ফয়জুন্নেসা মণি

  ১২ আগস্ট, ২০১৭

হাতি দিবসে হাতি সমাচার

হাতি, ডাঙায় চরে বেড়ানো স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণিসম্পদ হিসেবে বিবেচিত। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য হাতিকে ফরেস্ট ইঞ্জিনিয়ার বলা হয়। তাই হাতিকে বনের ইন্ডিকেটর স্পেসিসও বলা হয়। বেজায় ওজন হলেও হাতি কিন্তু সাঁতার কাটতে পারে। ডুবুরিরা যেভাবে একটা পাইপের সাহায্যে নিঃশ্বাস নেয়, ঠিক তেমনি সাঁতরানোর সময় ওদের শুঁড়ের মাথাটা থাকে পানির ওপরে। হাতি তৃণভোজী প্রাণী। হাতির খাদ্য হচ্ছে বাঁশ, কলাগাছ, ফলদ উদ্ভিদ ও তৃণলতা। দিনের একটা বড় সময় ধরে তারা খাবার সংগ্রহ করে। কখনো কখনো দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৬ ঘণ্টা ধরেই তারা পাতা, ডাল, মূল এগুলো জোগাড় করে খাওয়ার জন্য। দিনে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে পারে হাতি। এদের স্বাভাবিক গতি ঘণ্টায় ২৫ মাইল। পৃথিবীর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে কম ঘুমায় আফ্রিকার বুনো হাতি। দিন-রাত মিলিয়ে এরা গড়ে মাত্র দুই ঘণ্টা ঘুমায়। প্রধানত রাতেই এই সংক্ষিপ্ত নিদ্রা সারে তারা। পৃথিবীতে দুই প্রজাতির হাতি আছে- এশিয়ান প্রজাতি ও আফ্রিকান প্রজাতি। আফ্রিকান হাতিরও আবার দুটি প্রজাতি আছে- আফ্রিকান ফরেস্ট এলিফ্যান্ট আর আফ্রিকান বুশ এলিফ্যান্ট। বাংলাদেশের হাতি এশিয়ান প্রজাতির। আফ্রিকান প্রজাতির হাতি পুরুষ ও স্ত্রী উভয়েরই দাঁত গজায়। কিন্তু এশিয়ান প্রজাতির ক্ষেত্রে শুধু পুরুষ হাতির দাঁত গজায়।

হাতি রক্ষায় বিশ্বজুড়ে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১২ আগস্ট বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব হাতি দিবস। বাংলাদেশে একসময় অনেক হাতি থাকলেও এখন এরা বিলুপ্তির পথে। বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় এবং খাবারের অভাবে অনেকটাই সঙ্কটের মুখে হাতি। বন ধ্বংস করে কৃষি জমির বিস্তার, নগরায়ন, বনজ সম্পদের অতি আহরণ, পাহাড় কাটা, অপরিকল্পিতভাবে বনের মধ্যে রাস্তা নির্মাণ এবং বনসংলগ্ন নদীতে বাঁধ নির্মাণ দেশে হাতির অস্তিত্বকে বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এক জরিপে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী হাতির সংখ্যা ২৩০ থেকে ২৪০টির মতো। বর্তমানে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা, কক্সবাজার, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান, টেকনাফ, হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান এবং চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে অল্প সংখ্যক বন্যহাতি দেখা যায়। কিন্তু এক শতাব্দী আগে বাংলাদেশের মধুপুর গড় থেকে শুরু করে গারো পাহাড়, সিলেট, চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপক সবুজ ঘন বনে অনেক অনেক হাতি বিচরণ করত। এখন এরা শুধু চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার চিরহরিৎ বনাঞ্চলে বিচরণ করে। এদের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে পাওয়া যায় চুনতি, টেকনাফ, ফাঁসিয়াখালী ও পাবলাখালী অভয়ারণ্য এবং কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান, বাঁকখালী, রেজু, ফুলছড়ি ও মরিসা এলাকার চিরসবুজ বনাঞ্চলে। হাতির জন্য প্রয়োজন বিশাল বিচরণক্ষেত্র আর দরকার পর্যাপ্ত খাবার, পানি ও বিশ্রামের জায়গা। হাতিকে বন্য পরিবেশ থেকে বিলুপ্তি রোধে সরকারি-বেসরকারি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি জনসচেতনতা আজ বড় বেশি প্রয়োজন। আশার খবর হলো- হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনের লক্ষ্যে ‘আইইউসিএন’ বাংলাদেশের সহযোগিতায় বন বিভাগের ‘এসআরসিডব্লিউপি’ প্রকল্পের একটি উপ-প্রকল্পের কার্যক্রম চলছে এবং বন বিভাগ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন হাতি-মানুষ দ্বন্দ্বপ্রবণ এলাকায় ‘এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম’ গঠন, বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মশালা, লোকালয়ের সীমানা বরাবর হাতির অপছন্দনীয় খাদ্যের বাগান (যেমন- কাঁকরল, তিতা করলা, মরিচ ইত্যাদি) সৃজন, বনের সীমানার অভ্যন্তরে হাতির খাদ্যোপযোগী বাগান সৃজন, চুনতির অভ্যন্তরে বড় হাতিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় সোলার ফেন্সিং নির্মাণ, হাতি চলাচলের রাস্তা নির্দেশক ও জনসচেতনতামূলক নির্দেশিকা বোর্ডসহ বিবিধ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

হাতির সামাজিক কাঠামো অন্য জীবজন্তুর থেকে আলাদা। হাতি অনেক বুদ্ধিমান প্রাণী। রহস্যময় এই প্রাণীটির এমন অনেক গোপনীয় বিষয় আছে, যা এখনো উন্মোচিত হয়নি। চিত্তাকর্ষক প্রাণী হাতির মজার কিছু অভ্যাস আছে। হাতি পরিবারের নেতৃত্ব দেয় মহিলা হাতি। একটি মহিলা হাতির নেতৃত্বে ২৫টি হাতি একটি পরিবারের মতো একসঙ্গে বাস করে, একে হার্ড বা পশুপাল বলে। হাতি পরিবারে বয়স্ক হাতির প্রভাব অনেক বেশি। হাতি পরিবারে বয়স ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নির্বাচন করা হয়। পুরুষ হাতি ৮-১৫ বছর বয়সের মধ্যে পরিবার ত্যাগ করে বা অন্যভাবে বলা যায় যে, হাতি কিশোর বয়সে নিজ পরিবার ত্যাগ করে সঙ্গীর সন্ধানে অন্য ছোট পরিবারের সাথে থাকতে শুরু করে।

হাতির শুঁড় দিয়ে যেকোনো বস্তুর আকার, আকৃতি বা তাপমাত্রা বুঝে ফেলতে পারে। হাতির শুঁড় প্রায় দুই মিটার লম্বা হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, হাতির শুঁড়ে প্রায় এক লাখ পেশি আছে। কিন্তু কোনো হাড় নেই। তাই সে যেভাবে খুশি তার শুঁড়কে আঁকিয়ে বাঁকিয়ে যা খুশি কাজ করতে পারে। হাতি শুঁড় ব্যবহার করে মাটিতে গর্ত করে মাটির নিচের পানি বের করে এনে পান করে। একটি প্রাপ্তবয়স্ক হাতির দিনে প্রায় ২১০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। হাতির প্রকা- কান শরীরের তাপ বিচ্ছুরিত হতে সাহায্য করে। হাতিরা আনন্দ প্রকাশের জন্য কান নাড়ায়। হাতির দাঁতের বিভিন্ন শিল্পকর্ম জনপ্রিয়। হাতির দাঁত দিয়ে সিংহাসনের পা, আসবাবপত্র এবং মন্দির সাজানোর কাজে ব্যবহৃত হতো। এখনো হাতির দাঁতের তৈরি বিভিন্ন ধরনের শৌখিন জিনিসপত্র এবং অলঙ্কার সর্বজন সমাদৃত। মানুষের বিলাসিতায় অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছে প্রকৃতির এই অপূর্ব সৃষ্টি। স্ত্রী হাতি সারাজীবন দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। ওদিকে পুরুষ হাতি ১৩ বছর বয়সে দল ছেড়ে চলে যায় এবং বাকি জীবন একাই বসবাস করে। হাতি ১২ বছর বয়সে বাবা-মা হতে পারে। হাতির প্রজননকাল মার্চ থেকে জুন মাস। সাধারণত এরা দুই থেকে চার বছর পর পর একটি বাচ্চার জন্ম দেয়। হাতির বাচ্চা মায়ের পেটে থাকে ২২ মাস। মানে হল, একটি হাতির বাচ্চা মানুষের বাচ্চার প্রায় আড়াইগুণ বেশি সময় মায়ের পেটে কাটায়। একটি পূর্ণবয়স্ক হাতি ৩০০ কেজি খাবার খায়। হাতিরা একে অপরের ডাক চার কিলোমিটার দূর থেকে শুনতে পারে। এমনকি ১৫০ মাইল দূর থেকে বৃষ্টির আভাস পায়। মজার তথ্য- হাতি খুব ত্বক সচেতন। তাই রোদে পোড়া থেকে বাঁচতে সারা শরীরে কাদা মেখে রাখে।

হাতি বাঁচে মানুষের মতোই, ৬০ থেকে ৭০ বছর। চলাফেরায় হাতি মানুষের চেয়ে স্বাধীন। খাবার খোঁজে নির্দিষ্ট পথে চলার স্বভাবের এই প্রাকৃতিক নিয়মও হাতির জন্য কাল হয়ে দেখা দিয়েছে। এই স্বভাবের কারণে মানুষ এদের সহজে আক্রমণ করতে পারে। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, হাতিকে কেউ আক্রমণ করলে আত্মরক্ষায় প্রথমে বিশাল শুঁড় উঁচিয়ে চিৎকার করে শত্রুকে বিরত হতে বলে। তারপরও শত্রু না থামলে কিছুটা সামনে এগিয়ে ভয় দেখায়। তাতেও কাজ না হলে এরা শত্রুকে আক্রমণ করে। স্থলজ জীবজন্তুর মধ্যে হাতির মস্তিষ্ক সবচেয়ে বড়। সার্কাসে হাতির রসরঙ্গ যারা দেখেছেন তারা নিশ্চয়ই মানবেন যে- হাতির বিষাদ, হাস্যরস, সহানুভূতি, সহযোগিতা, আত্মসচেতনতা, সরঞ্জাম ব্যবহার এবং চমৎকার শেখার ক্ষমতা আছে। হাতি তাদের মৃতদের সম্মান দেয় এবং মৃতদের জন্য আচার-অনুষ্ঠান করে।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

পিডিএসও/রানা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
হাতি,হাতি দিবস
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist