এস আর শানু খান
ঘুরে আসুন চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের বাড়ি
মাগুরার মনোখালী এলাকা থেকে ১৭ কিলোমিটারের রাস্তা নড়াইল মেইন শহর। দশটা নাগাদ গিয়ে পৌঁছালাম নড়াইল শহরে। গাড়ি থেকে নেমে ইজি বাইকে উঠলাম। ষাট টাকা ভাড়ায় ঠিক হলো ইজিবাইক। নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের পূর্ব পাশ ও চিত্রা নদীর পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তা দিয়ে চলতে লাগলো ইজিবাইক। ইজিবাইক ওয়ালা ভাই আটরসি পীরের মুরিদ বলে মনে হলো। কেননা সারা রাস্তা বাইকের বক্সে আটরসির মাথা কুটা গান চালিয়েছেন। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে ইজিবাইকটা গিয়ে থামলো এস এম সুলতান সাহেবের বাড়ির সামনে। ইজিবাইক থেকে নেমে ভাড়া মেটাতে মেটাতেই সনত শুনালো ওর হিসিু চেপেছে। দৌড়ে গিয়ে কোথায় যেন সেরে আসলো। চার পাচ মিনিট দাঁড়াতে হলো সনতের জন্য। সবাই এক সাথে গিয়ে সুলতান সাহেবের বাড়ির গেটে গিয়ে দাঁড়ালাম। গেটের বাম পাশে একটা স্বাক্ষর ঘর। অভিজিত গিয়ে ওখানে স্বাক্ষর করে নাম ঠিকানা ও পেশার কথা লিখলো। ভিতরে ঢুকে পড়লাম। ততক্ষণে ভিতরে মানুষে মানুষে ভরে গেছে। সুলতান সাহেবের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সবাই ব্যস্ত ছবি আর সেলফি তোলায়। তখনি চোখে পড়লো সুন্দর করে লেখা ”দয়া করে কেউ সমাধিতে জুতা বা স্যান্ডেল পড়ে উঠবেন না”।
সমাধিতে সাদা একটা টাইলসের উপর কালো বর্ণে খোদায় করে বাংলা ও ইংরেজিতে লিখা,
জন্ম : ১০ আগষ্ট ১৯২৪। ২৬ শ্রাবণ ১৩৩১
গেট দিয়ে ঢুকেই দুই পাশে নানান রকমের ফুলগাছের সমারোহ। রঙ্গিন রঙ্গিন সব গাছ। একটু এগিয়ে ডানপাশে একটা ঘর। চাররুম বিশিষ্ট। একটা রুমে বড় পালঙ্ক পাতা রয়েছে। লেখা রয়েছে এস এম সুলতান এটাই ঘুমোতেন। পাশের রুমে রাখা বড়, ছোট,মাঝারি আকারের কয়েকটা নোঙ্গর। কোনটি কাচের ভিতর রাখা আবার কোনটি পলিথিনের ভিতরে রাখা। একই রুমে আরও দেখলাম একটা কোদাল, কুরাল, দা কাঁচি জাতীয় আরও কিছু দৈনন্দিন জিনিসপত্র। আর একটা রুমে আলমারি পাতা, সেখানে রয়েছে অনেকগুলো বই। দুর থেকে ভালো দেখা যায় না। তবে একটা বইর কভার পেজ দেখে মনে হল ”দি হানড্রেড” মানে পৃথীবির শ্রেষ্ঠ একশো মুনিষীর জীবনি। এই ঘরটার উত্তর পাশেই সুলতানের সমাধি। এখানেই চিরশায়িত দেশ বরণ্যে চিত্র শিল্পী এস এম সুলতান। ওখান থেকে সোজা পূর্ব দিকে একটু এগিয়ে দেখি আর একটা তালাবদ্ধ গেট। উঁকি মেরে দেখি নদী। সুলতানের চিত্রা নদী। বাম পাশের একটা গাছ দেখে আশ্চার্যহয়ে গেলাম। মেহগনি গাছের মত একটা গাছ কিন্তু গাছের শরীর ফুটে ফুটে একদম গোল বলের মত বড় বড় ফল বের হয়েছে। দেখতে অনেকটা খোসা এড়ানো নারকেলের মত লাগছে। দারুণ লাগলো গাছটা। গাছটার নাম জানার জন্য খুব চেষ্টা করলাম। কিন্তু কেউ বলতে পারলো না। দেখলাম একটা কামরাঙ্গা গাছ। কামরাঙ্গা পড়ে পড়ে তলা ভরেছে। গাছেও ঝটলা বেধে বেধে ধরে আছে কামরাঙ্গা।
একটু দক্ষিণেই বড় দুইতলা বিশিষ্ট ভবন। সিঁড়ির সামনেই দাড়িয়ে আছেন এক যুবক চাচা। যুবক চাচা বললাম এই জন্য যে চাচার বয়স অনেক হলেও ভাবভঙ্গি একদম ২২ বছরের যুবকের মত। চোখে কালো সানগ্লাস। পোশাকে আশাকে এক্কেবারে ইয়াং। আমরা গেলেই উনি জানালো আর ভিতরে ঢুকা যাবে না। শুনেতো আমাদের সবার চোখ কপালে উঠলো। আমি বললাম, চাচা আমরা অনেক দুর থেকে আসছি। সেই মাগুরা থেকে আসছি। চাচা অসংখ্যবার মাথা নাড়িয়ে বললেন, না না না ভিতরে অনেক কাজ। চোখে পড়লো একটা লিফলেট এ লেখা- সুলতান গ্যালারি সকাল দশটা থেকে দুপুর একটা পযন্ত, ও বিকাল ২ টা থেকে ৪ টা পযন্ত। তখন ১২টা বাজে। আমি বললাম চাচা এখনও এক ঘন্টা বাকি। উনি চেতে গিয়ে বললেন আমি বলছি এখনই বন্ধ হবে। বন্ধু অভিজিত খুব চালাক। মানুষকে প্রথমে পটাতে চেষ্টা করে। পাম পট্রি দিতে পারে খুব। গাজাখুরী গল্প দিতে ওকে আমরা ওস্তাদ মানি। ও গিয়ে চাচাকে হাত করতে চেষ্টা করলো। চাচার চশমার প্রশংসা করে আমার ক্যামেরায় ছবি তুললো চাচার সাথে। কিন্তু তাতেও চাচা কেমন যেন নরম হলেন না। অভিজিত হাত দিয়ে ইশারা মারলো আমাদের ঢুকে পড়তে। আমরা সেকেন্ডর মধ্যে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। দৌড়ে উঠে গেলাম দুই তলায়। অপূর্ব সেলিম সনতকে বললাম আগে দুই তলা ঘুরে আসি তার পর ফেরার পথে জোর করে হলেও নিচের তলার গ্যালারিতে ঢুকবো। দুইতলার বড় গ্যালারিতে প্রায় ৩২টার মত ছোট বড় আকৃতির ছবি। সুলতান তার প্রতিটি ছবিতে তুলে ধরেছেন গ্রামীন জীবনের নানান চিত্র। নানান স্মৃতি। তার প্রতিটি ছবির সাথে মিশে রয়েছে গ্রাম বাংলার কৃষক ও সাধারণ জনতার জয়গান। পেশী বহুল কৃষকের দেহ। সুঠাম লাবণ্যতা আর পূর্নযৌবনে ভরপুর গ্রাম বাংলার মহিলাদের ছবি। কখনও পুরুষেরা মাঠে পোলো ঝাঁপিয়ে মাছ ধরতে যাচ্ছে। কোনটাই মাছ ধরছেন। কোনটাই বর্ষা ছুড়ছেন। কোনটাই আবার মাঝি নদী দিয়ে নৌকা বেয়ে বেড়াচ্ছেন। মহিলারা কলসি কাখে নদীর ঘাট থেকে পানি আনছেন। এমন সব বাস্তবিক বাংলার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠেছে শিল্পীর তুলিতে।
আর ও দেখলাম শুধু ঘর, গাছগাছালি, পাখি, নদীর ছবিও এঁকেছিলেন এ মহান ব্যাক্তিত্ব। তিনি যে আসলে কতটা প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেন সেটা তার চিত্রকর্মই প্রমাণ করে। তিনি যে কত বড় খামখেয়ালীপনার মানুষ ছিলেন সেটা বোঝা যায় তার কিছু ছবি দেখলে ছবি নষ্ট হয়েছে। বাস্তবিক জীবনে তিনি ছিলেন অন্যতম খামখেয়ালীপনায় ভরপুর। নিজের প্রতি ছিলেন উদাসীন। খানিক বাদেই দেখি সেই কালো চশমা চাচা উপর তলায় হাজির হয়েছেন। সবাইকে বের করে দিলেন। সবার আগে আমরা নেমে পড়লাম। আমাদের মধ্য থেকে আমিই আগে নামলাম এবং নিচের তলায় ঢুকে পড়লাম। অভিজিত সেই চাচার সাথে আরামছে তর্কাতর্কি করছিলেন। নিচের তলায় ঢুকে দেখলাম আরও কিছু অসাধারণ চিত্রকর্ম। নিচের তলার গ্যালারির ঠিক মাঝ বরাবর একটা কাচের বাক্স। সেটার ভিতরে রাখা অনেকগুলো তুলি। যেগুলো দিয়ে শিল্পী ছবি আকঁতেন। এস এম সুলতান তেল রং আর জল রং দিয়ে জটের ক্যানভাসে ছবি আঁকেতন।
