে। কারণ আজকের শিশুরাই এদেশের আগামীর কর্ণধার।

লোভীকে মেসোমশাইকে বোকা বানানো : তখন আমার বয়স এগারোর একটু বেশি। ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। সে সময়ে আমাদের বাসার পাশে জমি কিনে নতুন বাসা তৈরি করে সনাতন (হিন্দু) ধর্মাবলম্বী এক পরিবার। ওই সনাতন পরিবারের যিনি কর্তা তাঁকে আমরা ভাই-বোনেরা মেসোমশাই বলে ডাকতাম। পাশাপাশি বাসার বাসিন্দা হওয়ায় আমাদের দু’পরিবারের মাঝে অল্পদিনেই সখ্যতা গড়ে ওঠে। ওই পরিবারের লোকজন প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতেন। আমরাও যেতাম যথানিয়মে। তবে আমরা কেউ তাদের বাসায় গেলে ফেরার পথে বা ফেরার পরে খেয়াল করে দেখতাম তারা তাদের রান্নাঘরের থালা-বাটি বাইরে ফেলে ঘষামাজা করছে। মাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘হিন্দু পরিবারের রান্নাঘরে যেতে নেই। ভুলে কেউ বা না বুঝে মুসলিম কেউ তাদের রান্নাঘরে গেলে সবকিছু বাইরে এনে ঘষামাজা করে পরিস্কার পূর্বক তবেই তারা পবিত্র হন।’ মায়ের মুখে এ কথা শুনে আমার মাথায় খেলে গেল দুষ্টবুদ্ধি। তাদের শায়েস্তা করতে হুটহাট ডুকে যেতাম তাদের রান্নাঘরে। কোন কোন দিন তিন/চারবারও করেছি এ কর্ম। তারাও আমাকে কিছুই বলতে পারে না। চরম বিরক্তি সহকারে আমার অত্যাচার সহ্য করে চলেছে। এভাবে প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেছে। একদিন তাদের বাসায় গিয়ে দেখি রান্নাঘরের বাইরের যে দরজা ছিল তা ইট দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। সেই সাথে পরিবারের বড় মেয়ের কক্ষের ভেতর দিয়ে রান্নাঘরের দরজা করা হচ্ছে। পরে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে ওই পরিবারের সবগুলো কক্ষতে আমার বা আমাদের অবাধ যাতায়াত থাকলেও বড় মেয়ের কক্ষে যাওয়ার এক ধরণের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এখানেই আমার দুষ্টামি কিছুটা থেমে গেলেও মনে মনে ফন্দি আটতে থাকি কিভাবে তাদের শায়েস্তা করা যায়। এলাকার সবাই ইতোমধ্যে জেনে গেছেন ওই পরিবারের যিনি কর্তাব্যক্তি অর্থাৎ আমাদের মেশোমশাই চরম লোভী একটা মানুষ। রাস্তায় কোন কিছু পড়ে থাকলেও তা বাসায় আনা চাই তাঁর। আমাদের বাসায় আসলেও চারদিকে নজর রাখতেন কোন দ্রব্যটি আমাদের কাজে লাগে না বা পড়ে রয়েছে। মায়ের কাছে ওই দ্রব্যটি চেয়ে বসতেন। মাও হাসিমুখে তা দিয়ে দিতেন মেসোমশাইকে। একদিন আমাদের বাসার দক্ষিণ দিকের চিন্তা হরণ দাশ (চিন্তা মাস্টার নামে পরিচিত ছিলেন)-এর দোকানের সামনে রাস্তার উপর গরুর গোবর ও কয়েকটি গরুর হাড় সংগ্রহপূর্বক একটি পুটলা বা প্যাকেট তৈরি করে রেখে আমি ও আমার এক ভাই আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলাম। পুটলাটি বাধা ছিল হলুদ পাতার মতো (স্থানীয় ভাষায় পাতাটিকে পুইথ পাতা বলে) এক ধরণের পাতা দিয়ে। সে সময়কালে বাজারের সব জিনিস বা দ্রব্যাদি এ ধরণের পাতায় বেধে বিক্রি হতো। প্যাকেট বা পলিথিন ছিল না সে সময়ে। তো আমরা আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছি পুটলাটি কেউ নিয়ে যায় কিনা। বেশ কয়েকজন মানুষ এ রাস্তা ধরে গেলেও কেউই পুটলাটি ছুয়েও দেখলো না। হঠাৎ দেখলাম আমাদের সেই মেসোমশাই আসছেন। তাঁকে দেখেই উত্তেজনায় রীতিমতো কাঁপছি। পুটলাটির কাছে এসেই মেসোমশাই একটু দাঁড়ালেন। সামনে-পেছনে, ডানে-বায়ে একটু তাকিয়ে নিলেন। আশপাশে কেউ নেই নিশ্চিত হয়ে আস্তে করে ওই পুটলাটি হাতে তুলে নিলেন। তারপর দ্রুত নিজের বাসায়...। তারপরের ঘটনা জানা সম্ভব হয়নি। কারণ বেশ কয়েকদিন আমি আর তাদের বাসামুখী হইনি।

