ওমর ফারুক নাঈম, মৌলভীবাজার

  ২১ মে, ২০১৮

অস্তিত্ব সংকটে চিরহরিৎ লাউয়াছড়া

অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে বাংলাদেশের অবশিষ্ট চিরহরিৎ বন লাউয়াছড়া। এটি এখন জাতীয় উদ্যান হিসেবে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। দেশে বিদ্যমান ৭টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে অন্যতম লাউয়াছড়া। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত ১ হাজার ২৫০ হেক্টর আয়তনের বন জীববৈচিত্র্যে ভরপুর।

বিশ্বে বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য এই বন বিখ্যাত। উল্লুক ছাড়াও এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ এবং উদ্ভিদ। নিরক্ষীয় অঞ্চলের বর্ষাবন বা রেইনফরেস্টের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় এই বনে। একসময় বৃহত্তর সিলেটের সর্বত্রই এ ধরনের বন ছিল। তবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা বাগান সৃষ্টি, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ এবং নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে ক্রমে সংকুচিত হতে হতে মাত্র কয়েকটি স্থানে চিরহরিৎ এ বর্ষাবনের অস্তিত্ব টিকে রয়েছে। এছাড়া পর্যটকের মাত্রাতিরিক্ত চাপে স্বাভাবিক চলাচল করতে পারে না বনের প্রাণীরা। জুলভার্নের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে করা ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটটি ডেজ’ ছবিটির একটি দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল লাউয়াছড়ার রেললাইন এলাকায়।

জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে লাউয়াছড়ার জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশের একটি সমৃদ্ধতম বন। আয়তনে ছোট হলেও এ বন যেন দুর্লভ উদ্ভিদ এবং প্রাণীর এক জীবন্ত সংগ্রহশালা। বনে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই নানা ধরনের বন্যপ্রাণী, পাখি এবং কীটপতঙ্গের শব্দ শোনা যায়। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। উল্লুক ছাড়াও এখানে রয়েছে মুখপোড়া হনুমান, বানর, শিয়াল, মেছোবাঘ, বন্য কুকুর, ভালুক, মায়া হরিণসহ (বার্কিং ডিয়ার), নানা প্রজাতির জীবজন্তু। পাহাড়ি মৃত্তিকা গঠিত উঁচু-নিচু টিলাজুড়ে বিস্তৃত এ বনে সরীসৃপ আছে নানা প্রজাতির। তার ভেতর অজগর হচ্ছে অনন্য। এখানে পাওয়া যায় হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ। লাউয়াছড়া বনেই রয়েছে বিপন্ন প্রজাতির উল্লুক।

আর এই লাউয়াছড়াই দিন দিন ধ্বংসের ধারপ্রান্তে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, প্রভাবশালীদের বন দখল, অবাধে বৃক্ষনিধন, অবৈধ করাতকল স্থাপন, বনের ভেতর রেল-সড়ক পথ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং রক্ষণাবেক্ষণে অসচেতনতাই এই বনের আয়তন ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি এই বনে বৃদ্ধি পেয়েছে গাছ চুরি ও প্রাণী মৃত্যু। বন্যপ্রাণীর এই অভয়াশ্রমটি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে লাউয়াছড়ার অভ্যন্তরীণ সড়ক ও রেলপথগুলো। প্রতিনিয়তই দ্রুতগামী গাড়ির ধাক্কায় কিংবা চাকায় পিষ্ট হয়ে কোনো না কোনো বনপ্রাণীর মৃত্যু হচ্ছে। ফলে লাউয়াছড়ার অভ্যন্তরে অবস্থিত সড়ক ও রেলপথগুলো বন্যপ্রাণীকুলের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়াও ছুটির সময়ে মাত্রাতিরিক্ত পর্যটকদের আগমনে বনের বন্যপ্রাণীর বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যানবাহনের হুড়াহুড়ি, শুষ্ক মৌসুমে প্রাকৃতিক পানি, খাবার ও নিরাপদ বাসস্থান সংকট, এসব মিলিয়ে উদ্যানের জীব-বৈচিত্র্য ও প্রকৃতি সুরক্ষা নিয়ে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।

উদ্যানের গাঁ ঘেঁষে বনজঙ্গল ও মাটি কেটে স্থাপিত হচ্ছে বিভিন্ন কটেজ। ফলে বনের ভেতরে দল বেঁধে মানুষের অবাধ বিচরণ বন্যপ্রাণীর জন্য খাবার সংগ্রহ ও চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এসব বিভিন্ন কর্মকা-ের ফলে বন্যপ্রাণীর খাবার ও আবাসস্থল বিনষ্ট হচ্ছে। আর খাবারের সন্ধানে জঙ্গলের দুর্লভ প্রাণীগুলো জনপদে ছুটে এসে মানুষের হাতে ধরা পড়ে অথবা গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে।

বন বিভাগের তথ্য মতে, ২০০৯ সালের ১ নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত কয়েক কোটির উপরে দেশি-বিদেশি পর্যটক লাউয়াছড়া ভ্রমণ করেছেন। লাউয়াছড়ায় ২০০৬ সালে ৬৯টি উল্লুক ছিল। আশির দশকেও বাংলাদেশে উল্লুকের সংখ্যা ছিল তিন হাজার।

মৌলভীবাজার পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সৈয়দ মহসীন পারভেজ বলেন, ‘শুধু মানুষ নয়, বন্যপ্রাণীরও স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তাও আমরা চাই। মৃত্যুর এমন ভয়াবহতা কখনোই কাম্য হতে পারে না। যে কোনো দেশের জন্যই তার নিজস্ব বন্যপ্রাণীগুলো জাতীয় একটি সম্পদ। এদের নির্ভয়তা, সুস্থতা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট বিভাগের।’

সাধারণ সম্পাদক নুরুল মোহাইমিন মিল্টন বলেন, ‘লাউয়াছড়ার বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমে আসছে। লাউয়াছড়ার পরিবেশকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে এবং বন্যপ্রাণী রক্ষা করতে হলে অতিসত্বর পর্যটকদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। জীববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষিকা রোকশানা আক্তার বলেন, ‘লাউয়াছড়া উদ্যান হচ্ছে আমাদের দেশের গর্ব। এই বনে অনেক বিপন্ন প্রাণীর আবাস রয়েছে। কিন্তু দিন দিন এই বনকে বিভিন্নভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে।’ সেভ দ্যা নেচার অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি জাকের আহমদ অপু বলেন, ‘লাউয়াছড়া রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। সরকারের সঠিক ব্যবস্থাপনায় এনে এটি রক্ষা করার দাবি জানাচ্ছি’।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন কর্মকর্তা আবু মুছা শামসুল মোহিত চৌধুরী বলেন, লোকবল কম থাকায় অনেক সময় আমরা সামাল দিতে পারি না। তবে এখন থেকে নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে পর্যটকদের যেতে দেওয়া হবে না। ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রিত ট্যুরিজমের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তিনি।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
লাউয়াছড়া,জাতীয় উদ্যান,অস্তিত্ব সংকট,সংরক্ষিত বনাঞ্চল
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist