রাতুল হাসান

  ০৩ আগস্ট, ২০১৮

গল্প

অদৃশ্যের ছোঁয়া

রিমঝিম বৃষ্টির টাপুরটুপুর ধ্বনি প্রিয়ার পায়ের নূপুরের মতো ঝনঝন করছে। সন্ধ্যা নামতেই পশ্চিম আকাশে ঈষৎ গাঢ় অন্ধকার হয়ে গেলো। চারিদিক ধু ধু কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার। টিনের চাল বৃষ্টির টাপুরটুপুর শব্দে মুখরিত হয়ে উঠলো। মনটা খুব বিষন্ন। মেঘের বজ্রধ্বনিতে মনটা আরো বেশি খারাপ হয়ে গেলো। এমনাবস্থায় বিথীর ফোন পেয়ে আনন্দে মুখমন্ডল চাকচিক্যময় হয়ে উঠলো। কয়েকবছর ধরে অভিমানী মেয়েটি আমার প্রতি বিষন্ন ছিলো।

ছোটখাট বিষয় নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকতো। তবে সেই দিনের ঝগড়াটা ছিলো মাত্রাধিক। সেদিন মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছিলো দুজনের ভিতর। বিথী সেদিন আমাকে বলেছিলো আমি যেনো তার সাথে কোনও যোগাযোগ না রাখি। ক্ষোভে দুঃখে তার মুখের আভা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছিলো। মুখ থেকে যেন অগ্নি স্ফুলিংগ বের হচ্ছিলো। ভাষাগুলো ছিলো অসংযত। আসলে সে এতটা ক্ষেপেছিলো আমার উপর আমি বুঝতে পারিনি। প্রতিদিনের মতো আজকে তার ক্রোধ দেখে মনে মনে হাসছিলাম। কিন্তু তার হৃদয় আঘাত করা অমৃত বাক্যগুলো আমাকে ক্ষত বিক্ষত করতে শুরু করলো। আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। আমার কাছে মনে হলো ধর্যের সীমা অতিক্রম করছে সে। তপ্ত ব্যথাগুলো অনুভব করে আমি তাকে প্রহার করেছিলাম সেদিন। কিন্তু আমারই ভূল ছিলো; কোন অধিকারে তাকে প্রহার করেছিলাম! এ বিষয়টি এখনো আমার কাছে অস্পষ্ট।

হ্যাঁ, আমি তাকে ভালোবাসতাম। কিন্তু তার মানে, তাকে শাষন করার অধিকার কে দিলো আমাকে? নিজেকে বড় স্বার্থপর মনে হলে। ধিক, শত...ধিক!

তাছাড়া ভূলটাও তো আমারই ছিলো। বিথীর তো কোনও দোষই নেই এখানে।ও আমাকে অনেক ভালোবাসতো। শুধু কি তায়? ওর কাছে আমি ছিলাম দেবতূল্য। সে জন্য ও কোনও দিন মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলোনা যে ও ছাড়া আমি অন্য কারোর জীবনসহচরী হবো। কিন্তু এমনটা কখনোই হয়নি; ওর অতিমাত্রা ভালোবাসা ভ্রমে পরিণত হয়েছিলো। ভুলটা ছিলো এখানে।

এতটা দিন পার হয়ে গেলো। বেচারা ভুল বুঝতে পারলো। স্তব্ধ কন্ঠ; ফোন করলো বিথী। সে কথা না বললেও তার স্তব্ধতা, নীরবতা, আমার কাছে তো খুবই পরিচ্ছন্ন, স্বচ্ছ কাচের মতো।

ওপার থেকে অতি পরিচিতি কন্ঠ ভেসে এলো। মূহুর্তে আমার মানসপটে তার চিত্রণ ভেসে উঠলো। লম্বা গড়নে দেহ, কালো উপল, কোমর পর্যন্ত বিস্তৃতি। ডাগরআঁখি আর হরিণীর মত অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা স্নিগ্ধতায় ভরপুর। কোমল হাতে হাত রেখে বেলী ফুলের সুভাষ যতটা না মুগ্ধতা বয়ে আনে; দূর থেকে তার স্তব্ধতা যেন আমাকে সম্মোহিত করেছে তার মুক্তঝরা ক্ন্ঠনালী থেকে বেশি বৈ-কি।

