গোলাম মাওলা শাকিল

  ২৫ আগস্ট, ২০১৮

সেই সময়...

ধান কাটার পর গ্রামে ধানক্ষেতে পিচ বানিয়ে ক্রিকেট খেলতাম আমরা। একবার বাউন্ডারির পাশে ফিল্ডিং করছিলাম, একসময় বল সীমানা পার হলে বল আনতে যাই আমি। বল গিয়েছিল তখন বাঁশঝাড়ের পাশে, গিয়ে দেখি বলটার পাশে এক মস্ত বড় সাপ।

সাপ আমি বড়ই ভয় পাই, আমার গলা শুকিয়ে গেলো। আমি চিৎকার করে আমার বন্ধু অজয়কে ডাক দেই। আমার ডাকে হয়তো ভয় ছিল। অজয় দৌড়ে আসে। এসে সাপটাকে দেখে স্বাভাবিকভাবে বলে- যদি সত্যিকারের সাপ হোস তাহলে চলে যা, আর দ্যাও- ভূত হলে তোর মতো থাক আমাদের ক্ষতি করিস না।

আশ্চর্য, অজয়ের কথা শুনে সাপটা আস্তে আস্তে চলে গেলো। তখন সে বল আর আমাকে নিয়ে চলে আসে। অজয় এই কথা কোথায় শিখেছিল সেদিন আর জানা হয় নাই। আমাদের খেলা চলতো পৃথিবীতে যতক্ষণ আলো থাকতো। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই আমার দাদি খেলার মাঠের কোনায় আমাকে ডাকতে যেতো।

মেজোচাচার কড়া শাসন ছিল, মাগরিবের পরই হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসতে হবে। সত্যিই, আমি যখন এই শহরে এসে হঠাৎ অনেক বড় হয়ে যাই, যখন আমার দাদির সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার তাড়া আমার কানে পৌঁছাতো না, মেজোচাচার কড়া শাসন ছিল না ঠিক তখনই আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল আর সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাই।

২০১১ সালের এইদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটা ছোট ছোট সাপ আমাকে ঘিরে ফেলে, এই সাপগুলো সেদিনের সেই মস্তবড় সাপ ছিল না।

কিন্তু তবুও আমি হাজারো চেষ্টা করেও অজয়ের সেইকথাটা সেদিন মনে করতে পারি নাই, আর করবোই বা কি করে আমিতো আমার সত্যিকারের বন্ধুদের মনে রাখি নাই! পরিণামে সাপগুলো আমাকে কঠিন দংশন করলো। সেই সাপের দংশন, আমাকে এমন ভাবে বিপর্যস্ত করে যে পুরো পৃথিবী শূণ্য হয়ে গেলো ।

আমি ডানে গেলে হয়ে যেতো বামে। মস্তিষ্কের নিউরন ঠিকমতো কাজ করছিলো না। ২০১৬ সালে আমার চোখ দিয়ে প্রচুর পানি পড়া শুরু করলো, ডাক্তার দেখানোর পর বললো-এরকম আর কিছুদিন গেলে আমার চোখের নার্ভ শুকিয়ে যাবে। সেবার অনেক জল পড়ে আমার চোখ ঠিক হয়ছিল, আমি তখন থেকে ভাবি আমার চোখে আর কখনোও জল আসবে না।

কিন্তু হায় ঈশ্বর! আবারো, এ চোখে এতো জল ছিলো? আমি আমার এই জীবনের অর্জন দ্বারা, আমার পরিবারকে কতোটুকুই বা আনন্দ দিতে পারছি কিন্তু আমার সেই সময়ের চোখের জলে আমার পুরো পরিবারকে কষ্ট দিয়েছি। আমি সত্যি সবাইকে কষ্ট দিতে চাই নাই। আমি পথ হারিয়ে ফেলছিলাম। তবে সেই সময় আমাকে জানিয়ে গেলো, কে আমার সত্যিকারের বন্ধু আর আমার কাছের মানুষের আমার প্রতি কতো ভালোবাসার তীব্রতা। থাক সেসব কথা।

আমি আমার আপনজন, সত্যিকারের বন্ধুদের সেই ভালোবাসার জোরে আবার কোনোদিকে না তাকিয়ে সবুজ ক্যাম্পাসে চলতে শুরু করলাম। ক্ষণিকা বাসে হেডফোন দিয়ে গান শুনতে শুনতে সন্ধ্যার আগেই আবার আমার আবাসে ফিরা শুরু করলাম। আমি বাস্তবের অনেক উপর দিয়ে হাটতে লাগলাম।

তারপরেও বুয়েটের সেই সাবিকুন নাহারের মতো 'এই আমি কিছুটা বাস্তব' যখন হতাম আমার দাদিকে ফোন দিতাম আর বলতাম সেই সময়কার কথা, যখন ছোটচাচা আর আমি রাতে খেতে বসতাম, আর দাদি আমাদের পাতে ভাত তুলে দিতো, ওইসময় নিয়ম করে প্রতিদিন বিদ্যুৎ চলে যেতো, দু-চারটা পোকাসহই চার্জারের আলোয় হয়তো আলো-আধারিতেই আমরা খেয়ে উঠতাম। আমার জীবন হবে মনে হয় এইরকম আলো-আধারি।

আমার দাদি উত্তর দিতো গ্রামে একটু ঝড় হলেই বিদ্যুৎ চলে যেতো, আসতো তিন দিন পর, আর যখন আসতো এমন আলোকিত হতো পুরো গ্রাম যেনো নতুন বিদ্যুৎ আসছে, গ্রামের ছেলেরা চিৎকার করে উঠতো বিদ্যুতের আলোয়, যেনো নতুন বিদ্যুৎএসেছে। আমার জীবন নাকি হবে সেইরকম আলোকিত।

আমার জীবন আলোকিত, আধো-আলো, না পুরোপুরি অন্ধকার হবে তা বিধাতাই ভালো জানেন তবে আমার জীবনে নিশ্চয়ই দারুন এক আলো আসবে আর যাই হোক সেই আলো, আমি আমার দাদিকে দেখাতে পারবো না কোনোদিন...............।

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সেই,সময়
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close