হাসান ইমন

  ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

রাজধানীর জলাবদ্ধতা

সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার ঠোকাঠুকি

সামান্য বৃষ্টিতে নগরীর রাজপথ তলিয়ে যায়। ছবিটি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে তোলা

সামান্য বৃষ্টিতে রাজধানীতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা যেন নিয়তির লিখন। এ থেকে নিষ্কৃৃতির কোনো পথ পাওয়া যাচ্ছে না। এ সমস্যা সমাধানে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন এবং ওয়াসার মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই; বরং একে-অপরের দোষ চাপিয়ে দায় সারতে চাচ্ছে। বাস্তব সমাধানের উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। এতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ থেকে রেহাই পাচ্ছে না অফিসগামী ও স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের নগরবাসী। ধীরে ধীরে রাজধানী বসবাসের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্যুয়ারেজ ও ড্রেনেজ সিস্টেম বিনষ্ট করে অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ, পানিপ্রবাহের সব পথ বন্ধ করে দেওয়া, অদূরদর্শী সিদ্ধান্তে বক্স কালভার্ট নির্মাণ, নদী, খাল, জলাশয় জবরদখল ও ভরাটের কারণে পানিতে ডুবছে ঢাকাবাসী।

সামান্য বৃষ্টিতে নগরীর রাজপথ, অলিগলি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নিচু এলাকার দোকান ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। সড়কে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা, কাদা ও ড্রেনের ময়লা পানির সঙ্গে একাকার হয়ে যাচ্ছে সড়ক। বৃষ্টির দিন লাখো মানুষ এই দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছেন। জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেই। উল্টো জলাবদ্ধতার দায় এড়াতে সেবাদাতা সংস্থাগুলোর প্রধানরা একে-অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে দায় এড়াতে চাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিগগির সংস্থাগুলো সমন্বয় করে এ সমস্যা সমাধানের পথ বের করতে না পারলে কয়েক বছর পর সম্পূর্ণ অচল হয়ে যাবে রাজধানী।

সম্প্রতি জলাবদ্ধতার অবস্থা সরেজমিন দেখতে গিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, ঢাকা নগরীর জলাবদ্ধতার জন্য ঢাকা ওয়াসাই দায়ী। কারণ পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব ওয়াসার। তারা একটু সহযোগিতা করলে এ সমস্যা দূর হতো। কিন্তু তারা এসব বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের পেছনে ছুটছে। তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ওয়াসাকে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে একীভূত করা প্রয়োজন। অন্যথায় ওয়াসার নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা জরুরি। এভাবে এই সংস্থাটিকে চলতে দেওয়া যায় না।’

ওই সময় মেয়র আরো বলেন, ঢাকা শহরে নাগরিকদের সমস্যা সমাধানে ২৬টি সংস্থা রয়েছে। এর মধ্যে কিছু সমস্যা সমাধানে সিটি করপোরেশনের এখতিয়ার নেই। কিন্তু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে তা মেনে নেওয়া যায় না। তাই এ সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করতে শিগগিরই তা ক্রমান্বয়ে সমাধান করা হবে। এতে এক রাস্তা সাতবার কাটা বন্ধ হবে।

এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেসবাহুল ইসলাম বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে সম্প্রতি ওয়াসা, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, ঢাকা জেলা প্রশাসন ও উত্তর সিটি করপোরেশন সমন্বয় সভা করেছে। ওই সভায় অবৈধ খাল দখল উচ্ছেদ এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। তবে জলাবদ্ধতা একেবারেই নিরসন করা খুবই কঠিন কাজ। এটা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিন্তাভাবনা করতে হবে। নগরবাসীকেও এ ক্ষেত্রে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, পানি নিষ্কাশনের মূল দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। কিন্তু ঢাকা ওয়াসা সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। এজন্য সিটি করপোরেশনও কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা যেসব কারণে সৃষ্টি হচ্ছে সেসব কারণগুলো শনাক্ত করা হচ্ছে। এরপর জলাবদ্ধতা নিরসনে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।

অন্যদিকে, ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব ওয়াসার কাঁধে নেই। শুধু ঢাকা ওয়াসা ব্যতিক্রম। রাজধানীর চারপাশের খাল দখল, নিম্নাঞ্চল উঁচু হয়ে যাওয়া ও অতিবৃষ্টি জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী। তিনি আরো বলেন, ১৯৮৯ সালে ড্রেনেজব্যবস্থা নিয়ে ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথের ব্যর্থতার কারণে ওয়াসাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন সিটি করপোরেশন দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করে। পরে ওয়াসার কাঁধেই ন্যস্ত হয় পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব। কিন্তু রাজধানীর চারপাশের খাল, নদীদূষণ আর দখলে বন্ধ হয়ে গেছে। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

বর্ষা মৌসুমে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা কীভাবে নিরসন করা যায় সে ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে নিয়ে দফায় দফায় সভা করেছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়। ঘুরে ফিরে পুরনো বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা হচ্ছে।

জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে নগরবিদ ও জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ম ইনামুল হক বলেন, স্যুয়ারেজ ও ড্রেনেজ সিস্টেম বিনষ্ট করে অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ, পানিপ্রবাহের সব পথ বন্ধ করে দেওয়া, অদূরদর্শী সিদ্ধান্তে বক্স কালভার্ট নির্মাণ, খাল-জলাশয় জবরদখল ও ভরাটের কারণে পানিতে ডুবছে ঢাকাবাসী। ৭ থেকে ৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলেই পুরো রাজধানীতে এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। সমাধানের পথ হিসেবে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, নগরী থেকে পানি সরাতে হলে আগে খালগুলো দখল মুক্ত করতে হবে। এছাড়া খাল খনন এবং এমনভাবে ডিজাইন করতে হবে যেখানে ময়লা-আবর্জনা এবং মাটি না পড়ে। খাল উদ্ধারে সেনাবাহিনী নামানো হলে কিছুটা ফলাফল আসবে।

গত কয়েক দিনের সামান্য বৃষ্টিতেই ঢাকার মতিঝিল, নয়াপল্টন, গুলিস্তান, নাজিমউদ্দিন রোড, আরামবাগ, শান্তিনগর, রাজারবাগ, মালিবাগ, কাকরাইল, ডেমরা, সায়েদাবাদ, মুগদা, সবুজবাগ, ধোলাইপারসহ ডিএসসিসির অধিকাংশ এলাকার রাস্তাঘাট, অলিগলি, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে যায়। ডিএসসিসির গত অর্থবছরে শান্তিনগর এলাকায় নতুন ড্রেন নির্মাণ করেছে। এতে বর্ষা মৌসুমে পানি কম জমলেও আশপাশের এলাকাসহ নতুন নতুন এলাকায় জলাবদ্ধতা আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এ ছাড়া ডিএনসিসি এলাকার মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, ইব্রাহীমপুর, সাংবাদিক কলোনি এলাকা, কারওয়ান বাজার, বেগম রোকেয়া সরণি, কালশী, মহাখালী, তেজগাঁও, খিলগাঁও, রামপুরা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, উত্তরা বিমানবন্দর মোড়, আশকোনা হাজিক্যাম্প রোড, দক্ষিণ পাইকপাড়া এলাকার সড়ক ও অলিগলি হাঁটুপানিতে তলিয়ে যায়। দক্ষিণ পাইকপাড়ায় ড্রেনেজব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নয়নকাজ হলেও গত বর্ষার চেয়ে এবার জলাবদ্ধতা বেশি। কারণ অনুসন্ধানে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। একই সঙ্গে মিরপুর, বাড্ডা, তেস্তুরীবাজার, কাঁঠালবাগান, পল্লবী, খিলক্ষেত, কুড়িল, উত্তরা, রামপুরা, বাড্ডা, দক্ষিণখান, ভাটারা, ভাসানটেক, নাখালপাড়াসহ বিভিন্ন জায়গায় হাঁটু সমান পানি জমেছে। এতে পথচারী ও যানবাহনের আরোহীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। রাস্তার ধারের অনেক বাসাবাড়ি ও দোকানে পানি ঢুকে গেছে।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত ১২৭.৬৩ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে পানি নিষ্কাশন কার্যক্রম সরাসরি পরিচালনা করছে ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশন। এরমধ্যে দুই সিটি করপোরেশনের ড্রেনেজ লাইন রয়েছে দুই হাজার কিলোমিটার। আর ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ লাইন ৩৭০ কিলোমিটার। ঢাকা জেলা প্রশাসনের মালিকানাধীন ২৬টি খাল রয়েছে। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। এরমধ্যে মাণ্ডা, হাজারীবাগ, কসাইবাড়ী, সাংবাদিক কলোনি ও বাইশটেকি খাল দখলের মাধ্যমে ব্যক্তিমালিকানায় চলে গেছে। এগুলো দখলমুক্ত করতে পারছে না জেলা প্রশাসন, ঢাকা ওয়াসা এবং ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। ঢাকা ওয়াসা খালের জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নিলেও প্রকল্প অনুমোদন না মেলেনি। ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন খাল উদ্ধারের প্রচেষ্টা চালালেও রহস্যজনক কারণে সেসব থমকে গেছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জলাবদ্ধতা,সিটি করপোরেশন,রাজধানী
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist