নাফিউর রহমান ইমন, জাবি শিক্ষার্থী

  ১০ জানুয়ারি, ২০১৯

শীতের শুরুতেই কুয়াকাটা ভ্রমণ

সকালে ঘুম ভাঙলো কিছুটা বিরক্ত নিয়ে। সাড়ে আটটায় ক্লাস। কিছু বুঝে উঠার আগেই তৈরি হয়ে নিলাম। সকালের নাস্তা শেষবারের মত কবে করেছি মনে পড়ছে না। আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে ক্লাসের উদ্দেশে রওনা দিলাম আমি, সুমন,শাহাদাৎ আর শাহিন। পেছন থেকে শুভো আর মহান ডেকে উঠল। ফিরে তাকাতেই শুভো বললো, আজ কিন্তু ৬ নভেম্বর (বুধবার),প্লানটা কি সবার মনে আছে?

গত কয়েক দিন ধরেই ট্যুরের ব্যাপারে কথা হচ্ছিল সবার সাথে।সবার মতামত নিয়ে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নভেম্বরের ৬ তারিখে। আজ ক্লাসের ভীষণ চাপ। সকাল সাড়ে আটটা, সাড়ে দশটা, সাড়ে এগারোটা এবং সবশেষে আড়াইটায় ক্লাস। ম্যাম ক্লাস নিলো বিকেল চারটা পর্যন্ত। সময়ের দিকে বারবার তাকাচ্ছিলাম। পাঁচটায় ক্যাম্পাসের বাস ছেড়ে যাবে ঢাকার উদ্দেশে। তড়িঘড়ি করে হলে এসে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম।

শুরু হলো কাঙ্ক্ষিত যাত্রা। গুলিস্তান গিয়ে কিছু কেনাকাটা করে সদরঘাট পৌঁছাতে প্রায় রাত আটটা ছাপ্পান্ন বেঁজে গেল। রাত ন’টার দিকে শেষ লঞ্চটি ছেড়ে যায় বরিশালের উদ্দেশে। টিকেট কেঁটে লঞ্চে উঠলাম। সুন্দরবন-১১। পাঁচ তলা বিশিষ্ট বিশালাকার এ লঞ্চে আছে লিফটের সুবিধা।

আমরা গেলাম সবার ওপরের তলায়। যেখান থেকে আকাশ,বাতাস, নদী ও শহরের লাল,নীল,সবুজ,হলুদ আলো দেখা যায়। মুক্ত বিহঙ্গের মত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, যেন উড়ছি নিকষ কালো অন্ধকারে তাঁরাদের মাঝে। মাঝে একফালি চাঁদের আলোয় পদ্মার ঢেউগুলো চিকচিক করছে। লোকালয় দেখা যায় না। দূরে কয়েকটা লঞ্চ, ও মাঝারি সাইজের নৌকা ভেসে থাকতে দেখলাম। লঞ্চ ছুটে চলছে বরিশালের উদ্দেশে। ভোর চারটার দিকে লঞ্চ বরিশালে পৌঁছলো।

সেখান থেকে যেতে হবে রুপাতলি।প্রতিজন বিশ টাকা ভাড়ায় লেগুনায় করে গেলাম রুপাতলি বাসস্ট্যান্ড। গাড়িতে কুয়াকাটার ভাড়া জনপ্রতি দুশো চল্লিশ টাকা করে। গাড়ি চলছে কুয়াকাটার উদ্দেশে। সমুদ্র সৈকতে গিয়ে পৌঁছাতে প্রায় দশটাটা বেজে গেল। দূর থেকেই সাগরের গর্জন শুনতে পেলাম। আহা! এ যে সুখ, এ যে মায়া, বহুদিনের জমানো তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের আকুলতা। কয়েক মিনিটের জন্য মনে হলো, ‘আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম’।

বহুবার সাগরের সৌন্দর্যের কথা শুনেছি, চোখে দেখা হয় নাই। ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর থানার লতাচাপলী ইউনিয়নে কুয়াকাটা অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের একমাত্র সমুদ্র সৈকত, যেখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়।

কুয়াকাটা নামকরণের পেছনে জড়িয়ে আছে অনেক ইতিহাস। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, আঠারো শতকে আরাকানরা মুঘল শাসকদের দ্বারা বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) বিতাড়িত হয়। তারা ছোট ছোট নৌকায় করে এ অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে। তখনকার সময়ে এখানে সুপেয় জলের অভাব ছিল৷ তাই তারা এখানে কয়েকটি কুপ খনন করেন। কুয়াকাটার ‘কুয়া’ শব্দটি ওই ‘কুপ’ থেকেই এসেছে বলে মনে করা হয়। সে থেকেই এই অঞ্চলের নাম কুয়াকাটা।

যাহোক আমরা হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে সমুদ্রে নামলাম। সে কি ঢেউ! সে কি উচ্ছ্বাস! মনে হলো হারিয়ে যেতে আর বাঁধা নেই। এখানে ভয় আছে, উদ্বেগ আছে ,উল্লাস আছে, আনন্দ আছে, অজানাকে জানার আকুতি আছে। ভিজে ভিজে সন্ধ্যার ঠিক আগে আগেই চলে আসলাম। সূর্যাস্ত দেখা হলো না৷ কিন্তু পরের দিনের ভ্রমণের জন্য বাইক ঠিক করে রাখলাম। পরদিন সূর্যোদয়ের আগেই বাইকে করে চলে গেলাম স্পটে।

নিরব প্রকৃতি যেন থেমে থেমে জানান দিচ্ছে সাগরের অস্তিত্ব। ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে ভেজা বালুর চিকচিকে কনার উপরে। পূর্বদিগন্ত আস্তে আস্তে লাল হয়ে সূর্য উঠল রক্তিম আভা নিয়ে। সলিল সমুদ্রের বুক চিরে। বেরিয়ে এলো সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া শিশুটির মত করে। আশপাশে তাকালাম। সবাই দেখছে। কেউ আবার ছবি তুলছে। আলো বাড়তে থাকলো। রৌদ্রতাপে জলগুলো কেমন ছলছল করছে! বাইক আমাদের সাথেই ছিল। আমাদের যেতে হবে পরের স্পটে। লাল কাকড়ার দ্বীপ। হাজারো কাকড়া হেঁটে বেড়ায় এখানে। কাছে গেলেই গর্তে ঢুকে পড়ে। অনেক চেষ্টা করে একটাকে ধরলাম। ছবি তুললাম। মাঝে মাঝে অস্থায়ী জেলেদের পল্লী চোখে পড়লো। সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত গঙ্গামতির (গজমতির) জঙ্গল দেখলাম।

সময় যেনো বাঁধ মানছে না। দুপুর গড়িয়েছে। দেখার আরো অনেক কিছুই আছে।এখানে অনেক প্রত্নতাত্মিক নিদর্শন এবং আদিবাসীদের বসতি রয়েছে। কেরানীপাড়া, মিস্ত্রীপাড়া, সীমা বৌদ্ধ মন্দির, ফাতরার চর, আমখোলাপাড়া, শুটকি পল্লী, আলীপুর বন্দর উল্লেখযোগ্য। এখানে আসলে রাখাইন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করা যায়। তাই প্রথমে গেলাম মিস্ত্রীপাড়ায়। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে আট কিলোমিটার পূর্বে এর অবস্থান। এখানে রয়েছে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ মূর্তি। তারপর কেরানীপাড়ার রাখাইন পল্লী। পল্লীর শুরুতেই রয়েছে 'কুয়া'। কুয়ার সামনেই রয়েছে প্রাচীন সীমা বৌদ্ধ মন্দির। এতে প্রায় সাঁইত্রিশ মন ওজনের অষ্টধাতুর তৈরি ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের মূর্তি রয়েছে। এসব মন্দিরে এখন গরিব ছাত্রছাত্রীদের বিনামুল্যে শিক্ষাদান করা হয়।

এছাড়া আলিপুর বন্দরে রয়েছে দক্ষিনাঞ্চলের অন্যতম বড় মৎস্য ব্যবসা কেন্দ্র। যা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে প্রায় চার কিলোমিটার উত্তরে। শুটকি পল্লীতে যাওয়া হয়নি সময় সল্পতার কারণে। সময় যে বড় নিষ্ঠুর। দেখতে দেখতেই ফুরিয়ে যায়। পড়ন্ত বিকেলের লাল আলো ক্রমশই কমে আসছে।ফিরতে হবে বহুদূরে। প্রায় ৩৮০কিলোমিটার পথ।

সকাল বেলায়ই সাকুরা পরিবহনের বাস ঠিক করে গিয়েছিলাম। রাত ন’টায় ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। তাড়াহুড়ো করে রাতের খাবার খেয়ে বাসে উঠলাম। বাস চলছে অনেকগুলো স্মৃতি নিয়ে। উত্তরের হিম হিম বাতাস গায়ে লাগছে। এ বাতাস শিহরণ জাগায়। শিহরণ জাগায় মনে। ইস! পৃথিবীটা এতো সুন্দর কেন? বৈচিত্র্যময় এই পৃথিবীতে অনেক কিছুই দেখার আছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। বহুদূর না গিয়ে চাইলে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন প্রকৃতির রাণী সাগরকন্যা কুয়াকাটায়।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কুয়াকাটা,ভ্রমণ,কুয়াকাটা ভ্রমণ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close