পাবনা প্রতিনিধি

  ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

চলনবিলে পরিবেশ বিপর্যয়

পদ্মা ও যমুনার সংযোগ রক্ষাকারী চলনবিলের বড়াল নদী দখল ও দূষণে এখন অস্তিত্ব সঙ্কটে। বড়ালের উৎপত্তিস্থল রাজশাহীর চারঘাটে পদ্মা থেকে। বড়াল অববাহিকা উন্নয়নের নামে এই নদীটিকে হত্যা করা হয়েছে। বড়াল নদী রাজশাহী, নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার মধ্য দিয়ে ২০৪ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে বেড়া উপজেলায় এসে যমুনায় মিশেছে।

বড়াল হচ্ছে চলনবিলের প্রাণ। বড়াল শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিলের ১৬টি নদী, ৩৯টি বিল ও ২২টি খাঁড়ি পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। এর বিরূপ প্রভাবে এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও কৃষি খাত মারাত্মক হুমকির মুখে আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈশি^ক উষ্ণায়নের বিরূপ প্রভাব। পরিবেশ হচ্ছে রুক্ষ, বাড়ছে মরূকরণ। বিপর্যয় দেখা দিয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশে।

পদ্মা এবং যমুনার পানি যখন বাড়ে বড়াল নদী হয়ে সেই পানি প্রবেশ করে চলনবিলে। এতে বিল চালু থাকে। সে কারণেই বিলটির নামকরণ করা হয় ‘চলনবিল’। এই বিলের পানি সর্বদাই চলমান। চলনবিলের অভ্যন্তরে অসংখ্য ছোট-বড় বিল ও খাল রয়েছে। এসব বিল ও খাল প্রাকৃতিক। আবার বিল থেকে ছোট নদীর উৎপত্তি হয়েছে। নদী থেকে খাল হয়েছে। এক কথায় বলা চলে চলনবিল হচ্ছে অসংখ্য স্রোতের জাল। এ নদী থেকে আরো নয়টি নদীর উৎপত্তি হয়েছে। সেগুলো থেকে সৃষ্টি হয়েছে অনেক নালা বা খাল।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, চলনবিলের প্রাণ বড়াল নদীতে পানি প্রবাহ না থাকার কারণে নন্দকুজা, মুসা খাঁ, ভদ্রাবতী, সরস্বতী, ইছামতী, গুমানী, আত্রাই, ফুলঝোর, তুলসী, চেঁচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, গোহালা নদীসহ ৩৯টি বিল ও ২২টি খাঁড়ি শুকিয়ে গেছে। নদী, বিল ও খাঁড়ি শুকিয়ে জেগে উঠেছে দিগন্ত বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি। হারিয়ে যাচ্ছে জলজ গুল্মলতা ও জীববৈচিত্র্য। বেড়েছে আর্সেনিকের মাত্রা। আবহাওয়ায় বিরাজ করছে রুক্ষতা।

বড়াল নদীকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। রাজশাহীর চারঘাট থেকে জন্ম নিয়ে বড়াল নদী নাটোরের গুরুদাসপুরের কাছে আত্রাই নদীতে মিশেছে। এই অংশকে আপার বড়াল বলা হয়। এই অংশের দৈর্ঘ্য ৮৪ কিলোমিটার। বড়াইগ্রামের আটঘড়ি থেকে বেরিয়ে বনপাড়া, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, সাঁথিয়া হয়ে শাহাজাদপুরের বাঘাবাড়ীঘাটের ভাটিতে চয়ড়ায় হুড়াসাগর নদের সঙ্গে মিলিত হয়ে যমুনা নদীতে মিশেছে। এই অংশ লোয়ার বড়াল নামে পরিচিত। লোয়ার বড়ালের দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার। বড়াল নদীর মোট অববাহিকা হচ্ছে ১ হাজার ৫৪২ বর্গকিলোমিটার। আপার বড়ালের গড় প্রস্থ ৬০ মিটার, গড় গভীরতা ৫ মিটার। লোয়ার বড়ালে গড় প্রস্থ ১২০ মিটার, গভীরতা ৯ দশমিক ৯০ মিটার।

বড়ালের দুটি শাখা নদী হচ্ছে মুসা খাঁ এবং নন্দকুজা। মুসা খাঁ নদীর উৎপত্তি নাটোরের বাগাতিপাড়া হাঁপানিয়ায়। পাইকপাড়া গিয়ে মুসা খাঁ নদী থেকে উৎপত্তি হয়েছে নারোদ নদীর। এই নদীটি নন্দকুজা নদী হয়ে আত্রাই নদীতে মিশেছে। বড়ালের একটি প্রশাখা নাগর নদী। এই নদী তীরেই আত্রাই উপজেলার পতিসরের রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি। এই নদীকে নিয়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছেন “আমাদের ছোট নদীচলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে...।”

চলনবিলের মধ্য দিয়েই বড়াল-আত্রাই-নাগর নদী পথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শাহজাদপুর থেকে পতিসরে এবং পতিসর থেকে নাটোরে যাতায়াত করতেন। বড়ালের শাখা নন্দকুজার উৎপত্তি নাটোরের আটঘড়িতে। নদীটি নাটোর হয়ে গুরুদাসপুরের চাঁচকৈড়ে আত্রাই নদীর সঙ্গে মিশেছে। নন্দকুজা এবং আত্রাইয়ের মিলিত প্রবাহ গুমানী নাম ধারণ করে চাটমোহরের নুননগরে বড়ালে মিশে বড়াল নামেই বাঘাবাড়ী চলে গেছে। বাঘাবাড়ীর ভাটিতে বড়াল এবং করতোয়ার মিলিত প্রবাহ হুড়াসাগর নাম ধারণ করে ৮ কিলোমিটার ভাটিতে যমুনায় মিলেছে।

চলনবিলের প্রাণ খরস্রোতা বড়াল নদীকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বড়াল বেসিন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় ১৯৮৫ সালে চারঘাটে বড়াল নদীর উৎস্য মুখে নির্মাণ করে তিন দরজা বিশিষ্ট স্লুইস গেট। পদ্মা নদী থেকে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া বড়াল নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বন্ধ করা হয় ১৯৯৫-৯৬ সালে নাটোরের আটঘড়ি নামকস্থানে আরো একটি পাঁচ দরজা বিশিষ্ট স্লুইস গেট নির্মাণ করে।

এই গেটটি নির্মাণের ফলে দক্ষিণ দিকের অংশে পানি থাকলেও উত্তর দিকের অংশে পানি চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এখানেই বড়াল দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এক ভাগ নন্দকুজা অপর ভাগ বড়াল। এখানেই বড়ালের মুখে নির্মাণ করা হয় এক দরজা বিশিষ্ট একটি স্লুইস গেট। একদিকে বড়ালের উৎস্য মুখে চারঘাটে স্লুইস গেট, অন্যদিকে দীর্ঘদিন এত বড় একটি নদীর মুখে এক দরজার একটি স্লুইস গেট নির্মাণ করায় ভাটির বনপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকায় নদী অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে।

বনপাড়ার ভাটিতে বড়াল নদীতে তৃতীয় ও চতুর্থ স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয় ভাঙ্গুড়া এবং চাটমোহরের দহপাড়ার নিকটে। দহপাড়ার নিকটবর্তী স্লুইস গেটটির উভয় পাশই শুকিয়ে যায় শুষ্ক মৌসুমে। অনেকেই নদী দখল করে ঘরবাড়ি, দোকান-গুদাম উঠিয়েছে। নদীর মধ্যে চাষাবাদ করা হচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে পানি চলাচল বন্ধ করে মাছ চাষ করা হয়।

বড়াল অববাহিকার ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সত্তর দশক পর্যন্ত বড়াল যেমন ছিল স্থানীয় যোগাযোগ ও বাণিজ্যের চালিকাশক্তি, তেমনি ছিল সংস্কৃতি ও বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র। বড় বড় পণ্যবাহী নৌকা, বার্জ, জাহাজ, কার্গোজাহাজে পণ্য সামগ্রী আনা-নেওয়া হতো বড়াল নদী পথে। চলত বড় বড় লঞ্চ ও স্টিমার। তখনকার সময়ে এই বড়াল নদীতে ফেরি চলাচল করত। ঢাকা-পাবনা আসতে হলে এই বড়াল নদীর ফেরি পারাপার হয়েই নগরবাড়ী, নাজিরগঞ্জ ঘাট যেতে হতো।

এ নদীই ছিলে দক্ষিণ বঙ্গের সঙ্গে একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম। যে কারণে বাঘাবাড়ীতে ব্রিজ হলেও বাঘাবাড়ীঘাট বলে পরিচিত লাভ করে। এই অঞ্চলের শতকরা নব্বইভাগ অধিবাসীই ছিল বড়াল নদীর ওপর নির্ভরশীল। চারঘাটে স্লুইস গেট নির্মাণ করার ফলে নদী সঙ্কুচিত হতে থাকে, পানি প্রবাহ হ্রাস পায়। এর ফলে পরিবর্তিত হতে থাকে পরিবেশ ও বড়াল পারের মানুষের জীবন-জীবিকা। বড়াল অববাহিকার অর্থনীতি মূলত কৃষি, মৎস্য ও গবাদি পশুসম্পদনির্ভর। ধান, চাল, মসুর, খেসারি, সরিষা, মাষকলাই, পাট প্রভৃতি উৎপাদনের জন্য বড়াল অববাহিকার সুখ্যাতি ছিল। নৌপথে বড়াল পারের ফসল যেত চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

বড়ালে যখন পানির প্রবাহ ছিল স্বাভাবিক তখন শুষ্ক মৌসুমে নদীতীরের জমিতে নদীর পানি পাওয়ার পাম্প দ্বারা সেচ দেওয়া হতো। নালা বা খালে পানির প্রবাহ ছিল। তাতে বিলের অভ্যন্তরের জমিতে সেচ দেওয়া যেত। নদীতে ক্লোজার নির্মাণ করার পর পানি না থাকায় সেচ হয়েছে শ্যালো বা ডিপ মেশিননির্ভর। বড়াল নদী অববাহিকায় এখন ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। নদী মরে যাওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে বিশাল চলনবিলে।

চলনবিলের প্রসিদ্ধ মৎস্য সম্পদ হৃস পেয়েছে। হাঁস পালন কমেছে। বিশাল গোচারণভূমিতে আগের মতো মাষকলাই ও খেসারি ঘাস জন্মে না। তাতে গবাদিপশু সম্পদ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে বড়ালে পানি প্রবাহ না থাকায় বিল শুকিয়ে যায়। এতে চাষি ও মৎস্যজীবীদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। জেলে সম্প্রদায় এখন বিলুপ্তপ্রায়। উত্তরাঞ্চলের মৎস্য ভান্ডার হিসেবে পরিচিত চলনবিলে ৭০ থেকে ৭৫ প্রকার মাছ পাওয়া যেত। এখন তার অনেক প্রজাতিই বিলুপ্তির তালিকায় নাম উঠেছে।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পাবনা,চলনবিল,পরিবেশ বিপর্যয়
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist