ইকবাল হোসেন রুবেল, সংবাদকর্মী

  ১০ আগস্ট, ২০১৯

সীতাকুণ্ডে আনন্দ ভ্রমণ

সীতাকুণ্ড ইকোপার্কে পাশাপাশি সুপ্তধারা ও সহস্রধারা ঝর্না

সীতাকুণ্ড উপজেলায় দেখার মতো অনেক দর্শনীয় জায়গা আছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থান হচ্ছে—সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেন, চন্দ্রনাথ মন্দির, মুরাদপূর ইউনিয়নে গুলীয়াখালী সি বীচ, বাড়বকুণ্ডের অগ্নীকূণ্ড, বাঁশবাড়ীয়া সি বীচ ও কুমিরা ব্রীজ।

সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেন

ভ্রমণ পিয়াসি ও দর্শনাথীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেন সেজেছে নতুন সাজে রূপে। পাহাড় ও সমুদ্র বরাবরই ভ্রমণ পিয়াসিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। ইকু পার্কের প্রাকৃতিক নিবিড় ছোঁয়া আর বুক উজাড় করা সৌন্দর্য মুহূর্তেই ভুলিয়ে দেয় জীবনের যাবতীয় হতাশা। পাহাড়ী প্রকৃতির একান্ত সান্নিধ্য পেতে আর উচ্ছল ঝর্নার শীতল স্পর্শ পেতে হলে সীতাকুণ্ড ইকোপার্কেই হলো একমাত্র প্রাকৃতিক স্থান।

সীতাকুণ্ড পৌরসদর থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে ফকিরহাট এলাকায় অতিক্রম করলে মহাসড়কের পূর্ব পাশে হাতের বামে সীতাকুণ্ড বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের প্রধান সড়ক। সে সড়ক দিয়ে পূর্ব দিকে এক কিলোমিটার পথ অতিক্রম করলে পার্কের প্রধান ফটক। ফটকের পাশে টিকিট কাউন্টার রয়েছে। জনপ্রতি ২০টাকা টিকিট কিনতে হবে। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য টিকিটের মূল্যে ছাড় রয়েছে। টিকিট সংগ্রহ করে ইকোপার্কে ঢুকে হাতের বামে পর্যটন অফিস থেকে ধরনা নিতে পারেন। অফিসের সামনে নির্মিত ফলকে উৎকীর্ণ আছে ইকোপার্কেও বড় মানচিত্র। এর থেকে দর্শনীয় স্থানগুলো চিহ্নিত করে নিতে পারেন। বিস্তারিত জানতে বোটানিক্যাল কার্যালয়ে স্থাপিত মিনি লাইব্রেরি থেকে একটু পড়াশুনা করেও ধারণা নিতে পারেন। যাত্রা শুরু করার পূর্বে কার্যালয়ের পাশে অর্কিড গার্ডেন ও অপরূপ গোলাপ বাগানে চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন।

ইকোপার্কের মূল ফটক দিয়ে ঢুকতে হাতের ডানে রয়েছে শাপলা ফুলে ঢাকা পদ্ম পুকুর ও কবি কাজী নজরুল ইসলামের দৃষ্টি নান্দনিক আকর্ষণীয় ম্যুরাল। শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় পার্ক এতে রয়েছে বিভিন্ন রাইড।

এবার যাত্রা শুরু করতে পারেন। ইচ্ছে করলে ব্যক্তিগত গাড়ি থাকলে বা ভাড়ায় নিয়ে আসা গাড়ি নিয়েও কিংবা আপনি পায়ে হেঁটে গাছগাছালিতে ঢাকা সুশীতল ছায়ায় পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে যাত্রা শুরু করতে পারেন। কিছু পথ অতিক্রম করলেই রয়েছে সুপ্তধারা জলপ্রপাত। সুপ্তধারা ঝর্নার স্নিগ্ধতা পেতে হলে ডান পাশের সিঁড়ি বেঁয়ে নেমতে হবে পাহাড়ের তলদেশে। নিচের দিকে কিছু সিঁড়ি অতিক্রম করলেই দেখতে পাবেন একটি টিনের ছাউনি। সেখানে একটু বিশ্রাম নিতে পারেন। সেখান থেকে সতর্কতার সাথে পাহাড়ি ঢাল বেঁয়ে নিচে নামতে হবে। এখটু খেয়ালি করলে গড়িয়ে পাহাড়ের তলদেশে পড়ার সম্ভবনা রয়েছে। তবে আনন্দ উপভোগ করতে হলে নিচে না নেমে উপায় নেই। পাহাড়ি ছড়ার পাথুরে পথ ধরে পানির শীতলতা নিতে নিতে পৌঁছানো যায় সুপ্তধারা জলপ্রপাত (ঝর্না)র একেবারে নিচে। একটু কষ্ট উপভোগ করে নিচে নামলে শত ফুট ওপর থেকে অভিরাম গড়িয়ে পড়া ঝর্নার পানিতে একটু ভেজা বা উষ্ণতার আনন্দ আলাদা। এখান থেকে ঝর্নাতে ভিজার আনন্দ উপভোগ করে আবারো যে পথে ঝর্নাতে নেমেছেন সেই পথ ধরে বেয়ে উঠতে হবে উপরে। আবার গাছগাছালিতে ঢাকা সুশীতল ছায়ায় পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে পাখিদের কিছিরমিছির মধুর শুর শুনেশুনে যাত্রা শুরু করুন। যুগ যুগান্তরে ব্যথা হয়ে অশ্রু হয়ে সহস্রধারা এ লেখা সম্বলিত আরেকটি সাইন বোর্ড নিয়ে ইকো পার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেনের শেষ সীমানায় রয়েছে সহস্রধারা জলপ্রপাত নামে আরেকটি ঝর্না। ১০২০ (এক হাজার বিশ) ফুট নিচে ৪৮৩টি (চারশত তিরাশি) সিঁড়ি বেয়ে এবং কিছু পাহাড়ি পথ সাবধানতা অবলম্ভন করে অতিক্রম করে চলে যাওয়া যায় ঝর্ণার পাদদেশে। এই ঝর্নার কাছে এসে পনির স্নিগ্ধ পরশ পাওয়ার লোভ সামলানো খুব কঠিন।

যা পারেনি আমাদের জাতীয কবি কাজী নজরুল ইসলামও। তাইতো তিনি এই ঝর্নার পরশ নিতে ১৯২৯ সালের জানুয়ারি মাসে ছুটে এসে এইখানে রচনা করেছেন তাঁর বিখ্যাত গান ‘আকাশে হেলাল দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ। ঐ পাহাড়ের ঝর্নায় আমি উধাও হয়ে রইগো’। পাহাড়ের গায়ে প্রস্তর ফলকে উৎকীর্ণ আছে সেই পংক্তিগুলো।

সহস্রধারা ঝর্না দেখে উপর উঠে খানেকটা বিশ্রাম নিতে পারেন। বিশ্রামের ফাঁকে কিছু খেয়ে নিতে পারেন। সাথে করে নিয়ে আসা খাবার বা দোকন থেকে কিনে নিতে পারেন। দাম কিছুটা বেশি নেবে। কারণ পণ্যগুলো নিচ থেকে বয়ে আনতে হয় যে! এবার নামতে হবে কারন এখানে ইকো পার্কের শেষ সিমানা। পার্কের উওর পাশে চন্দ্রনাথ মন্দির।উপওে বিমান বাহিনীর টাওয়ার থাকলেও নিরাপওার অভাবে দর্শনার্থীদের উঠা নিষেধ রয়েছে। এখানে পাশের উঁচু টিলায় উঠে তাকালে দেখাযাবে পশ্চিমের ডুবন্ত সূর্য ও সন্ধীপ চ্যানেল। চ্যানেলের বুকে সারি সারি জেলেদের মাছ ধরার বোট ও নৌকা দক্ষীনে সারি সারি জাহাজ। এযেন অন্য হৃদয় ভূলানো দৃশ্য! ছবির মত দেখতে অদুরবর্তী সমুদ্রের রূপ না দেখলে বুঝা যায় না।

ইকো পার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেনটি ১৯৯৬ একর জায়গার মধ্যে দুই ভাগে বিভক্ত করে তৈরি করা হয়েছে। ১০০০ একর জায়গায় বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ৯৯৬ একর জায়গা জুড়ে ইকো পার্কের এলাকা।

বোটানেক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের উওর, দক্ষিণ ও পূর্বে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। এ যেন বয়ে চলছে পহাড়ি টিলার অন্য রকম স্রোত। দূরে তাকালে যেন হৃদয় পাহাড়ি স্রোতে হৃদয় হারিয়ে যায়।

বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের পূর্বে হাটহাজারী ও ফটিকছড়ি উপজেলা। এ যেন পাহাড়ের স্রোত যেখানে লুকিয়ে আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

আবার ফিরে দেখা যাক ইকোপার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে। পাহাড়ের চুঁড়ায় কয়েকটি পিকনিক কর্ণার, বিশ্রামাগার, টয়লেট ও আনন্দ ভ্রমণে এসে রান্না ও ব্যবহারের জন্য বিশুদ্ধ পানিও ব্যবস্থা রয়েছে। ইকোপার্কে রয়েছে মেছোবাঘ, মায়াহরিন, বানর, ভাল্লুক, সাজারু, হসুমাণ, বনরুই, শুকর, বনমুরগী, শিয়াল প্রভৃতি পশু। অজগর, গোখরা, দাড়াঁশ, কালন্তি, লাউডগা সহ অনেক রকমের সাপ থাকলে ও শীতকালে একে বারেও দেখা মিলেনা বল্লেও চলে। কারন সাপ শীতকালে বের হয় কম। ১৬ প্রজাতির দূর্লভ গোলাপ সহ কাঠ মালতি, নাইট কুইন, বাগান বিলাস, জবা, লিলি, মোসান্ড, টগর, বেলী, রংগন, স্থল পদ্ম, রাধা চুঁড়া, ফকিনি, এলামেন্ড, কামেনি, হাসনা হেনা, গন্ধরাজ, শিউলী, বেলী মিলে রয়েছে ১৫০ জাতের ফুল।

শাল, সেগুন , গর্জন, চাম্পা, মেহগনি, আম, জাম,কাঁঠাল, আমলকি, হরিতকি এছাড়া পাহাড়ের মাঝে সৃজিত হয়েছে ফুল ও ফল গাছের বাগান যাতে পশুপাখি তাদের খাদ্য ও আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহার করছে। বিভিন্ন রকমের কাঠ, ফল ও ঔষুধি বৃক্ষ আর লতা গুল্ম মিলে আছে ১৪৫ প্রজাতির গাছগাছালি। বিরল প্রজাতির সাইকাস পার্কটিকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। আছে অত্যধুনিক গ্রীন হাউজ। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির দৃষ্টিনন্দন ১০০টি অর্কিট আছে।

সহস্রধারা ও সুপ্তধারা হতে বহমান জলকে কৃত্রিম বাঁধ তৈরির মাধ্যমে গড়ে উঠবে লেক, সেই লেকের পানিতে বোটে করে ঘুরে বেড়াবে পর্যটকরা। নৌবিহারের সময় পাখির কাঁকলী শুনতে শুনতে লেকের দুধারের গাছ গাছালিতে লাফালাফিতে দেখা যাবে বানর, হনুমান। কোথাও দেখা মিলতে পারে মায়া হরিণ লেকের পাড়ে নেমে এসে পানি পান করার দৃশ্য।

তবে পার্কটি ভ্রমণ পিয়াসিদের দৃষ্টি নন্দনীয় করলেও নিরাপত্তার বিষয়ে অনেক প্রশ্ন উঠে আসে। এ বিশাল ইকো পার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেনটিতে ১৭জন কর্মী এবং বন বিভাগের ২৪জন কর্মী থাকলে ও বিভিন্ন সময়ে অপরাধীরা অপরাধের জন্য এটিকে নিরাপদস্থল মনে করে।

কিভাবে যাবেন

চট্টগ্রাম অলংকার মোড় বা একে খাঁন থেকে সীতাকুণ্ডের লোকাল মিনিবাস রয়েছে সেই মিনি বাস যোগে বা বাসে করেও আসতে পারেন। লোকাল বাস ভাড়া নেবে ৩০ টাকা। তবে একটু আরামে আসতে চাইলে রিজার্ভ বাসও পাওয়া যাবে। ভাড়া জনপ্রতি ৮০ টাকা করে। তবে সে ক্ষেত্রে কন্ডাক্টরকে বলে রাখতে হবে ইকো পার্কের গেটে নামিয়ে দিতে হবে। না হলে আপনাকে সীতাকুণ্ড বাজার এলাকায় নিয়ে যাবে, অন্য এলাকায়ও নিয়ে যেতে পারে। বলে রাখলে আপনাকে পার্কের গেটে নামিয়ে দেবে।

পিডিএসও/প্রতিনিধি/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আনন্দ ভ্রমণ,সীতাকুণ্ড,সহস্রধারা ও সুপ্তধারা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close