আলোক আচার্য্য

  ০৪ জুন, ২০১৮

দাও ফিরে সে অরণ্য

দাও ফিরিয়ে এ অরণ্য, লও এ নগর—কবির এ উক্তিতে প্রতীয়মান যে, বহুকাল ধরেই মানুষ সেই গাছপালা ঘেরা সবুজ পরিবেশে ফিরে যেতে চায়। আর এই পরিবেশ হারিয়ে মানুষ বহু ধ্বংসলীলার সাক্ষী। পরিবেশ বিপর্যয়ের বহু ইতিহাস আছে, যেখানে এক ধ্বংসলীলা সাক্ষী হয়ে আছে। বহু জনপদ, শহর, প্রাণিকুল তাদের অস্তিত্ব হারিয়েছে পরিবেশ পরিবর্তনের ফলে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়ে। সারভাইভাল ফর দ্য ফিটেস্ট কথাটি ইংরেজিতে বহুল প্রচলিত। সারভাইভ তারাই করবে, যারা প্রকৃতির সঙ্গে তাল মেলাতে সক্ষম হবে। আর যারা পারবে না তারা হারিয়ে যাবে প্রকৃতি থেকে। এটাই নিয়ম।

পরিবেশ বদলের এই ধারাবাহিকতায় কিন্তু আমাদের মতো নিচু দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশের ঝুঁকি সবচেয়ে ভয়াবহ। অসংখ্য জীবন ও আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও হাজার হাজার নিঃস্ব মানুষের আর্তনাদ শোনা যায়। নদীভাঙন, বন্যা, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় বা হালের বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের সমাজের একটি বিরাট অংশের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলছে। সব হারিয়ে মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে। শহরের ওপর চাপ বাড়ছে। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে রয়েছি আমরা। যদি তা হয় তাহলে আমাদের দেশের একটা অংশ ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আমাদের এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি নিই।

গত ৩০ বছরের মধ্যে দেশে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে এপ্রিল মাসে। ভারতে তো পিসঢালা রাস্তায় ডিম ভাজার দৃশ্য পরপর দুই বছর দেখলাম। তা ছাড়া প্রচ- ধূলিঝড় এবং তীব্র বায়ুদূষণের কারণে কয়েকটি শহর অন্ধকার ধোঁয়ায় ঢেকে থাকা এসব পরিবেশ বিপর্যয়কে নির্দেশ করে। অতীতের প্রায় ৩০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে কালবৈশাখী, টর্নেডো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আঘাত করেছে। সেসব এলাকার অনেক মানুষ আজ গৃহহীন। পরিবেশবিদরা বলছেন, আবহাওয়ার চরিত্র অনেক বছর ধরে বদলাচ্ছে। ষড়ঋতুর এই দেশে এখন ছয়টি ঋতু আলাদা করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। চারটি ঋতু স্পষ্ট, তবে হেমন্ত আর শরৎ তো রীতিমতো নাম গুনে বের করতে হয়। কারণ যখন যে আবহাওয়া থাকার কথা, তখন তা থাকছে না। শীতের সময় খুব অল্প সময় শীত অনুভূত হয়। যখন গরম আসার কথা তখন শীত থাকে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি তো আমাদের লেগেই আছে। প্রকৃতি তার চরিত্র পাল্টাচ্ছে। আমরাও প্রকৃতির খেয়ালের সঙ্গে নিজেদের প্রস্তুত করে নিচ্ছি। কিন্তু ক্ষতি পোষাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশ্বেও ৪০ শতাংশ কার্বন নিঃসারণকারী দেশ হলো চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। আমরা মূলত এ রকম বড় বড় শিল্পোন্নত দেশের কার্বন উৎপাদনের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার। তার সঙ্গে রয়েছে নিজেদের ভারসাম্যহীনতা। সব মিলিয়ে অবস্থা যে ভজঘট সেটা বোঝা যায়। আমরা পরিস্থিতির স্বীকার। কিন্তু তাই বলে বসে থাকার কোনো উপায় নেই। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের কাজ এগিয়ে নিতে হবে।

৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনায় ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ২০১৫ সালে সম্পাদিত বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি ছিল একটি বড় পদক্ষেপ। এতে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো আশাবাদী ছিল যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোকে আমরা পাশে পাব। যদিও এ জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের দেশের দায় তুলনামূলক কম কিন্তু ফল ভোগ করছি আমরাই বেশি। বিশ্বের ১৮০ দেশের সমর্থনে করা প্যারিস জলবায়ু চুক্তির বাংলাদেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা। যে অর্থ ঝুঁকি মোকাবিলায় কাজ করতে পারে। তবে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চুক্তির প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের কারণে এই জলবায়ু চুক্তি ঝুঁকির মুখে।

মোরা, সিডর, নার্গিস আর আয়লার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ দেশে বারবার আঘাত হেনেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশগুলোর একটি। প্রতি বছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রাণহানি ঘটার পাশাপাশি বাস্তুচুত্য হচ্ছে অগণিত মানুষ। সেসব মানুষ শহরমুখী হওয়ার কারণে চাপ বাড়ছে শহরের ওপর। ১৯৯৮ সাল থেকে মার্চ মাসের শেষদিন জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস পালিত হয়ে আসছে। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, কালবৈশাখী, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডোসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশ নিয়ে গবেষণাবিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে আসছেন। পরিবেশের পরিবর্তিত প্রভাব নিয়ে চলছে নানা ধরনের সাবধানবাণী। আমাদের জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা চলছে। যখন শীত আসার কথা, তখন না এসে শীত আসছে দেরিতে। আবার যখন বৃষ্টি হওয়ার দরকার, তখন না হয়ে অসময়ে প্রচুর বৃষ্টি হলো।

অনেক দিন থেকেই শোনা যাচ্ছে পৃথিবীর আবহাওয়া বিরূপ হতে শুরু করেছে। বদলে যাচ্ছে জলবায়ু। জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষণগুলো ক্রমেই প্রকৃতিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পরিবেশ বিপর্যয়জনিত কারণে সবচেয়ে দুর্ভোগে যে দেশ পড়বে তার মধ্যে প্রথম সারিতেই বাংলাদেশের নাম রয়েছে। আমাদের দেশ নিয়ে চিন্তা তো আমাদেরই হবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির যে প্রবণতা, তার জন্য সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার মতো হুমকি বহন করছে। তার জন্য ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটাতে পারে। তা ছাড়া এর জন্য আমাদের মতো নিচু দেশগুলোর একটা বিরাট অংশ সাগরের পানিতে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার বিষয়ে বিজ্ঞানীদের হুশিয়ারি রয়েছে। লবণাক্ততার বিরূপ প্রভাব পড়বে ফসল উৎপাদনে, যা খাদ্যব্যবস্থার জন্যও ভয়াবহ ফলাফল বহন করতে পারে।

জার্মান ওয়াচ তাদের গবেষণায় বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ৮ হাজার ২৪১ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। সিডর, খাইমুর, নার্গিস, আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলাতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। সেসব ক্ষয়ক্ষতি কাটাতে বছরের পর বছর সময় লেগে যাচ্ছে। এর ভেতরেই নতুন নতুন দুর্যোগ হানা দিচ্ছে। গত বছর বজ্রপাতেই মারা গেছে ১৪২ জন। যার সংখ্যা দুই দিনেই ছিল ৮২ জন। এ রকমটা অতীতে দেখা যায়নি। তাই বজ্রপাতও নতুন দুর্যোগরূপে আবির্ভূত হয়েছে। এ বছরে চৈত্রের শুরু থেকেই বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা শুরু হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিভিন্ন সময় প্রচুর মানুষ মারা গেছে। ১৯৭০ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। আর পার্শ্ব ক্ষয়ক্ষতি তো ছিল আরো ভয়ংকর। ১৯৯১ সালের ঝড়ে প্রায় দেড় লাখ লোক নিহত হয়েছিল। তা ছাড়া ১৯৮৮, ১৯৯৮ সালের বন্যাতেও যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আর কয়েক বছর ধরে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম ভূমিকম্প, যা মোকাবিলার শক্তি আমাদের একেবারেই অপর্যাপ্ত।

পৃথিবীতে তাপমাত্র বৃদ্ধিজনিত কারণে যে প্রভাব পড়ছে, তার কিছুটা আমরা প্রতিবেশী দেশ ভারতের তীব্র দাবদাহ দেখেছি। তীব্রতা এত বেশি যে, বহু মানুষ মারাও গিয়েছিল। আমাদের দেশেও গরমের তীব্রতা গত বছর অনেক বেশি ছিল। হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় মাঝেমধ্যে। আমরা যখন পরিবেশ ধ্বংস করি, তখন এ কথা মাথায় নেই না। কিন্তু প্রকৃতি তার নিজের নিয়ন্ত্রণ নিজেই নেয়। যখন আমাদের ধ্বংসলীলা সীমার বাইরে চলে যায়, তখন প্রকৃতিতে দুর্যোগ নেমে আসে। সমস্যা হলো, সেই দুর্ভাগ্যের শিকারের মধ্যে কিছু অসহায় মানুষও পড়ে যায়। যারা এর ক্ষত বছরের পর বছর বহন করে চলে। আর সেই ক্ষত মোছানোর জন্য কেউ থাকে না। সর্র্বশেষ মোরার আঘাতেও প্রাণহানি ঘটেছে, বাড়িঘর হারিয়ে গেছে। তাদের সেই স্মৃতি এখনো মুছে যায়নি। তাই পরিবেশ রক্ষার বিকল্প কোনো উপায় আমাদের কাছে গচ্ছিত নেই। নেই বিধায় একে রক্ষা করা আমাদের জন্য সময়ের অন্যতম প্রধান দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পরিবেশ,অরণ্য,কলাম
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist