সাজ্জাদ হোসেন, সাহিত্যিক

  ০১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

"আত্মহত্যাস্পৃহা একটি অসম্পূর্ণতার গল্প"

জীবনযাপনের কঠিন দুঃখ-দুর্দশা ও ব্যর্থতার গ্লানি থেকে পরিত্রাণের জন্য অথবা জেদের বশবর্তী হয়ে বেছে নেয় আত্মহননের পথ। অথচ আজকাল আত্মহত্যার ঘটনা প্রায়ই সংঘটিত হচ্ছে। পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল, বাবা-মায়ের সামান্য বকুনির আফসোসে বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার মতো নিকৃষ্ট সমাধানকে। অনেকেরই আবার প্রেম বেদনার মানসিক অশান্তি, পারিবারিক বিপর্যয়, অর্থনৈতিক বেড়াজাল ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গেও জড়িত আছে আত্মহত্যার মতো ধ্বংসাত্মক ঘটনা। আনুষঙ্গিক কারণগুলোর দিকে তাকালে, অতিরিক্ত মাদকাসক্তির পরিণতি, পারিপার্শ্বিক পরিবেশে নারীরা যৌন নির্যাতনের স্বীকার হলে এ আকস্মিক দুর্দশা পরিলক্ষিত হয়। চলমান প্রেক্ষাপটে পরিবারের কোনও ব্যক্তি কিংবা বন্ধু-বান্ধবীর আত্মহত্যার ঘটনা দ্বারাও অনেকটা উৎসাহী। যথোচিত কোনও কারণে প্রচণ্ড মানসিক চাপের ফলে ভারসাম্য হারিয়ে, তা সহ্য করতে না পেরেই আত্মহননের মধ্য দিয়ে দুর্বল চিত্তের ব্যক্তিরা মুক্তি খোঁজে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও পুলিশ সদর দপ্তরের মতে, বাংলাদেশে ২০১১ থেকে ১০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করেছেন। শুধু ২০১৩ সালেই ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন ১০ হাজার ১২৯ জন। যারা আত্মহত্যা করেছেন বা চেষ্টা করেছেন, তাদের বড় অংশের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।

কিন্তু বিশ্বের অনেক নামকরা সব বিখ্যাত মানুষের জীবন আবেগ উপলদ্ধি করলেই বেরিয়ে আসে রুদ্ধশ্বাসে জর্জরিত ইতিহাস। জনপ্রিয়তার আড়ালে লুকিয়ে থাকে অতীত চেতনার করুণ আত্মসুর। তবুও কখনো পিছপা হয়নি তারা একটুর জন্যও। আমরা অনেকেই বন্ধু-বান্ধবীর জন্মদিনের পার্টি অথবা নতুন বর্ষবরণ উপলক্ষ্যে 'কেএফসি' থেকে ফ্রাইড চিকেন ট্রিট করি। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই প্রতিষ্ঠানটির নাম লোকমুখে! কিন্তু এর প্রতিষ্ঠাতার খবর কজনই বা মাত্র জানে? চলুন দুর্বলদের একটু সংক্ষেপে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাকঃ

"কর্ণেল হারল্যান্ড ডেভিড স্যান্ডার্স " একজন আমেরিকান ব্যবসায়ী। কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন। মানে 'কেএফসি' এর প্রতিষ্ঠাতা। ৬৫ বছর বয়সে তিনি জীবনের প্রতি হতাশ হয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। মাত্র ৫ বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান। ১৬ বছর বয়সেই স্কুল থেকে ঝরে পড়েন। ১৭ বছরের মাথায় মোট চার বার চাকরি হারিয়েছিলেন। পরবর্তী বছরে বিয়ের আসনে বসেন। ২০ বছর বয়সে তার স্ত্রী তাকে ফেলে রেখে চলে যায় আর কন্যা সন্তানটিকেও নিয়ে যায় সাথে। সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন, সেখানেও ব্যর্থ হন। ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে যোগদান করেন এবং সেখানেও জয়ের মুখ দেখতে পাননি তিনি। নিজের মেয়েকে নিজেই অপহরণ করতে গিয়েছিলেন এবং সেখানেও ব্যর্থ হন। চাকরি নিয়েছিলেন রেললাইনের কন্ডাকটর হিসেবে, তেমন জমাতে পারেননি সেখানে। অবশেষে এক ক্যাফেতে রাধুনীর চাকরি নেন। ৬৫ বছর বয়সে তিনি অবসরে যাবার প্রথম দিন সরকারের কাছ থেকে ১০৫ ডলারের চেক পেয়েছিলেন। তার কাছে মনে হয়েছিল জীবন মূল্যহীন, ঠিক তখনি আত্মহত্যা করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। এরপর একটি গাছের নিচে বসে জীবনে কি কি অর্জন করেছেন তার একটা লিস্ট বানাতে শুরু করলেন। হঠাৎ তার কাছে মনে হয় জীবন এখনো অবরুদ্ধ নেই, এখনো অনেক কিছু করবার বাকি। আর তিনি বাকি সবার চাইতে একটি জিনিসের ব্যাপারে বেশি জানতেন- রন্ধনশিল্প।

৮৭ ডলার ধার করলেন সেই চেকের বিপরীতে আর কিছু মুরগি কিনে এনে নিজের রেসিপি দিয়ে সেগুলো ফ্রাই করলেন। এরপর কেন্টাকিতে প্রতিবেশীদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ফ্রাইড চিকেন বিক্রি করা শুরু করলেন! জন্ম নিল কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন তথা 'কেএফসি' এর। ৬৫ বছর বয়সে তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন আর ৮৮ বছর বয়সে এসে বিলিয়নিয়ার বনে গিয়েছিলেন। স্মরণীয় হয়ে আছেন কেএফসির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে!

এরই উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্তে যার নাম বেঁধে দেওয়া যায় তার নাম দুখু মিয়া। এ দেশে বিপুল নজরুল ভক্ত থাকলেও তার এ ডাক নামের মর্মার্থ অনেকেই জানেন না। পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনেক থাকার ফলে সংসার তার পক্ষে মস্তবড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে মাত্র এগার-বার বছর বয়সের কিশোর কবিকে অন্ন জোটাতে উদয়াস্ত কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছে। কাজ করতে হয়েছে রুটির দোকানে। পক্ষান্তরে, আজকালকার দেশের প্রোজ্জ্বলিত তারকারা বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরের কথা, সামান্য মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার শোকে বেছে নেয় আত্মহননের পথ।

প্রসঙ্গক্রমে একটু দৃষ্টিপটটাকে অন্য দিকে তাকালেই খুঁজে পাওয়া যায়, এই নরমাংস মানবগুলোর বেঁচে থাকার আকুল আকুতি। গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তায় সাইকেলে চলমান ডাকপিয়নটির মাঝে দৃশ্যমান জীবন সংগ্রামের রুপ। বিদ্রোহী কন্ঠে চিৎকার করা খবরের কাগজ বিক্রি করা লোকটির মাঝে পাওয়া যায় জীবিতের আকাঙ্ক্ষা কিংবা তেলাপোকার ন্যায় টিকে থাকা দুটি টাকা পাওয়ার প্রগাঢ় মিনতি সিদ্ধ পথশিশুটি। এ তো মানবীয় আচরণ। অথচ তোমার আত্মার সৃষ্টিকারীই বলেন, "তোমরা নিজেদের হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমা লঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, তাকে অগ্নিতে দগ্ধ করব; এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।" (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯-৩০)।