দুই

গভীর রাতে হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। প্রশান্ত ঘুমটা ভেঙে গেলো। বিরক্তিভরে ফোনের স্কিনের আলোর দিকে তাকাতেই বিথীর নাম্বার ভেসে উঠলো। গভীর রাত জেগে ফোনে কথা বলার অভ্যাস না থাকায় একটু বিরক্তি হয়ে ফোনটা কেটে দিলাম। ফোন সাইলেন্ট করে আবারও ঘুমের মধ্য মজে যাবার বৃথা চেষ্টা। শত চেষ্টা করেও দু চোখের পাতা এক করতে পারলাম না।

মানসপটে বিথীর মায়বী আভা আমাকে স্পর্শ করছে বরংবার। হৃদয়ের স্পন্দন তড়িত গতিতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। নির্ঘুম চোখ নিয়ে জানালার দিকে তাকাতেই এক গুচ্ছ চাঁদের রশ্মি চোখে পড়লো। চাঁদের মায়াবী কিরণ আমার দু’চোখে স্পর্শ করতেই সমস্ত চোখ জুড়ে ঝলমল হয়ে উঠলো। সমস্ত অলসতা, অসাড়তা ও ঝিমানো ভাব চাঁদের আলোয় হারিয়ে গেছে। আমার অস্থি তখনো মিশে আছে চাঁদের কোমল মায়াতে। পৃথিবীর এমন কোন মানুষ নেয়, চাঁদের সোনালি কিরণ যাকে মুগ্ধ করেনা। খিটখিটে ও রসিকহীন প্রেমিক ও তার প্রেমিকার জন্যে ও চাঁদের লাবণ্যতা এক অস্থিগ্রন্থিতে মিশে একাকার হয়ে যায়। রাজ্যের সমস্ত ক্লান্তি যেন চাঁদের মনোরম শোভিত আলোয় বিলীন হয়ে যায়।

সকলের চোখের পরশ বুলিয়ে গভীর রাতে একাকি ছাদে উঠলাম। অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছিল দূরদেশের উপগ্রহটিকে। এমন সময় দ্বিতীয় বারের মত বিথীর ফোন আসলো।স্কিনে তাকাতেই তার মায়বী রুপ যেন চাঁদের মত ঝলমল হয়ে উঠলো। আমি তার ফোন রিসিভ করার বাতিক যেন ভুলে গেলাম। একের পর এক ফোনের রিংটোন বেজে চলছে, অথচ কোনও ভ্রক্ষেপ নেই সেদিকে। আমি তখন তীব্র ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। চাঁদ আর বিথীর একাকীত্বে মিশে যাবার। দুজনের রূপ যেন আমার হৃদয়পটে একই আত্মার বন্ধন মনে হলে।আমি দিশা হারিয়ে ফেললাম। বেশ কিছুক্ষণ নিরব দৃষ্টিতে এভাবে লুকিয়ে থাকলাম রাজ্যের সমস্ত যান্ত্রিক জীবন থেকে। আমার তখন মনে হতে থাকলো বিথীকে নিয়ে চাঁদের আত্মার সাথে মিশে যেতে। ভূলে যায় সমস্ত দূরত্ব। কিছুক্ষণের জন্য হলেও দুজন দুজনকে অলিঙ্গন করে তাকিয়ে থাকি নীল আকাশপ্রান্তে রংধনুর সাত রঙের দিকে।

