এস আর শানু খান, সংবাদকর্মী

  ২৫ নভেম্বর, ২০১৮

‘একটি দুর্ঘটনা দীর্ণ-বিদীর্ণ করে দেয় অগণিত জীবন’

আমরা মানুষেরা স্বভাবজাত ভাবে কতখানি যে ভুলমনা সেটার প্রমাণ নানা বাস্তবতা। প্রতিনিয়ত আমরা টিভিতে, রেডিওতে, নানা সময়ে লিফলেটে, পোস্টারে, ব্যানারে কত যে সচেতনতামূলক বানী দেখি। কিন্তু সেগুলো আমাদের হিসেবে এসে দেখা পযর্ন্তই গিয়ে থেমে থাকে। ভিতরকে জাগাতে পারে না।

গাড়িতে বাড়িতে এখানে-সেখানে চোখ মেলতেই দেখি ‘একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না।’ এ কথার ভাবার্থ আমরা সবাই জানি। কিন্তু যতক্ষণনা আমরা দুর্ঘটনার শিকার হই ততক্ষণ পর্যন্ত এর ভাবার্থ আমাদের বুঝে আসে না। তেমনই এক পরিস্থিতির মুখোমুখী ট্রলি চালক চঞ্চল।

চঞ্চল খুবই উদারচেতা ও মানবতাবাদী হতদরিদ্র একজন মানুষ। হিন্দু ধর্মের অনুসারি হলেও মানবিক দিক থেকে হিন্দু-মুসলমান সবাই তার কাছে সমান। যখন যে ডাকে- সাড়া দেয়।

গভীর রাতে কারও কোনো সমস্যা হলেই চঞ্চল ট্রলি নিয়ে হাজির হয় সেখানে। কোনো অজুহাত খাড়া করেনি কোনও দিন। দুঃসময়ের সঙ্গী হিসেবে চঞ্চলের নামই পরিচিত। চঞ্চলের ট্রলিতে করে গ্রামের কোনও একজনের আত্মীয়ের বাড়িতে শ্রাদ্ধ খেতে গিয়েছিলো তারই পাড়ার বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ। শ্রাদ্ধ খেয়ে ফেরার পথে সামান্য অসাবধানতার কারণে ঘটে বসে এক দুর্ঘটনা।

ট্রলি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের একটি গাছের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা খায়। নিয়তি অন্যদিকে বাঁক নেয়। করুণ বিরহের বাঁশি বেজে ওঠে দুটি পরিবারে। গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে বাম পা ভাঙে চঞ্চলের। পেছনে বসে থাকা তিন সন্তানের জননী সবিতা রাস্তার ওপর কাত হয়ে পড়ে জ্ঞান হারান। বাকি সবাই একটু-আধটু আঘাত পেলেও কারও অবস্থা গুরুতর নয়।

চঞ্চল ও সবিতাকে তাৎক্ষনিকভাবে নিয়ে যাওয়া হয় মাগুরা সদর হাসপাতালে। সেখানে চঞ্চলকে ভর্তি করলেও চিকিৎসকরা সবিতাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ফরিদপুর নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সবিতার আঘাত ছিলো খুবই গুরুতর। মাথায় আঘাত পেলেও কোথাও কোনও ক্ষত নেই। অথচ নাক, কান, আর মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে স্রোতের মত।

ফরিদপুর নিয়ে কাজ হলো না। সেখান থেকে পাঠানো হলো রাজধানীর নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে। সেখানে ডাক্তার দেখেই জানান অপারেশন খুবই জরুরি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা বলেন, মাথার ভেতরে মারাত্মকভাবে রক্তক্ষরণ হয়েছে। রক্ত মাথার ভেতরে জমাট বেঁধেছে।

সারা গ্রামের সকল মানুষের মুখে মুখে তখন সবিতা আর চঞ্চলের কথা। সবিতা বড্ড কর্মঠ মহিলা। সারাদিন এটাসেটা করে জীবন ধারণ করেন। কখনও মাঠে গিয়ে গরুর জন্য ঘাস আবার কখনও বাগানে বাগানে টৈ টৈ করে খড়ি কুড়িয়ে বেড়ায়। টানা পোড়েনের সংসার। স্বামী অন্যের বরজে (পানের বাগান) কামলা খাটে। সবার সাথে হাসিমুখে কথাবলা ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করা সবিতা চরিত্রের এক অন্যন্য দিক। মানুষের মনে সবিতার অবস্থানটা ছিলো অন্যরকম। চঞ্চলের বেলায়ও ঠিক তাই। সবাই বলাবলি করতে লাগলো ভালো মানুষেরই বিপদ বেশি হয়।

অপারেশন করতে টাকা লাগবে অনেক। খবর পৌঁছে গেলো গ্রামে। আমাকে ফোন করলেন আশীষ দাদা। সবিতাদের বাড়ির পাশেই তার বাড়ি। দাদা ফোন করলেন আমাকে পত্রিকায় সাহায্যের আবেদন করার জন্য। আমি ছুটে গেলাম। ছবি সংগ্রহ করলাম আশীষ দাদার বউকে দিয়ে। ছবি তুলে পত্রিকাসহ বেশ কয়েকটা অনলাইন পোর্টালে দিয়ে সেগুলো ফেসবুকে শেয়ার করলাম। কিছু টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। সবিতার অপারেশন করা হলো। মাথার মগজ মাথা থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছিল দুইদিনের মত। পরে অপারেশন হলেও জ্ঞান ফেরেনা সবিতার। অবশেষে এক সপ্তাহ পর জ্ঞান ফেরে সবিতার। ২৬ দিন পরে বাড়ি ফেরেন সবিতা। আর চঞ্চল ফেরেন ৩৫ দিন পর।

বেশ কয়েকদিন ধরে ভাবছিলাম সবিতা ও চঞ্চলের এখনকার জীবন নিয়ে লিখবো। তাইতো সেদিন বিকেলে ক্যামেরা নিয়ে বের হলাম। প্রথমে গেলাম চঞ্চলের বাড়ি। তার স্ত্রী জানালো, মোড়ের দিকে গেছে। চঞ্চল ১১ মাস বয়সী এক ছেলের জনক। স্ত্রী সন্তান, ছোটভাই ও বাবা মাকে নিয়ে সংসার। ট্রলিই রোজগারের একমাত্র অবলম্বন। সংসারের সবার চোখে মুখে এখন হতাশার ছাপ। মোড়ে গিয়ে দেখা হল চঞ্চলের সঙ্গে।

চঞ্চল এখন দুই বগোলে ক্র্যাচে ভর করে চলে। সামান্য হেঁটেই বললো খুব কষ্ট হচ্ছে। পায়ের ভেতর লোহার রড লাগানো রয়েছে। পা এখনও ঠিক হয়ে উঠেনি। সময় লাগবে। ঠিক হলে পরে অপারেশন করে রড বের করা হবে। ততদিন ক্র্যাচে ভর করেই চলতে হবে। চঞ্চলের বাম পা শুকিয়ে চিকন হয়ে গেছে অনেক। চঞ্চলের সঙ্গে বসে অনেক কথা হলো। বিস্তারিত শুনলাম তার নিজের মুখে।

চঞ্চল জানালো সামান্য অসাবধানতার জন্য এমন ভোগান্তি। একদম সামান্য। তবে ‘আল্লাহর কৃপা’ যে আমি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারায় ট্রলির বাকি মানুষগুলোর ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। অন্যথায় ঘটনা আরও মারাত্মক হতে পারতো। সরাসরি গাছে না মারলে ট্রলিসহ মানুষগুলো পুকুরে যেত।

কেমন চলছে সংসার? একটা মলিন হাসি হেসে লম্বা একটা হাই তুলে বললো, এই কোনও রকম চলতে হবে- তা ছাড়া আর কি করা ভাই।

পরে গেলাম সবিতার কাছে। সবিতা আমাকে দেখেই চিনতে পারলেন। চেহারা দেখে আমি চমকে গেলাম। চিনতে কষ্ট হচ্ছিলো আমার। সবিতা এখন অনেক বেশি কথা বলে। একই কথা বার বার বলে। সবিতা কিছু ওষুধ বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, এইগুলো খেয়ে আমার মাঝে মাঝে মাথা ঘোরে। এদিক সেদিক মাথা ঘুরে পড়ে যাই। আমি দেখলাম হাই পাওয়ারের এন্টিবায়োটিক। নিষেধ করলাম ওগুলো বেশি খেতে।

এখন কেমন অবস্থা? জানতে চাইলে সবিতা বললেন- ভালো লাগে না ভাই। বসে শুয়ে থাকতে ভালো লাগে না। তুই বল আমি কি বসে শুয়ে থাকা মানুষ? আমি বললাম কি আর করা দিদি, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। সবচেয়ে বড় কথা, আপনাকে তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন। কোনও না কোনোভাবে চলবেই দিদি। শেষে একটা কথা বললেন সবিতা, সবার আশীর্বাদ ছিলো আর উপরে সৃষ্টিকর্তা ছিলেন বলেই হয়তো আমি বেঁচে গেছি ভাই।

সামান্য অসাবধানতার কারণে দুটো পরিবারে আজ করুণ পরিনতি। সুখের সংসারে আজ বিরহের কালো মেঘের ঘনঘটা।

পিডিএসও/অপূর্ব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
দুর্ঘটনা,দীর্ণ-বিদীর্ণ,জীবন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close