হতাশা আর দীর্ঘশ্বাসের হুল না ফুটিয়ে এখনি সচেতন হতে হবে সমাজকে। আত্মহত্যার প্রতিকাররুপে নামতে হবে নিজ পরিবারের ভূমিকাগত সদস্যদেরকেই। কারণ পূর্বে এর প্রবণতা ছিল অশিক্ষিত সমাজের দ্বারে। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষিত সমাজেই এর পরিসংখ্যান বেশি, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। সন্তানদের প্রত্যেক স্তরে উচ্চতর প্রতিযোগিতার পাল্লায় ফেলে দেয় এ দেশের ঢের শিক্ষিত অভিভাবকেরা। এর পিছনে সবচাইতে বেশি যেটা কাজ করে তা হলো উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রত্যাশা। প্রত্যেকের বাবা-মার এ প্রত্যাশাটাই থাকাটা স্বাভাবিক। তবে সেটা তো তার কর্মক্ষমতা, মেধাশক্তির সাধ্যের মাঝেও থাকতে হবে। গাধা দ্বারা হাল চাষবাস করা যায় না ঠিকিই কিন্তু সেই গাধা তো বুদ্ধিমান আর উপকারী প্রাণীও বটে। তাই গাধা শব্দটাকে নেতিবাচক অর্থে না দেখে এর গুণকেও খোঁজা জরুরি।

পক্ষান্তরে, এ দেশের বিধানে একটু আড়চোখ ফেললে দেখা যাবে, "বাংলাদেশ দন্ডবিধি ৩০৬ মোতাবেক, আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীর জন্য সর্বোচ্চ দশ বছর কারাদণ্ডের এবং ৩০৯ মোতাবেক, আত্মহত্যার চেষ্টাকারীর এক বছর কারাদন্ডের বিধান রয়েছে।" আমি দেশের এ আইনকে ভক্তির সাথে সম্মান জানাই। তবে আমার নিজস্ব অভিমতে, একজন ব্যক্তি যখন পারিপার্শ্বিক পরিবেশ; পারিবারিক কারণ কিংবা নিজস্ব ব্যর্থতায় হউক না কেন সুইসাইড করার সিদ্ধান্ত নেয় সে প্রচণ্ডরুপে মানসিক বিপর্যয়ে ভুগে। ঠিক সে মুহূর্তে তার প্রচলিত আইনের বিধান তো দূরের কথা আত্মার সম্পর্কগুলো মলিন হতে থাকে। তাই করণীয় হিসেবে এসব ব্যক্তিদের মানসিকভাবে উৎসাহ প্রদান/চিকিৎসা অথবা এর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। মানসিক বিকারগ্রস্ত লোকের পূর্বদশা জানতে তার আচরণ দেখে; কাছের মানুষদের কাছে শোনে কিংবা অনেকেই বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় তার জর্জরিত অনুভূতিগুলো জানানোর জন্য আশ্রয় নেয়।

সমসাময়িক আত্মহত্যার স্পৃহার পাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রাঙ্গণের শিক্ষার্থীদের মাঝে। এর হার বাড়ছে ঠিকই কিন্তু সে তুলনায় উপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না বললেই চলে। সমসাময়িক এ প্ররোচনা ঠেকাতে ভূমিকা রাখতে পারে প্রত্যেকেই স্ববস্থান থেকে। এর জন্য চাই শিক্ষার্থীদের বহুল সচেতনতা। বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি হতে পারে "আত্মহত্যা" বিরোধী সংগঠন। গড়ে তুলতে পারে মুখরিত স্লোগান, র‌্যালি কিংবা প্ল্যাকার্ড। পাশাপাশি হাত বাড়াতে হবে সরকারকে। প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আনুষঙ্গিক কোর্সগুলোর পাশাপাশি একটি বাধ্যতামূলক 'সুইসাইড' প্রতিরুদ্ধ মনস্তাত্ত্বিক কোর্সের প্রচলন করানো যেতে পারে।

বেঁচে থাকুক কৃতকর্মগুলো, আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকুক মানুষ, পুরোনো অমলিন দ্বীপ্তিমান স্মৃতিগুচ্ছ নিয়ে। তাজা থাকুক সুকান্ত ভট্টার্যের আঠারোর মেজাজঃ

এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়

পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,

এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়-

এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আত্মহত্যাস্পৃহা,অসম্পূর্ণতা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close