ভাবতে ভাবতে হাঠাৎ একটি "এস এম এস" আসলো। আমি ভেবেছিলাম সে খুব বিরক্ত হবে। কিন্তু ততটা গুরুত্ব দিই নি তার অসহ্য কে।সে ও হয়তো ভেবে আছে আমি তার উপর অসম্ভব রকম অভিমান করে আছি। সে জন্য আমার অভিমান ভাঙার এত প্রচেষ্টা। ম্যাসেজ চেক করে দেখলাম- অভিমান কষ্টকে তীব্র করে, সে কষ্ট শুধু কি একজনকে দহন করে আমার কি একটুও কষ্ট হচ্ছে না ভেবেছো। ঠোঁটের কোনে এক টুকরো মিছকি হাসি বয়ে গেলো।ভাবলাম সে অসম্ভব রকম কষ্ট পাচ্ছে, হতে পারে দহন হচ্ছে নিউরিনের প্রতিটি সেল; বিস্ফোরিত হচ্ছে স্নায়ুকোষ। ফোন পকেটে রেখে বেশ কিছুক্ষণ ভাবছিলাম কি করা যায়। ওদিকে চাঁদের তেজস্ক্রিয়া বেড়ে চলছে চারদিক, যেন আলোক-রশ্মির মেলা। দু একটা প্রেমিক পাখি ও তখন জেগে আছে। পাখিগুলোর কিচিরমিচির শব্দ আমার কাছে অপরিচিত মনে হচ্ছিলো। ভাবলাম এরা গভীর রাতেই প্রেমিকদের পাহারায় নিয়োজিত থাকে। তাহলে তো তাদের কে নাম দেওয়া যায় প্রেমি পাখি। আজ থেকে এ পাখিকে প্রেমি পাখি বলেই ডাকবো। যদিও পাখিগুলো দেখতে পাচ্ছিনা। দেখলে হয়তো পছন্দ না হতেও পারে। অনেক পাখি আছে যেগুলোর ডাক খুব মিষ্টি দেখতে আবার কন্ঠ থেকে ব্যতিক্রম।

বিথীকে ও বিষয়টা জানানো দরকার যে গভীর রাতে একটি পাখি ডাকে বলোতো পাখিটির নাম কি?

ও হয়তোবা বিরক্ত হবে। কেননা দীর্ঘদিন অভিমান করে আছে। সে হয়তো ভেবে বসে আছে আমি ফোন দিয়ে তাকে অভিমান ভূলে যাবার কথা বলবো বা তাকে আকস্মিক শিহরীত হয়ে উঠা শব্দগচ্ছ ইংরেজিতে বলবো "I love you, Moni" সে হয়তো একথাটি শুনবে বলে অপেক্ষা করেছে। মনি নামটা তার আবার খুব প্রিয়। সে যখন খুব রেগে থাকে বা কখনও যদি মায়ের সাথে রাগ করে তার পরবর্তিতে তাকে মনি বলে ডাকলে নাকি তার সমস্ত আকাশ মেঘ হয়ে এক পশলা বৃষ্টি ঝরে তার চোখে। তারপর আবেগময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। সে যখন সেবার এ কথাগুলো বলেছিলো আমি প্রচন্ড হেসেছিলাম। হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হওয়ার উপক্রম। আমার হাসি শুনে সে ভীষণ লজ্জা পেয়েছিলো। হয়তোবা লজ্জায় মুখটা লালও হয়েছিলো,কে জানে!

সে হয়তো ভেবে আছে আমি তাকে মনি বলে ডাকবো। নাহ! মনি বলে ডাকলে এই গভীর রাতে যদি ক্রন্দন করে আবেগের বশবর্তী হয়ে যদি জোরে শব্দ করে কাঁদে। সে তো কাঁদতেও পারেনা, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শব্দ করে কাঁদে। গভীর রাতে তার কান্না কে থামাবে?

ঐদিকে বিথীর মা-বাবা আমার উপর ভীষণ রগচটা। মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনে নিশ্চয়ই বুঝবে আমি তার সাথে কথা বলছি। কারণ বিথী আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে ওর মা-বাবা এটা জানে। পাগলি মেয়েটি একবার নাকি আমার জন্য মরতেও বসেছিলো।

মেয়েটি খুব সহজ সরল, যদিও একটু ঝগড়াটি। তার ফ্যামিলির শিক্ষা কিছুটা হলে ও তার উপর প্রভাব পড়েছে।

না! তাহলে অন্য কিছু বলবো না। আমি তাকে প্রেমি পাখির নাম আবিষ্কারে গল্প শুনাবো। সে যদি বিরক্ত হয় আমি তাকে বুঝিয়ে বলবো। বলবো প্রেমি পাখি তোমার আর আমার কথাগুলো এই গভীর রাতে ষড়যন্ত্রের জাল যেন বিস্তার না করতে পারে তাই তারা কিচিরমিচির শব্দ করে। কথায় আছে দেয়ালের ও কান আছে। তুমি হয়তো বুঝবে, কারণ তুমি বলতে আমি নাকি খুব সুন্দর করে বুঝাতে পারি। এলোমেলো শব্দগুচ্ছো নাকি অনেক গোছালোভাবে বাক্যে পরিণত করি। যদি ও ব্যাকারণের জ্ঞান আমার সীমিত। লিখতে ও ততোটা পারিনা। মাষ্টার মশাই একবার বলেছিলো আমি নাকি তিন লাইন লিখলে কমপক্ষে দশটি বানান ভূল হয়।

তুমি হয়তো আমার গল্প শুনতে শুনতে খুব বিরক্ত হবে। মনে মনে হয়তো বলবে উচ্ছিষ্ট যতসব গল্প তোমাকে শুনায়। এক সময় হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়বে। ফোনটা হাত থেকে পড়ে যাবে। তুমি হয়তো ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু তুমি যেটা শুনতে চাচ্ছো আমি হয়তো বলতে গিয়ে ও বলতে পারবো না।

তিন

মনে আছে একবার তোমার সাথে গভীর রাতে কথা হচ্ছিলো! অবশ্য সেদিন পূর্ণিমা ছিলো না। তখন অমাবস্যার রাত ছিল। খুব গভীর অন্ধকার ছিলো। তখন প্রেমি পাখি ও ডাকতো না। আমি তখন ছাদে বসে ছিলাম, তোমার সাথে কথা হচ্ছিলো। অবশ্যই তুমি সেদিন আজকের মতো বিষন্ন ছিলে না। তুমি সেদিন বেশ প্রফুল্ল ছিলে। তুমি যখন খুশি হও, তখন তোমাকে খুব চাঞ্চল্য ও প্রানবন্ত দেখায়। তোমার হাসিটাও খুব মিষ্টি। হাসলে তোমার গালে টোপ পড়ে। হাসিটা সুন্দর দেখায় অবশ্য তোমার বাম পাশের দাঁতের জন্য। বাম পাশের উপরে দাঁতের উপর দাঁত থাকায় তোমার হাসিটা খুব চমৎকার লাগে।

সেদিন তোমাকে বলেছিলাম আজ সারারাত আমার সাথে জেগে থাকতে পারবে? তুমি তখন ইতস্তত হয়ে বলেছিলে- হুমম, তুমি চাইলে সারারাত তোমার সাথে জেগে থাকবো। আমি জানতাম ঔদিন তুমি অসুস্থ ছিলে। সারাদিন পরিশ্রমের কারণে তুমি ছিলে শ্রান্ত-ক্লান্ত। সেদিন সকাল থেকে তুমি হাসপাতালে ছিলে। তোমার খালাতো বোন অসুস্থ ছিলো বলে। তোমার অন্য কোনও ভাই বোন না থাকায় তুমি মায়াকে খুব আদর করতে। সবসময় পাশে করে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। একবার মনে আছে আমরা পাশাপাশি হাঁটছিলাম। তোমার বোন আমাদের সাথে ছিলো। মায়া তখন তোমাকে বলেছিলে আমার সাথে তোমার কি সম্পর্ক? তুমি কি বলবে ভেবে লজ্জায় তোমার চেহারা লাল হয়ে গিয়েছিলো। তুমি তখন তাকে থামানোর জন্য ধমক দিয়েছিলে। মায়া তখন কেঁদে ফেলেছিলো বটে। তোমার মনে আছে আমি তখন তাকে বলেছিলাম তোমার আপু আর আমি একসময় একই আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ হবো। মায়া তখন হয়তো না বুঝেই হেসেছিলো। ও হয়তো সেদিন বুঝেনি আজ হয়তো বুঝতে পারে। আর গা-শিহরিত হয় সেদিনের ঘটনা মনে করে। আমাদের পাশাপাশি হাঁটা-হাঁটি করার দৃশ্য হয়তো আজ সে ও স্বপ্ন দেখে। কেননা আজ তাকেও যৌবনের তাড়না বাসনা চেপে ধরেছে।