বালু চরে ফাঁদ : আমাদের পাড়ায় এক মহিলা ছিলেন চরম তেজস্বী। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুধ বিক্রি করতেন। দুধ বিক্রি করার করণে তাঁর প্রকৃত নামই এক সময় হারিয়ে গেল ‘দুধওয়ালী’ নামের আড়ালে। ওই ‘দুধওয়ালি’র সার্বিক আচার-আচরণে এলাকার মানুষ ছিলেন অতিষ্ট। কোনদিন কারো সাথে ঝগড়া না করলে ওইদিন যেন তাঁর রাতের ঘুমই হারাম হয়ে যেত। প্রতিদিনই কোন না বিষয় নিয়ে ঝগড়া বাঁধানো তাঁর চাই-ই। ফলে এক সময় এলাকার মানুষ তাঁকে এড়িয়ে চলা শুরু করে। তাঁর দুধ বিক্রিও ক্রমশ কমতে থাকে ঝগড়াটে স্বভাবের কারণে। ওই সময়ে খুব বেশি গালি প্রচলিত ছিল না। তবে যেসব গালিগালাজ প্রচলিত ছিল সবগুলো ছিল তাঁর ঠোঁটস্থ। কথায় কথায় তিনি গালিগালাজ করতেন মানুষকে। আমার বয়স তখন আমার বয়স আট কি নয় বছর। একদিন সারাদিন স্কুলের ক্লান্তিময় শিক্ষাগ্রহণ শেষে বাসায় ফেরার পর আমার গালে মায়ের সজোরে থাপ্পর। আমিতো চরম অবাক। মায়ের হাতে জীবনের প্রথম থাপ্পরের চেয়ে বেশি অবাক হয়েছি অপরাধ জানার আগেই শাস্তি ভোগ করলাম। মাকে জিজ্ঞেস করলাম ঘটনার বৃত্তান্ত। যা শুনলাম তা হলো আমি নাকি একটু আগে ওই দুধওয়ালিকে লক্ষ্য করে ঢিল মেরেছি। যা তার হাতে লেগেছে। আমি দুরন্ত-দুর্বার হলেও ওইদিন এ ধরণের কোন ঘটনার সাথে আমার বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ততা ছিল না। তাই বড়গলায় চ্যালেঞ্জ করলাম। আমার চ্যালেঞ্জে মা ওই দুধওয়ালিকে ঢেকে পাঠালেন। তিনি বাসায় আসার পর আমার মুখোমুখি তাঁকে দাঁড় করানো হলো। আমার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি আমার মাকে বললেন ‘আপনার এই ছেলে তো আমাকে ঢিল মারেনি। মেরেছে আপনার বড় ছেলে।’ প্রকৃতপক্ষে আমিই পরিবারের বড় সন্তান। আমার কোন বড় ভাই নেই। অন্য কোন ছেলে তাঁকে ঢিল মারায় তিনি আমার উপর দোষ চাপিয়ে মায়ের হাতের থাপ্পর খাওয়ালেন। হয়তো তিনি চিনতেই পারেননি কে ঢিল মেরেছে। যাক তাঁর মুখে একথা শুনা মাত্র আমার মায়ের সে কি কান্না। অযথা থাপ্পর দেয়ায় আমাকে জড়িয়ে ধরে মা কাঁদছেন আর দুধওয়ালিকে অপমান করে যাচ্ছেন। এ ঘটনার পর থেকে ঘটনাটির প্রতিশোধ কিভাবে নেয়া যায় আমি তার ছঁক কষতে থাকি। ওই দুধওয়ালি প্রতিদিন দুপুরের দিকে বাসার পাশের ছোট ছড়া ও বালুচর পেরিয়ে বিডিআর ক্যাম্প থেকে খাবার পানি আনতে যেতেন মাটির কলস নিয়ে। একদিন ওই রাস্তায়ই অপারেশনের প্রস্তুতি নিলাম। প্রতিশোধ নেবার দিন দুধওয়ালির বাসার সামনে এসে অপেক্ষা করছি। তিনি পানি আনতে বাসা থেকে মাটির কলস নিয়ে বের হবার পর আমি চুপি চুপি তাঁর পিছু নিলাম। তিনি ছড়ার হাটু সমান পানি ও বালুচর পেরিয়ে গেলেন বিডিআর ক্যাম্পে। এই ফাঁকে আমি ও আমার চাচাতো ভাই বালুচরে দুইপাশে দুটি গর্ত করলাম। দুটি গর্তই আমরা বাঁশের চটি ও পাতা দিয়ে পুনরায় বালু দিয়ে ঢেকে দিলাম। দেখে মনে হয় বালুচর স্বভাবিকই আছে। গোপনে যে আমরা ফাঁদ তৈরি করে রেখেছি তা কারো বুঝার কথা নয়। এরপর মজা দেখার জন্য আমরা ছড়ার উল্টোপাশে বাঁশ বাগানে লুকিয়ে রইলাম। যথারিতী মাটির কলসভর্তি পানি নিয়ে দুধওয়ালি যেই বালুচরে পা দিলেন সাথে সাথেই ঢেকে রাখা গর্তে পড়ে গেল তাঁর পা। হাত থেকে পড়ে কলস ভেঙ্গে টুকরো টুকরো। বেশ আঘাতই পেলেন তিনি। প্রতিশোধ নিতে পেরে আমি তখন মহাখুশি। তখন মনে হয়েছে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ। এ ঘটনার পর কেটে গেছে প্রায় চার দশক। এখনো ঘটনাটি নিয়ে ভুগছি অনুশোচনায়। মনে মনে খুঁজে ফিরি সেই দুধওয়ালিকে। হয়তো তিনি এখন আর বেঁচে নেই। তাঁর কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ থেকেও আমি বঞ্চিত।

আলোচ্য এ নিবন্ধে যে দুটি ঘটনার অবতারণা করলাম দুটি ঘটনাই বাল্যকালের দুষ্টামির উদাহরণ। যা মোটেও সমিচীন হয়নি। বাল্যকালে আমরা আবেগের বসে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি, যা অন্যের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একটু যখন বড় হয়েছি তখন বুঝতে পেরেছি কি ভুলটাই না করেছি সে সময়ে। মানুষের সেবাই হোক সকলের একমাত্র ব্রত সে কামনা করছি।

পিডিএসও/রি.মা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আমার আমি,বাল্যকাল
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close