গোলাম মাওলা শাকিল
সে সময় তুমি আমি...
শনিবারের দুপুর। প্রচণ্ড মন খারাপ। মন খারাপ হলেই বারিধারার ডি-মাজেনড গীর্জার কাছে একটা রেস্টুরেন্টে ঠাণ্ডা কফি গিলতে যাই আমি। সেদিনও গেলাম। দুপুরেও অনেক নিরিবিলি। কফিতে চুমুক দিচ্ছি, আর রেস্টুরেন্টের স্বচ্ছ কাচ দিয়ে ব্যস্ত শহরের বুকে জ্যামে আটকা গাড়ি দেখছি।
হঠাৎ চোখ চলে গেলো ডান দিকের কোনায় ৮০ টাকার একটা কফি পাণ করে, বেয়ারা ছেলেটাকে দুই হাজার টাকা টিপস দিচ্ছে একটা মেয়ে। ছেলেটা নিচ্ছেই না, কিন্তু সে দিবেই।
অবশেষে সে তার হাতে জোড় করেই গুঁজে দিলো টাকাটা। আমার কৌতুহল হচ্ছিল তাছাড়া দূর থেকেই মেয়েটাকে পরিচত মনে হচ্ছিল, এগিয়ে ওই টেবিলের কাছে গেলাম......'আরে অবনী, তুমি এখানে? কোথা থেকে, কেমন আছো......?'
'কে ভাইয়া, আপনি? মেয়ে দেখলেই কথা বলতে জিভ লকলক করে তাই না? পূর্ব জন্মের ঘরের বউ মনে হয়? আমি আপনাকে তো চিনতেই পারছিনা। কখনো রাস্তাঘাটে দেখেছি বলেও তো মনে হচ্ছে না। ফাজিল ছেলে কোথাকার.......!
আমি মহাপুরুষ হওয়ার প্রচেষ্টা করছি, অনেকদিন কোনো বিষয়ে অবাক হই না! তবুও বিস্ময় লুকিয়েই জোড় গলায় বললাম, 'দ্যাত কি বলছো এসব ! তুমি ম্যাথম্যাটিকসের অবনী না ! ২০০৬-২০০৭ সেশনের ! স্টাফ রোড থেকে বাসে উঠতা?'
'আরে না ভাইয়া.....! আমিতো এই শহরেই আসছি মাস দু'য়েক হলো।'
সত্যিই এবার ভরকিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরই মেয়েটিকে মিট-মিট করে রহস্যের হাসি হাসতে দেখলাম।
আরে শাকিল ! দেখছো কেমন ভরকিয়ে দিলাম। আমিতো তোমাকে চিনতে পারছি, একটু মজা করলাম। কতোদিন পর...........!
অবনী আমার বন্ধু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষণিকা বাসের ঝুলে যাওয়ার দিনগুলিতে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে উঠতাম এয়ারপোর্টের পাশে কাওলা থেকে আর অবনী উঠতো স্টাফ রোডের সামনে থেকে। সে নামতো শহীদ মীনারের সামনে, আমি কার্জনহলে।
যেদিন বাসে সিট পেতাম না, একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম, দেখতাম মেয়েদের কোনার দিকের সিটে একটা মেয়ে গসগস করে পাতার পর পাতা অংক করে যাচ্ছে। কোনোদিকে দৃষ্টি নাই। মেয়েটি অবনী.......!
অবনীর এই অংক করা দেখতেই আমি বাসে সিট পেলেও বসি না, আসল কথা আমি সিট পাওয়ার চেষ্টায় বাদ দিলাম। স্টাফরোড থেকে মেয়েদের সিট পাওয়া খুব দূরহ হলেও, অবনী কেমনে জানি পেয়ে যেতো !
একদিন শহীদ মিনারের সামনে থেকে কি জানি কি কারণে বাস থেকে নেমে গেলাম, পিছনে অবনী।
'এই ছেলে তুমি প্রতিদিন দাঁড়িয়ে যাও কেনো, আর উঁকি দিয়ে আমাকে দেখো যে !'