তুমি সেদিন একটু মিষ্টি রাগ করেছিলে আমার উপর, কেন আমি মায়াকে এমন ভাবে বলেছিলাম! আমি তোমাকে মিথ্যা বুঝিয়েছিলাম। তুমি আমার বুঝ সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করেছিলে।

মেয়েটি আজ প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো যৌবনপ্রাপ্ত। বয়ঃসন্ধিকাল চলছে। এমন সময় অনেক শারীরিক পরিবর্তন সাধিত হয়। অবশ্য তার ক্ষেত্রে নিশ্চয় হয়েছে। যদিও সেদিনের পর থেকে তার সাথে দেখা হয়নি। তবে কয়েক বছর পর তার সাথে ফোনে কথা হয়েছিলো। আমি তোমাকে ফোন করেছিলাম। তুমি হয়তোবা জরুরি কাজে বাহিরে ছিলে। মায়া ফোন ধরেছিলো, ওর গলাটা বেশ মধুর। অবশ্য তোমার কন্ঠ ছিলো মুক্তঝরা। আমি কথা বলতেই ও সালাম দিয়ে বলেছিলো ভাইয়া কেমন আছেন? আমি নাম জিজ্ঞেস করতেই বলেছিলো আমি মায়া বলছি। মনে আছে আমার কথা, অনেক বছর আগে আপু আর আপনার সাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম। আমি একটু লজ্জিত হয়ে বলেছিলাম তোমার আপু আসলে আমার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ো। এ কথা বলেই লজ্জায় ফোনটা রেখে দিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর তুমি ফোন দিয়ে অভিমান সুরে আমাকে বলেছিলে তুমি আর মায়ার সাথে কথা বলবে না। সে এখন অনেক বড় হয়েছে। আমি সেদিন হেসেছিলাম। মাঝেমধ্যে তোমার এমন আবেগী সরলময় ভালোবাসা আমাকে না হাসিয়ে পারেনা। আমি তখন তোমাকে বুঝিয়েছিলাম তুমি বুঝেছিলে।

মেয়েটি কালোজ্বরে আক্রান্ত ছিলো। সারাদিনটায় কিনা পরিশ্রম হয়েছিলো তোমার! সব ধকল তোমাকে সহ্য করতে হয়েছিল। ক্লান্ত থাকার পরও সেদিন আমার কথা রাখতে তুমি সারারাত আমার সাথে জেগেছিলে। বলেছিলাম দূজনের মনের অতৃপ্ত কথাগুলো।

কি যে পাগলামি করেছিলাম সেদিন! পরদিন সারা সকাল ঘুমিয়ে ছিলাম। শরীর খারাপ হয়েছিলো। যদিও তোমার খোঁজ নিতে পারিনি। একদিন তুমি হাসতে হাসতে বলেছিলে সেদিনের রাতে জেগে থাকার কারণে সকালে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে। রাত জাগার কারণে সকালে ক্লাসও মিস করেছিলে। তুমি ক্লাস মিস করতেনা আমি জানতাম;

শুধু আমার জন্য করেছিলে।

এভাবে ভাবতে ভাবতে কাকডাকা ভোর হয়ে উঠলো।কিন্তু মনের ভীতর জমে থাকা হৃদয়স্পর্শী তৃপ্ত কথাগুলো তোমাকে আর বলা হলো না।

চার

বেশ কিছুদিন পর। ঠিক একইভাবে বিছানায় শুয়েছিলাম জানালার পাশে। জানালার পাশে সারি সারি গোলাপ, হাঁসনাহেনা,ও বেলী ফুল লাগানো ছিল। বাতাসে বেলী ফুলের সুরভ হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছিলো। ঘুম আসছিলো, কিন্তু চোখ টেনে টেনে জেগে থাকার চেষ্টা করছিলাম। দক্ষিনা মৃদু বাতাসে চোখে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিলো। উষ্ণ গরমে দক্ষিনা বাতাসে শরীরটা ঝিমিয়ে আসছিলো। আর তখনই তৃপ্তির সাথে শ্বাস প্রশ্বাসে হাঁসনাহেনা, বেলী ফুলের সুভাষ অন্তরকে প্রশমিত করে তুলছিলো।

বিথীদের বাড়ি ছিলো ঠিক আমার জানালার দক্ষিন পাশে কয়েকশ গজ দূরে। আমাদেরও ওদের বাড়ির মধ্যখানে শুধু একটি বড় রাস্তার ব্যবধান। আমি যে জানালার পাশে থাকতাম ঠিক সেই সোজা তাদের ও একটি জানালা ছিল। যখনই দেখা করতে মন চাইতো দূজনই জানালায় বসে একে অপরকে দেখতাম। চোখের ইশারা ইঙ্গিতে বলতাম নিজেদের সুখে থাকার গল্প। দীর্ঘদিন কথা না বলতে পারার অস্পষ্ট বেদনা কিছুটা হলেও ঘুচতো। বিথীর সাথে আমার নিয়মিত কথা হতো। একদিন লুকিয়ে তার মা দেখে ফেলে, তখন থেকে তার মা ফোনটা নিজ যত্নে লুকিয়ে রাখতো। তখন থেকে যান্ত্রিক যন্ত্রের বৈপরিত্যে এভাবে চোখের পলকে হৃদয়ের কথাগুলো টেলিগ্রাম করে তাকে পাঠিয়ে দিতাম ঠিক একইভাবে সে ও তার বার্তাগুলো স্বযন্তে আমাকে পাঠাতো।

সেই স্মৃতিময় জানালার পাশে শুয়েছিলাম তখন। আজ অন্য দিনের মতো আমার মনটাও ছিলো বিরক্ত, বিষন্নতার অস্পষ্ট ছাপ। গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন মেঘ জমেছিলো হৃদয়ের এক কোনে; মনে হচ্ছিলো এখুনি বৃষ্টি ঝরবে। চোখের কোন দিয়ে অশ্রু বেয়ে পড়ছিলো হিম-ঝর্ণার মতো। নিজেকে কন্ট্রোল করে শান্তচিত্তে ভাবছিলাম। ভাবছিলাম এতদিনের স্মৃতিকাতর স্বপ্নগুলো।

বিথীর প্রস্থান আমার জন্য অনেক পীড়াদায়ক; বেশ যন্ত্রনারও। একথা শুনা মাত্রই আমার দেহের রক্ত মনে হচ্ছিলো হিম-শীতল হয়ে যাচ্ছে। রক্ত কনিকাগুলো অতৃপ্তে দহন হচ্ছিলো; শোষিত করছিলো আমাকে।

বিথীর পিতা-মাতার সিদ্ধান্ত মতে বিথীকে তার মামা বাড়িতে থাকতে হবে। ওখানে থেকে সে পড়াশুনা করবে। তার মামী প্রেগন্যান্ট; সে জন্য অতি শিগগির তাকে মামা বাড়ি প্রস্থান করতে হবে। তার মামা বিদেশে থাকে মামীকে দেখাশুনার জন্য অন্য কেউ নেই। বিথীর মামীর বাবা-মাও বেঁচে নেয় এ অবস্থায় বিথীই একমাত্র অবলম্বন।অবশ্য তার মা যেতে চেয়েছিলো কিন্তু বিথীর আব্বুর হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় তাকে ওখানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলো।