কাচের ভিতর দেখলাম একটা হারমোনিয়াম, একটা ভাঙ্গা তবলা, কিছু পুরষ্কারের স্বারক, একটা হাতির ডল, একটা বাঘের পুতুল। কিছু ছোট ছোট ছুরি বাটাল, উহো, আরও অনেক কিছু।
দেয়ালে কাঁচ দিয়ে সেলফ বানানো। সেখানে রাখা আছে এস এম সুলতানে ব্যবহারের একটা শালের চাদর, একটা গাম্পার, তার নিচে কিছু স্বারক স্মৃতি। কিছু সাদা কাগজ ও কিছু লেখা কাগজ। একটা নুরানী বঙ্গানুবাদ পবিত্র কোরআন শরীফ।
ওখান থেকে বের হতেই চোখে পড়লো বারান্দায় টানানো একটা কাঠের তৈরি ব্যানার। সেখানে সুলতান পদক প্রাপ্ত শিল্পীদের নাম লেখা। পদক প্রাপ্ত শিল্পীদের সংখ্যা ১৫ জন। ২০০১ সাল থেকে এটার প্রচলন হয়েছে। ২০০১ সালে এস এম সুলতান পদক পেয়েছেন অধ্যাপক কাইউম চৌধুরী ও ২০১৫ সালে পেয়েছেন চিত্র শিল্পী আবদুল মান্নান।
বের হয়ে কিছু সময় ঘুরাঘুরি করে ছবি তুলতে লাগলাম। বন্ধু অভিজিত খুব ছবি পাগল। ছবি তুলতে খুব পছন্দ করেন। কিছু সময় কাটানোর পর সেলিম বলল, নৌকা দেখতে যেতে হবে সুলতানের নৌকা।
বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রাচীরের পাশ দিয়ে রাস্তা ধরে গেলাম নদীর পাড়ে। নদীর উপরে বড় একটা টিনের ঘর পাকা করে সংরক্ষণ করা রয়েছে বড় একটা ট্রলারের মত নৌকা। নৌকার উপরে ঘরের মত ঢাকা ঘেরা। বসবার জন্য রয়েছে অনেকগুলো বেঞ্চ জাতীয় কিছু। নৌকাটা দেখলেই বোঝা যায় শিল্পীর শখের কথা। বিলাসী নয় সামান্য তীব্র শখেরই প্রতিফলন এটা। শিল্পী নৌকাটা তৈরি করেছিলেন শিশুদের জন্য। শিশুদের প্রতি ছিলো তার অকৃত্রিম ভালোবাসা। আর তার এই ভালোবাসা থেকেই শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ”শিশুস্বর্গ ও চারুপীঠ নামের প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও এস এম সুলতান ”নন্দন কানন নামের একটা প্রাইমারি ও একটা হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। নড়াইলের আর্র্ট স্কুলও তারই নামে। শিল্পীর একটা চিড়িয়াখানাও ছিলো। শেষ সময়ে পশু, শিশু ও বঞ্ছিত মানুষের আশ্রয়ের জন্য নিজের বাড়ি তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন। সময় পেলে মাঝে মাঝে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন চিত্রা নদীর বুক দিয়ে। অনেক স্বাভাবিক জীবন যাপন করতেন শিল্পী। জীবনের শেষ মুহুর্তে নিজের ভিতর দেশের এক বিখ্যাত চিত্র শিল্পীর মর্যাদা লুকিয়ে রেখেও অনেক সাদা-মাঠা জীবন যাপন করতেন।
পিডিএসও/রিহাব