হাসান ইমন
হাজারীবাগে বেড়িবাঁধের কারণে বেদখল বুড়িগঙ্গা
রাজধানীকে বন্যার হাত থেকে রক্ষার জন্য ঢাকার পশ্চিমে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে নির্মিত হয়েছিল বেড়িবাঁধ। এখন সেই বেড়িবাঁধের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা। এখন নগর রক্ষার চেয়ে উল্টো নদী রক্ষার দায় পড়েছে বেশি। কারণ ওই বাঁধের কারণেই মাটি ফেলে দখল করে নিচ্ছে বুড়িগঙ্গা নদী। আর এ মাটি ফেলা হচ্ছে রাতের আঁধারে। রাজধানীর হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বছিলা মোহনা পর্যন্ত সাড়ে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ আদি বুড়িগঙ্গা নদী আজ মৃতপ্রায়।
খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, ১৯৮৫ সালে নদীর উত্তর পাশে ঢাকা শহরকে বন্যা এবং যানজট থেকে মুক্ত রাখতে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে ১২ দশমিক ৭৬ একর জায়গা নিয়ে তৈরি করা হয় বেড়িবাঁধ। এই বাঁধ নির্মাণের পর থেকেই শুরু হয় নদী দখলের কাজ। ১৯৮৫-২০১৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৩ বছর নদীটির দুই পাড় দখল করে তৈরি করা হয়েছে সরকারি-বেসরকারি ৫ থেকে ৬তলা ভবন ও শিল্পকারখানাসহ দেড় থেকে ২ হাজার অবৈধ স্থাপনা। এসব অবৈধ স্থাপনার মধ্যে রয়েছে বালুরবিট, ইটখোলা, টঙঘর, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মেডিক্যাল কলেজ, কামরাঙ্গীরচরে পান্না গ্রুপের ভলভো ব্যাটারির কারখানা, ম্যাটাডোর ব্রাশ ফ্যাক্টরিসহ একাধিক শিল্পকারখানা ও ডিপিডিসির বিদ্যুৎ সাবস্টেশনসহ অসংখ্য স্থাপনা।
গতকাল রোববার সরেজমিন দেখা যায়, কামরাঙ্গীরচর লোহার ব্রিজ সেতুর পূর্ব পাশে বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলে ভাঙা বাড়ির ইটসুড়কি ফেলা হচ্ছে। একইসঙ্গে গৃহস্থালি বর্জ্য ফেলেও ভরাট করা হচ্ছে বুড়িগঙ্গার এ আদি চ্যানেল। এলাকাবাসীর অনেকে অভিযোগ করেছেন, সিটি করপোরেশনের ময়লাও ফেলা হচ্ছে আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেলে।
রায়েরবাজার এলাকার বাসিন্দা ও মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম বলেন, আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেলর পুরো অংশজুড়েই চলছে দখলদারিত্ব। অনেকে জাল দলিল করে, কেউ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেলে দখলদারিত্ব চালাচ্ছে। একসময়ের প্রমত্ত আদি বুড়িগঙ্গার অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার উদ্যোগ নিলে এসব দখলদার উচ্ছেদ করে বুড়িগঙ্গার এ অংশও প্রবাহমান করা সম্ভব। আশা করি বর্তমান সরকার সেই উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
সরেজমিন আরো দেখা গেছে, আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেলের সেকশন, জাওলাহাটি, রসুলপুর, কোম্পানিঘাট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল ভরাট-দখলের কারণে অস্তিত্ব প্রায় মুছে গেছে। একসময়ে নৌকায় চলাচল করা আদি চ্যানেল হেঁটেই চলাচল করা যায়। বর্ষার মৌসুমে কেবল পানি দেখা যায়, আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেলে। বুড়িগঙ্গা এ চ্যানেলের দুই পাড় দখল করে এখন শত শত বসতভিটা, দোকানপাট গড়ে উঠেছে। কামরাঙ্গীরচরের লোহারপুল ও পাকা সেতুর নিচে পানি থাকলেও পশ্চিমের অন্য সেতুগুলোর কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কচুরিপানা আর আগাছায় ভরা। মাটি ভরাট করে অনেক সেতুকে দুই দিক থেকে দখল করে ফেলা হয়েছে। পশ্চিম রসুলপুর অংশে এ চ্যানেলটি সরু নালায় পরিণত হয়েছে। কোম্পানিঘাট ম্যাটাডোর, পান্না ব্যাটারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়ে আরো সরু হয়েছে। আর জাওলাহাটি গিয়ে আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেলের আর কোনো অস্তিত্ব নেই। বড় বড় অট্টালিকা গড়ে উঠেছে আদি বুড়িগঙ্গার বুকে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেলে চলছে দখলের মচ্ছব। ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দাবি করে অনেকে সাইনবোর্ড টানিয়ে রেখেছেন। কেউ উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের আদেশও সাইনবোর্ডে লিখে রেখেছেন। মাঝে মধ্যে বিআইডব্লিউটিএ আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল দখলমুক্ত করতে অভিযান পরিচালনা করলেও কিছু দিন পর রহস্যজনক কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দখল আবার জেকে বসে। এভাবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দখলপোক্ত হচ্ছে আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেলে।
বেড়িবাঁধ এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে আসছেন আলতাফ মাহমুদ। তিনি বলেন, কালুনগর বেড়িবাঁধ পুরোটাই অবৈধ দখলে চলে গেছে। অপরিচিত কোনো ব্যক্তি এসে বুঝতেই পারবেন না যে একসময় বেড়িবাঁধের পার দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর ¯্রােত প্রবাহিত হয়েছিল। বিএনপির আমলে বেড়িবাঁধের পাশে খালের ওপর দিয়ে খোলামোড়া পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য ১২০ ফিট রাস্তা হওয়ার কথা ছিল। এজন্য ৩টি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতা পরিবর্তনে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে খালের ওপর নির্মিত এ তিনটি ব্রিজ এখন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ব্রিজ তিনটি যে কেউ দেখলে মনের ভেতর প্রশ্ন জেগে উঠবে।
পরিবেশ অধিদফতরের ২০১৬ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল দখল করে ছোট-বড় ৫২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ওই প্রতিবেদন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করা হয়। যদিও এ ব্যাপারে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পরবর্তী কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। বর্তমানে এর সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
এই বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. আবদুল মতিন বলেন, স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশন ইচ্ছা করলেই ১ ঘণ্টার মধ্যে বেড়িবাঁধ ভরাট বন্ধ ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পারে। কিন্তু এসব সংস্থার সদিচ্ছার অভাবে বেড়িবাঁধ দখলমুক্ত সম্ভব হচ্ছে না। বেড়িবাঁধে ময়লা ফেলানো ও দখলের ব্যাপারটি সরকার দেখেও না দেখার ভান করে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুস সোবহান বলেন, হাজারীবাগ ও রায়ের বাজার বেড়িবাঁধ ভরাট করা ও দখল করার সঙ্গে সিটি করপোরেশন ও দখলবাজদের কারসাজি রয়েছে। দুই পক্ষের কারসাজি ছাড়া কখনই বেড়িবাঁধ ভরাট করা সম্ভব নয়। সিটি করপোরেশন ও এলাকাবাসী বেড়িবাঁধে আবর্জনা ফেলে আস্তে আস্তে দখল করে। এটি একটা প্রক্রিয়া। বেড়িবাঁধ দখলের প্রক্রিয়া ঢাকার চারপাশেই চলছে।
এই বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. তারিকুল ইসলাম সজীব বলেন, হাজারীবাগ বেড়িবাঁধে মাটি ফেলা হচ্ছে না তবে একটি জায়গায় ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। কিছুদিন আগে বেড়িবাঁধে অবৈধভাবে নির্মিত ঘর ভেঙেছি। খাল উদ্ধার না হওয়ায় পর্যন্ত অবৈধভাবে বাড়িঘর নির্মিত হতেই থাকবে। খাল উদ্ধার হলে অবৈধভাবে আর বাড়ি নির্মিত হতে পারবে না।
তিনি বলেন, বেড়িবাঁধের পাশে সুইপারদের জন্য অস্থায়ীভাবে বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। কারণ সুইপারদের কেউ বাড়ি ভাড়া দেয় না। তাদের জন্য যেসব বিল্ডিং রয়েছে তা ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে নতুন ভবন তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন ভবন নির্মিত হলেই বেড়িবাঁধ থেকে সুইপাররা নতুন ভবনে উঠবে। আগামী এক বছর বেড়িবাঁধে অস্থায়ীভাবে থাকার জন্য বেড়িবাঁধ ভরাট করে বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে।
পিডিএসও/তাজ