সেদিন থেকে শুরু। ম্যাথম্যাটিকস এর অবনী আমার বন্ধু। সকালে প্রায়শই ৭টার বাসে, বিকেলে ক্লাস, ল্যাব শেষে বেশিরভাগ সময় সাড়ে ৪টা কিংবা শেষের বাসে অবনীর সাথে দেখা।
দিন যাচ্ছিলো। কখনো দেখতাম অবনী আমাদের দো'তলা বাসের উপরে উঠে দেরি দেখে নিজের লাইব্রেরি কার্ড রেখে আমার জন্য সিট রাখতো।
তবুও, আমি বসতাম না। কিংবা, কার্জনহলের সামনে বাস ছাড়ার আগে তিন টাকায় যে তেতুল/আমলকির আচার বিক্রি করে, তার ৫-৭ টা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো আমার জন্যে....!
'কবে ফিরছো ! তোমার চেম্বার কই? প্রাকটিস করো কোথায়?'
'আরে বাদ দাও, থাকো ! আমাকে যেতে হবে......।'
'তোমার ফোন নাম্বারটা দিয়ে যাও কিংবা ফেসবুক আইডিটা।'
'আমিতো এসব কিছু ব্যবহার করি না।' বলেই উঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো অবনী।
'আরে কোথায় যাও ! '
'আত্মহত্যা করতে।'
'আমিও সাথে যাই....!'
'আজব তো। তুমি আবার কই যাবে? পিছু নেওয়ার অভ্যাসটা তোমার গেলো না !'
'অবনী! তুমি খুব ভালো করেই জানো, আমি তোমাকে পছন্দ করতাম। কিছু বোঝার আগেই হারিয়ে গেলা। যোগাযোগের সামান্য মাধ্যম হিসেবে যে ফোন নাম্বারটা ছিলো, সেটাতে প্রায়শই এখনো ফোন দেই কিন্তু ঐ একই কথা, বন্ধ....! স্বাভাবিক। কিন্তু, আমার সেই মুঠোফোন নাম্বারটা তো ছিল।'
'যাক, ওসব কথা। আজ যখন দেখা পেয়েই গেছি তো এতো সহজে ছাড়ছি না!'
'তুমি বুঝতেছো না কেনো, আমি আজ আত্মহত্যা করতে যাচ্ছি।'
'তো করো আমি সাথে থাকলাম।'
'না তুমি থাকবে কেনো! আত্মহত্যা করা ব্যক্তির সাথে শেষ সময়ে যে থাকবে পুলিশ তাকে অনেক ঝামেলা করবে।'
'পুলিশ ঝামেলা করলে করবে আমাকে, তুমি তো মারাই যাবা। তোমার সমস্যা কি?'
আর দাঁড়ালো না অবনী। বলেই হুট করে বারিধারার অ্যাট্রিয়াম রেস্টুরেন্টের সামনে থেকে প্রায়ই দৌড়ে রাস্তা পাড় হয়ে গিয়েই একটা রিক্সা নিয়ে কুড়িল, বিশ্বরোডের দিকে চলতে লাগলো...।
আমিও কিছু না ভেবে আরেকটা রিক্সা নিয়ে ওর পিছু নিলাম।
বিশ্বরোডের সামনে নেমে গিয়েই অবনী রুপগঞ্জের কাঞ্চন ব্রিজগামী বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টার হয়ে ৩০০ ফিটের রাস্তা পেরিয়ে যে প্রাইভেট কারগুলো ধারাবাহিকভাবে যায় তার একটার সামনের সিটে বসে পড়লো। চার জন পূর্ণ না হলে এই গাড়ি ছাড়ে না। অবনীর অপেক্ষায় মনে হয় এরা ছিলো।
আমি কাছাকাছি আসতেই অবনীর গাড়ি ছেড়ে দিলো। অগত্যা চার জনের সিটের ৬০ টাকা করে ২৪০ টাকায় আরেকটা গাড়িতে আমি অবনীর পিছু চললাম।
কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত নয়, ডুমনীর (মধ্যবর্তী জায়গা) মধুমতী ব্যাংকের একটি নতুন শাখার সামনেই অবনী নেমে গেলো। রাস্তার পিছনেই গ্রাম। অবনী হেঁটে ভিতরে যাচ্ছিলো। কিছুদূর যাওয়ার পরই অবনী গলির ভিতর যে বাড়িতে ঢুকলো সেটা একটা ছোট স্কুল। ত্রিশ-চল্লিশ জন আট-দশ বছর বয়সী ছেলে-মেয়ে অবনীকে দেখেই চিৎকার করে জড়িয়ে ধরে ফেললো।
অবনী তার কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ খুলে একশ টাকার প্রায় নতুন তিনটা বান্ডিল যার হাতে দিয়ে দিলো, তাকে স্কুলের প্রধাণ কেউ বলে মনে হলো।
'স্যার ! এবার হয়তো আর অনেক দিন আসতে পারবো না।'
স্কুলের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরছিলো অবনী। গলির সামনেই আমার সাথে মুখোমুখি।
'ওফ! তুমি, আবার পিছুপিছু......।'
' খুব টাকা-পয়শা হইছে তোমার, তাই না? কফি গিলেই দেখলাম ওয়েটার ছেলেটাকে দু'হাজার বকশিশ দিলা এখানে আবার হাজার ত্রিশেক......!'
'শোনো ! এতো কৈফিয়ত দিতে পারবো না। আমি আজ আত্মহত্যা করবোই, তার আগে তিনটা কাজ করতে হবে আরো দু'টো বাকি। বিরক্ত করো না তো.....!'
'বিরক্তের কি আছে। তোমার যেহেতু পৃথিবীর আজ শেষ দিন, বাকি কাজ দু'টোর সাথেও কিন্তু আমি থাকছি.....!
বলো, এখন কি করবে......!
কোথায় যাবে!'
'তোমাকে আমি সাথে নিবো কেনো ! তুমি যাও তো, খুব যন্ত্রণা করছো........!'
'মরতে কিন্তু সাহস লাগবে, শেষ সময়ে যাতে তুমি ভয় না পাও সেজন্যে হলেও আমাকে সাথে থাকা উচিত।'
'হাহাহা, আমি ভয় পাবো কেনো?'
আমি এখন বুড়িগঙ্গায় গিয়ে নৌকোয় ঘুরবো, নদীর মাঝেই সূর্যাস্ত দেখবো পুরাণ ঢাকায় বাকরখনির সাথে মিষ্টি খাবো তারপর সব শেষ করে ফেলবো।'
'ও আচ্ছা! মরার আগে তো শখ খারাপ করো নাই, এখন যাবা বুড়িগঙ্গার দূষিত জলে নৌকোয় উঠতে, বাকরখনির জন্যে লালবাগে? ওর চেয়ে চলো, কাছেই শীতলক্ষ্যায় নৌকো ভ্রমণ করে নিয়ে আসি আর বাকরখনি গুলসান-২ এও পাওয়া যায়, তোমাকে এতো কষ্ট করতে হবে না।'
'আমি গুলশানের কোনো রেস্টুরেন্টে যাবো না বাবা মরতে......!'
অবনীর উত্তরের অপেক্ষা না করেই আমি অসম সাহসে ওর ডান হাতটি টেনে ধরে, কাঞ্চন ব্রিজমুখী একটা সিএনজিতে উঠে গেলাম। ব্রিজের নীচ দিয়ে অটো রিক্সায় গেলাম বেলদী বাজার। বাজারের শেষে শীতলক্ষ্যার পুরোনো এক ঘাট দিয়ে উঠলাম ছোট একটি ডিঙ্গি নৌকোয়। বিকেল পেরিয়ে যাচ্ছিলো।
মাথার ওপর ঘরে-ফেরা পাখির অজস্র চিৎকার, শরীরের উপর দিয়ে যেনো ফিনফিনে কুয়াশারা গড়িয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে কোনো নৌকো, স্টিমার, জাহাজ কিছুই দেখা যাচ্ছে না। নদীর মাঝেই পৃথিবীটা নির্জন হচ্ছে।
আকাশটা যেনো অতি দ্রুত নীচে নেমে আসছে। চারপাশে এখন দৃষ্টি যায় না। অন্ধকার গাছের মাথা থেকে যেনো ঝুরুঝুরু করে নদীর জলে ঝরছে। সূর্যটাও ধীরে ধীরে শীতলক্ষ্যার মাঝে একটি দিনের জন্য হারিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর এমন রুপকে কোনো কথায় ব্যক্ত করা যায় না। অবনী চারদিকে শুধু মুগ্ধ হয়েই দেখছে। চোখের দৃষ্টি সহজ করে আমি অবনীর মুখের দিকে তাকালাম।
'আচ্ছা, অবন! পৃথিবীটা সত্যিই অনেক সুন্দর, তাইনা? এমন স্নিগ্ধতা ছেড়ে তুমি কেনো চলে যেতে চাচ্ছো !'
'হুম! অনেক সুন্দর, পৃথিবী তখনই মায়াময় যদি এই গ্রহে মানুষের জন্য ভালোবাসার কেউ থাকে.........! যেটা আমার নাই। জীবন এবং পৃথিবী দু'টোই এখন আমার জন্য বিরক্তির নাম।'
'অবন! তুমি তো এমন রসিকতা করতা না আগে। পৃথিবীতে তোমার ভালোবাসার মানুষের অভাব পড়ে গেছে, এমন কথাও শুনতে হলো! আমাকে একবার বলতা। আমি তোমাকে ভালোবাসবো, এতো ভালোবাসবো যে তুমি কয়েক জনম বাঁচতে চাইবা। এই ইট কাঠের নির্মম শহরে তোমার আমার ছোট্ট একটা লাল-নীল সংসার হবে, যেখানে আর যাইহোক সবকিছুর অভাব থাকলেও ভালোবাসার কমতি হবে না।'
'ফাজলামি করো না তো, শাকিল! তুমি ভালো করেই জানো আমার বাবা আর্মি অফিসার (রিটায়ার্ড), এক ভাই পিজির ডাক্তার আরেক ভাই পাইলট। এর মাঝে গাধা হইছি আমি। আমাকে গাধা থেকে মানুষ করার জন্য বাবা পাঠালেন লন্ডন। সেখানে গিয়ে টানা তিন সেমিস্টার করলাম ফেল। সেটা করারই কথা। তুমিই বলো সবাইকে দিয়ে কী সব কিছু হয়?
আমি ভালোবাসতাম ম্যাথম্যাটিকস, ভাবতাম আব্দুল্লাহ আবু সাঈদের মতো আমি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের আদলে একটা অংক সমাধান কেন্দ্র দিবো। সেখানে এ দেশের ছেলে-মেয়েরা কঠিন কঠিন অংকের সমাধান করে যাবে। কিন্তু, কিছুই তো হলো না......।'
'দেশে ফিরে বাবা-মা, ভাই-ভাবী, আত্মীয়-স্বজন, পারিপ্বার্শিকের খোঁটা, কটু কথা শুনতে শুনতেই অতিষ্ঠ প্রাণ। আজ আমি নিজেকে আর রাখবোই না।'
বেলদী বাজার থেকে আবার কাঞ্চন ব্রিজ রিক্সায় চলে আসলাম। অবনী চুপচাপ, বাকরখনির বিষয়েও আর কিছু বলছে না। আমিও চুপচাপ। কাঞ্চন ব্রিজের উপর থেকে বিশ্বরোডগামী একটা প্রাইভেট কারে শুধু দু'জনেই উঠলাম। মস্তুল ব্রিজ পার হবো, গাড়ি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলো..........!
চোখ বাধা অবস্থায় নয়, হাত উপরে তুলে কোনো ঝামেলা ছাড়াই সানগ্লাস জমশেদের সাঙ্গপাঙ্গরা আমাদের তুলে নিয়ে আসলো পশ্চিম ধানমন্ডীর একটি ফ্ল্যাটে। গাড়িতেই ফিসফিসানিতে জানতে পারলাম এরা কোনো এক সানগ্লাস জমশেদের লোকবল।
আমি এমনিতেই ভীতু ছেলে, চুপ থাকা আমার সমুচিত হলেও অবনীর মতো শক্ত মেয়েও এই পরিস্থিতিতে নীরব হয়ে গেছে। আমি ভাবছি কোনো এক গো-ডাউন টাইপের পরিত্যক্ত বাড়িতে কোথায় এরা আমাদের নিয়ে যাবে তা নয়। ছিমছাম সুন্দর এই ফ্ল্যাটেরই বাইরের দিকে এক রুমে যার সামনে ছোট্ট একটি টেবিলে (মাথার উপর কোনো সাদা লাইট নাই) অবনী আর আমাকে বসানো হলো, এই রাতে সানগ্লাস চোখে যে লোকটা বসে আছে নামের সাথে তার ভালোই যাচ্ছে।
অবনীর শক্ত শক্ত কথা উবে গেছে, হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠলো..... 'সানগ্লাস জমশেদ ভাই, আমাকে মেরে ফেলেন, প্লিজ, প্লিজ.....! আমি মরতেই চাই কিন্তু ওকে (আমাকে) ছেড়ে দেন। ওর কেউ নাই।'
এবার আমিও গলায় স্বর পেয়ে গেলাম, 'না জমশেদ ভাই, আপনি আমাকে মেরে কেঁটে নদীতে ফেলেন, ওকে (অবনী) বাসায় পৌঁছে দেন।'
সানগ্লাস জমশেদের চোখ ঢাকা, তার অভিব্যক্তি বোঝা যাচ্ছেনা। কিন্তু এবার সে টেবিলে জোড়ে ডান হাত দিয়ে চাপড় দিয়ে ভিলেনের মতো হুংকার দিলো, একদম চুপ.........!' চিনচিনে গলা, ভালো ঝমিয়ে উঠলো না। তাতেই অবনী ভয়ে ঘাবড়ে গেলো। আমি কি তোদের এখানে নাটক করতে নিয়ে এসেছি। আমার টাকা চাই।' এই মেয়ে তোমার বাবারে ফোন লাগাও। জামাইসহ ধরছি, দশ লাখের কম না। এই তুইও (আমাকে)।'
অবনী আবার বলতে লাগলো জমশেদ ভাই, 'আমি মরলে আমার বাবার কিছুই যায় আসবে না। এক পয়সাও পাবেন না। আমিতো আমার বাবাকে চিনি, আমার প্রতি তার কোনো দয়ামায়াই নাই। ভুল মানুষদের তুলে নিয়ে এসেছেন। আপনি আমারে মেরেই ফেলেন। কিন্তু ওকে ছেড়ে দেন, ওর বাবার কোনো টাকাপয়সা নাই। প্লিজ.....!'
অবনী আমার সাথে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বললে কী হবে তার মুঠোফোনই নাই কিন্তু সানগ্লাস জমশেদের বলায় এবার এমন কিছু ছিলো যে তার ছোট ব্যাগটা থেকে সুন্দর করেই ফোনটা বের করে দিলো। 'তোমার বাবার ফোন নাম্বারটায় ডায়াল করো.....!'
আমি একটা বিষয় খেয়াল করছি, সানগ্লাস জমশেদ হয়তো ভেবেই রেখেছে আমার কাছ থেকে টাকাপয়সা পাওয়া যাবে না। এ কারণে কিনা আমার সাথে কথা বলতে বলছে তুই, কিন্তু অবনীকে তুমি।
অবনী ওর বাবার নাম্বারটা দেখিয়ে দিলেও ডায়াল করলো না। সানগ্লাস জমশেদ মনে হয় এমেচার গুন্ডা। আমাদের সামনে অবনীর বাবাকে ফোনে হুমকি দিতেও লজ্জা পাচ্ছে। ফোনটা নিয়ে সে চলে গেলো পাশের রুমে কথা বলতে।
অবনী এখন স্বাভাবিক। আইপ্যাড বের করে গান শুনছে, আমরা যে অবরুদ্ধ এটা যেনো তার মনেই নাই। রাত এখন ১০ টা ৪৪ মিনিট, প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে। আমি বিরিয়ানির এক প্যাকেট খুলে খেতে লাগলাম, আমার দেখাদেখি অবনীও। মেয়েটা যে প্রচন্ড ক্ষুধার্ত তার খাবার দৃশ্য দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ভাবলাম তার শেষ খাবার বাকরখনির জন্য খোঁচাটা দেই। কিন্তু তার তৃপ্ত মুখাবয়ব দেখে সংযত হলাম।
বিরিয়ানির সাথে সানগ্লাস জমশেদ কিছু মিশিয়ে দিয়েছিলো কিনা জানিনা, খাওয়ার কিছুক্ষণ পর পৃথিবীর খবর আর বলতে পারিনা। চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আর যখন খুললো তখন ভোর সাড়ে ছ'টা...............।
এ কেমন কিডন্যাপড, বুঝলাম না !
দরজা খোলা আমি বের হলাম। পুরো ফ্ল্যাট নিস্তব্ধ। আমি সত্যিই ভয় পাই নাই। পরিষ্কার হয়ে বারান্দায় এলাম। ভাবলাম আজ সকালটাকে দেখি। এখনো রোদ উঠেনি। বাইরে শীতের কুয়াশা। যেনো গ্লুকোজের মতো জমাট বেঁধে আছে। চারধারে মোলায়েম ছায়া ছড়ানো। কিছুক্ষণেই কুয়াশা দূর হয়ে বিশাল আকাশের দেখা মিললো।
বারান্দার রেলিং দিয়ে আকাশের দিকে তাকাতেই অদ্ভুত শিহরন জাগল দূর আকাশে একটা কালো টিপ। অথচ নীলের প্রাচুর্যে তাকে অদ্ভুত ও অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে। টিপটা একটু বড় হয়ে এগিয়ে আসছে মাঝ আকাশের পথে। ওটা যে মেঘ বুঝতে পারছি। এমন দারুণ সকাল কতোদিন দেখি না।
আমি কিচেনে গেলাম। ওভেনে এক মিনিট দিয়ে সুইচ চাপলাম। ঘোঁ ঘোঁ শব্দ হচ্ছে।
অবনীর গলার স্বর....'আমরা কি মুক্ত!'
'তাই তো মনে হচ্ছে।'
'তুমি কি একাই চা গিলবে?'
'না, সেটা কি কখনো হয় !'
সকালের মিষ্টি রোদ গাঁয়ে মেখে বারান্দায় বসে আমরা চা গিলছি।
'অবনী, তোমার নিশ্চয়ই খুব তাড়া নাই। চলো ছাদ থেকে ধানমন্ডির ঢাকা কেমন একটু দেখে আসি।'
'আচ্ছা, চলো.........।'
ছাদে উঠেই আমি সোজা পানির ট্যাংকের উপরে উঠে গেলাম।
' আচ্ছা, অবন! আমি যদি আট তলার এখান থেকে লাফ দেই তাহলে কি মারা যাবো!'
'তুমি আবার ওখানে উঠতে গেলা না, নেমে আসো তাড়াতাড়ি।'
অবনীর কথায় ভ্রুক্ষেপ না করেই আমি আরও রেলিংয়ের কাছাকাছি চলে গেলাম।
'অবন! আমি ঠিক করেছি এখান থেকে লাফ দিবো। আত্মহত্যা করবো। তুমি আমার শেষ কথাটা কি মনে রাখবে !'
'কি বলছো এসব প্লিজ নেমে আসো, প্লিজ! আমার খুব ভয় করছে।'
'না, তোমার কোনো কথাই শোনার সময় এখন আর নাই। আমি বলবো তুমি শুনবে। এখান থেকে নামতে পারি একটা শর্তে।'
'শর্ত, সেটা আবার কি! তুমি যা বলবে আমি তাই শুনবো। প্লিজ নেমে আসো।'
'তুমি যদি ভুলেও আর আত্মহত্যা করার চিন্তা না করো এই মর্মে আমাকে কথা দিতে হবে। ওয়াদা করতে হবে।'
'আমি আমার মাথায় হাত রেখে কথা দিলাম। আমি ভুলেও আর আত্মহত্যার চিন্তা তো দূরের কথা ঐ শব্দটাও উচ্চারণ করবো না। তুমি নামো প্লিজ, প্লিজ....!'
আমিতো আর যাইহোক কিছুদিন তোমাকে চিনেছি। তাই জমশেদ ভাইকে দিয়ে এই নাটকটা করা। নৌকোয় থাকতে প্রথমে মেসেজ তারপর নেমে অটোর কাছাকাছি আসতে আরেকবার ফোন দিয়েই এই ঘটনা। ভাগ্যিস ঐ পথেই তার তিন'টে গাড়ি চলে। আরেকটা কথা কি জানো, অবনী। তুমি যে তোমার বাবাকে বলছো তোমার প্রতি তার কোনো দয়া-মায়া, ভালোবাসা নাই। এটা পুরোই ভুল। কাল রাতে যখন জমশেদ ভাই তোমার বাবাকে ফোন দিয়েছিল, 'তিনি তাকে বলেছিলেন....'দশ লাখ নয়, বিশ লাখ নয় পুরো পঞ্চাশ লাখ কিংবা তারও বেশি টাকা তিনি দিবেন, দিতে রাজি আছেন কিন্তু তার মেয়ের যেনো কিছু না হয়।'
'অবন, আমার বয়স যখন চার তখন বাবা মারা যায়, আ'টে মা। বাবা-মা'র ভালোবাসা কেমন জানিনা। বড় হচ্ছিলাম দাদির কাছে, তারপর ঢাকায় তো বড়ফুফুর বাসায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স শেষ হওয়ার তিন বছর হয়ে গেলো। সোনালী সন্ধ্যার দিনগুলি শেষ হয়েছে সেই কবেই। এখনও একটা চাকরি নাই।
বন্ধু-বান্ধবরা কতো কি হয়ে গেলো অথচ আমি এখনও স্যান্ডেল পায়ে হাঁটতেই তা ক্ষয় করে ফেলছি, জীবনের মানে খুঁজছি। আত্মহত্যা করার যথেষ্ট কারণ, তোমার চেয়ে আমার অনেক বেশি। তবুও, কি জানো, এই গর্হিত কাজ করার সাহস এবং ইচ্ছা কোনোটাই আমার নাই।
জীবন এবং পৃথিবীর প্রতি আমার কোনো অভিমান নাই। আমি আমার আবেগে তবুও কেনো জানি নিশ্চিন্তে চলছি, 'বেকারত্বের দিনগুলিতে অবনীর সাথে প্রেম' বলে আমার জীবনের গল্পের চিত্রনাট্য লিখে যাচ্ছি। আমি জানি সেটা একদিন প্রকাশ পাবেই। যাক গিয়ে, তোমার এখন বাসায় যাওয়া উচিত আমি নিজেই রেখে আসছি।'
বলেই আমি সমতল ছাদে লাফিয়ে নামলাম। অবন কাঁদছে। হঠাৎ দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঢুকরিয়ে কেঁদে উঠলো......'তুমি না আমাকে ভালোবাসতে/ বাসো, এই অবেলায় সাথে নিবে আমাকে অনেক দূরে.......! আমি তবুও মুক্তি চাই।'
ক্রন্দনরত অবনীকে আমি সেদিন মধ্যদুপুরে ওর বাসায় রেখে আসি।
আর, তার ঠিক তিন দিন পর আরেক ভর দুপুরে আমি বহু আকাঙ্ক্ষিত চিঠিটি পাই, তারা আমাকে ডেকেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদের পাশে একটি ছোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে।
সেই বিকেলে আমি অসম সাহসে অবনীদের বাসায় যাই, তার বাবাকে বলি, 'কেনো তার মেয়েকে আমার সারাজীবনের জন্য লাগবে।' অবনীর রাসভারী কর্ণেল বাবা, না করতে পারে নাই।
অবনীকে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা আচমকা আমার হাতের মুঠোয়। পরের সময়টা আমাদের অনেক ভালোবাসার, ভালো থাকার। অবন এখন আমার স্কুলেই ছোট ছেলে-মেয়েদের শৈল্পিকভাবে অংক শিখায়।
জীবনের একঘেয়ে কান্নার সুরের মতো সে শব্দ এখন আর নাই, বাকি সময়টুকু আমাদের আট মাসের স্বর্গীয় ফুটফটে আদুরে ক্ণ্যা মৃত্তিকার সাথে সমান্তরালে বয়ে যাচ্ছে। যেমন করে আজ আগামীকাল হয়, কাল জীবনের অন্তিমে চলে যায়। তবে, এমনই করে যাক না ; একটাই জীবন। যে জীবনে অনেক প্রজাপতি উড়বে, মেঘ ভাঙ্গা রোদ ঝড়ে পড়বে আঙ্গিনায়, নদী বয়ে যাবে গর্বিত হয়ে অবন আমার ভালোবাসার নীল মেঘে। অবনী, তোমাকে ভালোবাসি হৃদয় নিংড়ে উচ্চারণ করেছি নীরবে সহস্রবার............।
পিডিএসও/রিহাব