অপছন্দ, অবাধ্য থাকা সত্ত্বেও অনাদম্য ইচ্ছেয় তাকে সেখানে যেতে হচ্ছে। মনটা ভীষন ভেঙে পড়েছিল তার চলে যাবার প্রস্তুতি শুনে।

অবশ্যই আমাকে ও ঢাকায় চলে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম সবেমাত্র; কয়েকটা দিন পরে আমারও ক্লাস শুরু হবে। স্মৃতিগুলো হাতড়িয়ে খুঁজছিলাম জানালার পাশে শুয়ে- শুয়ে। আর অপেক্ষা করছিলাম তাকে এক পলক দেখার অধীর আগ্রহ নিয়ে।

চলে যাবার দিন এক টুকরো রেশমি কাপড়ে লেখা তোমার স্মৃতি "লাল পৃথিবীর ভালোবাসা" আমাকে উপহার দিয়েছিলে। কত সংগোপনে, দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে তোমার সাথে দেখা হয়েছিলো সেদিন; তা কল্পনা করতেই যতটা না শিহরীত হই তার থেকে বেশি মুগ্ধতায় ভরে যাই, আর হৃদয়কে প্রশান্ত করে অবলীলায়।

কত স্মৃতিময় দিন ছিল অতীত। মানসপটে সেই চিত্র লাল শাপলা ফুলের মত ভাসমান হেলে দুলে বয়ে যাচ্ছে এখনো। স্মৃতিকথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন দু-চোখের কোন দিয়ে অশ্রু গড়াতে শুরু করলো। তৃপ্তির নিঃশ্বাষ ফেলে তাকিয়ে ছিলাম জানালা দিয়ে দূর আকাশের অসংখ্য নক্ষত্রের দিকে। নক্ষত্রের মত অতি ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিলো নিজেকে; মনে হচ্ছিল ক্ষুদ্র নক্ষত্রের মত নিভু-নিভু করে জ্বলে আছি আমি।

পাঁচ

গ্রীষ্মকালে দূপুরবেলা আমি পুকুরে যাচ্ছিলাম গোসল করতে। তুমিও তখন বায়না ধরেছিলে আমার সাথে গোসল করবে। আমাদের নিজস্ব কোনও পুকুর না থাকায় পার্শ্ববর্তী নিপাদের পুকুরে গোসল করতে যেতাম। নিপাদের বাড়ি বিথীদের বাড়ির ঠিক পূর্ব পাশে ছিল। মা-বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সেদিন নিপাদের পুকুরে অনেক্ষণ গোসল করেছিলাম। কচুরিপানা আর হেলাঞ্চ গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ, কিন্তু আমাকে খুঁজে বের করতে না পেরে তুমি বিরক্ত হয়েছিলে। আমি তখন ডুব মেরে তোমার পিছনে উঠেছিলাম। তোমার চোখ চেপে ধরতেই তুমি ভয়ে চিৎকার দিয়েছিলে।

গোসল শেষে তোমার ভেজা এলোকেশ স্পর্শ করেছিলাম আমি। তোমার ভেজা রেশমি চুলের গন্ধে, তোমার অস্থির সাথে মিশেছিলাম, ডুবে ছিলাম স্নিগ্ধতায়। তুমি আলতো করে তোমার ভেজা ললাট আমাকে উৎসর্গ করেছিলে; তুমি বলেছিলে আমি যেন তোমার ললাটে-চিবুকে স্পর্শ করে তোমাকে শিহরিত করি। আকস্মিক আমি চমকে উঠলেও কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিলাম। শুধু আলতো করে মরুভুমির বিরান মাঠে চাঁদের টুকরোর মত তোমার ললাটে হৃদয় স্পর্শী চায়ের কাপের মত একটু আলতো অনুভূতি দিয়ে আমার ঠোঁট তোমার ললাট স্পর্শ করেছিলো। তুমি ঈষৎ শিহরিত হয়ে উঠেছিলে।

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
অদৃশ্য,ছোঁয়া
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist