এহসান বিন মুজাহির

  ০১ জুলাই, ২০১৯

বিয়ের দাওয়াত যেন গরিবের জন্য মহাবিপদ!

পাশের বাসার ভাড়াটিয়া পরিবারটি নেহায়েত গরীব। গত ২২ জুন বাসার মালিকের মেয়ের বিয়ে ছিলো। বিয়েতে আমারও দাওয়াত ছিলো। আমি বিয়েতে যাচ্ছি ওই বাসার পাশ দিয়ে। তখন শুনতে পাই পরিবাবের প্রধান কর্তা তার ছেলেকে বলছেন-‘আজ বিউটির (ছদ্মনাম) গায়ে হলুদ। ছেলে বলছে- তো আপনি যান সমস্যা কি? প্রতিউত্তরে মা বলছেন নাহ; যামু না। বিয়েতে গেলেই পাঁচশ টাকা দিতে হবে। আমার নিজেরই টানাটানির সংসার। পাঁচশ টাকা আমাদের জন্য অনেক। বাড়িওয়ালার মেয়ের বিয়েতে এর চেয়ে কম টাকা দেয়া কেমন দেখায় না? বাড়িওয়ালারাই বা কি বলবে!

ঘটনাটা উপস্থাপনা করলাম এই কারণে যে, দেখা যাচ্ছে ইদানিং আত্মীয়তার সম্পর্কটি যেন টাকার কাছে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এই যেমন-পাঁচশ টাকা দিলে সেই মহিলার সংসারে আর্থিক অসুবিধা হবে— এ আশঙ্কায় দাওয়াতি মেহমান হওয়ার পরও তিনি যাননি। যদি এমন হতো যে বিয়েতে গিফট দেয়ার কোনো চিন্তা না থাকতো তাহলে হয়তো কোনো চিন্তা না করে সম্পর্কের টানে বিয়ের আনন্দে শামিল হতেন।

যদিও আমরা জানি, মানুষ মানুষকে গিফট দেয় খুশি মনে, এটা জোর করে চেয়ে নেওয়ার বিষয় না। বর্তমানে বিয়েতে গিফট দেয়া বাধ্যতামূলক একটি প্রথায় পরিণত হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়-কেউ বিয়েতে কমমূল্যের গিফট দিলে তার বদনাম করা হয়, তাকে ছোটলোক ভাবা হয় আর কি! এদিকে বড়লোকের বিয়েতে আজকাল নগদ হিসাবে এক হাজার টাকার নিচে গিফট দেয়া যায় না। ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবী হলে তো টাকার পরিমাণ আরো বাড়াতে হয়। বিয়ের দাওয়াত যেন গরিবের জন্য মহা একটি বিপদ!

বিয়ের দাওয়াত একটা আনন্দের খবর। কিন্তু দাওয়াত পেয়ে এখন মানুষ খুশি হওয়ার চেয়ে গিফটের কথা চিন্তা করে হিসাব কষতে থাকে। অন্যদিকে যারা দাওয়াত দিয়েছেন তারাও অনুষ্ঠানে গিফট টেবিলের ব্যবস্থা করে থাকেন। কে কত টাকা দিলেন তা খাতায় লিখে রাখেন। এই কাজের জন্য আপন বিশ্বস্ত কাউকে টেবিলের কাজে বসানো হয়। আবার এমনও কিছু পরিবারের কর্তা আছেন যারা এই গিফটের হিসাব লিপিবদ্ধ করা খাতাটি সযত্নে সংগ্রহ করে রাখেন। কেউ দাওয়াত দিলে তার সেই পুরোনো খাতা বের করে দেখেন, ওই ব্যক্তি তার দাওয়াতে কত দিয়েছিল। সেটা দেখে তাকে গিফট দেয়া হয়। কি অদ্ভূত কাণ্ড! এ কেমন সৌজন্যতা? এ কেমন সম্পর্ক!

এদিকে উপহারের কবলে পড়ে দেখা যায় অনেক গরিব মেহমানরা বিয়েতে অংশ নিতে পারেন না, বা তাদের আর্থিক অবস্থা সবার সামনে প্রকাশ পাবে এমনটি ভেবে কষ্ট করে হলেও গিফট জোগাড় করে তারপর বিয়েতে অংশ নেন। মনে মনে তারা দুঃখ করে বলেন-‘সমাজে সম্মান নিয়ে বাঁচতে হলে এমনটি করতেই হয়’।

আসলে আমরা সামাজিক রীতিনীতিকে এতটাই কঠিন করে ফেলেছি যে, তা কখনো দেখা যাচ্ছে মানুষকে বাধ্য করছে, কখনো বা একটা ভুল বার্তা সমাজে ছড়াচ্ছে। তাই কিছু মানুষ মন থেকে সেগুলো মেনে না নিলেও ‘সমাজে থাকতে হলে এসব করে থাকতে হবে’ এমন একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। এমন মন-মানসিকতা ও চিন্তাকে বদলাতে হবে। নিজেদেরই এ রীতিটি পাল্টাতে হবে।

বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ মিশকাত শরিফে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে সেই অনুষ্ঠানটিই নিকৃষ্ট যাতে ধনীদের দাওয়াত দেয়া হয় আর গরিবদের উপেক্ষা করা হয়। আমি উপহার দেয়া কিংবা নেয়ার বিপক্ষে না, তবে প্রচলিত উপহারের সিস্টেমের বিরোধিতা করছি। হাদিসের বিশুদ্ধ গ্রন্থ তিরমিজি শরিফে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন-‘তোমরা পরষ্পরের মধ্যে উপহার আদান-প্রদান করো এতে তোমাদের সম্পর্ক গভীর হবে। বর্তমান সমাজে বিয়েতে উপহার সামগ্রী প্রদান প্রথা দেখে মনে হচ্ছে মেহমানরা বাধ্য হয়েই গিফট নিয়ে আসছেন। এ যেন উপহারের বিনিময়ে খাদ্য! তাই এ যুগে বিয়ে-শাদীতে এই উপহারের সিস্টেমটা পরিবর্তন করা দরকার।

আত্মীয়দের মধ্যে কে বড়লোক, কে গরিব এসব বাছ-বিচার না করে এবং কারো কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা না করে সন্তুষ্টচিত্তে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী দাওয়াত খাওয়াতে হবে। কাজেই বিয়ে-শাদীসহ সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উপহারের প্রচলিত প্রথা পরিহার করা জরুরি।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বিয়ে,বিয়ের উপহার,প্রচলিত প্রথা,উপহার,গিফট
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close