শংকর চৌধুরী, খাগড়াছড়ি
শুকিয়ে যাচ্ছে ‘দেবতার পুকুর’
মাতাই পুকুরী একটি পুকুরের নাম। ত্রিপুরা ভাষায় ‘মাতাই অর্থ প্রভু বা দেবতা’। আর ‘পুকুরী অর্থ পুকুর’। স্থানীয়দের বিশ্বাস, তৃষ্ণা নিবারণে দেবতারাই এ পুকুর খনন করেছেন। তাই স্থানীয়দের কাছে এ পুকুরের পানি দেবতার আশীর্বাদ, যা কমে না। বাস্তবতা হলো পাথরখেকোদের কবলে পড়েছে এ পুকুর।
পাহাড়, ঝিরি, ঝর্ণা ও পাহাড়ি ছড়া থেকে অবৈধভাবে পাথর তুলে নেওয়ার কারণে হুমকির মুখে রয়েছে পুুকুরটি। এছাড়া পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। জেলা প্রশাসক বলেছেন এই প্রকৃতিনাশীদের বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাহাড়ি ছড়া, ঝিড়ি, ঝর্ণা থেকে সরকারিভাবে পাথর উত্তোলনের অনুমতি নেই। তারপরও পাথরখেকোরা প্রশাসনের চোখের সামনেই প্রতিদিন পাথর উত্তোলন করছে। এই বেআইনি কাজ দেখার কেউ নেই। ঝর্ণা, ছড়া, ঝিড়ি ও পাহাড় থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ করা না গেলে যেকোনো সময় ঘটতে পারে পাহাড় ধস ও পরিবেশ বিপর্যয়।
পাহাড়ের যত ওপরে উঠবেন, পানি ততই মহার্ঘ্য বস্তু হয়ে উঠে। পানির প্রাকৃতিক উৎস না থাকলে উঁচু পাহাড়ে পানি জমানো আসলেই দুষ্কর ও কষ্টসাধ্য এবং ব্যয় সাপেক্ষও বটে। পাহাড়ের ওপরে যত লেক বা পুকুর দেখা যায় তার পেছনে কোনো না কোনো লোককাহিনি পাওয়া যায়। ঘুরে ফিরে লেক বা পুকুরের কৃতিত্বের দাবিদার হয়ে যান কোনো না কোনো দেবতা। আর এই দেবতা পুকুরের স্থানীয় নাম মাতাই পুকুরী। আশপাশে ত্রিপুরা নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত হওয়ায় নামটাও তাই ত্রিপুরা ভাষায়।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত, চার পাশে জঙ্গল ও পাহাড়বেষ্টিত পুকুরটির গড় দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫০০ ফুট এবং গড় প্রস্থ ৬০০ ফুটের মতো। পুকুরের একপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি বড় বড় পাথর। প্রতি বছর চৈত্র-সংক্রান্তি ও ১ বৈশাখে উৎসব ও মেলা বসে এখানে। জেলার সব ধর্মের অনুসারীসহ দেশ-বিদেশ থেকে আসা তীর্থযাত্রী ও পর্যটকরা এ বর্ষবরণ উৎসবে অংশগ্রহণ করেন।
তীর্থযাত্রী এবং পর্যটকদের যাতায়াতের সুবিধার্থে, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের খাগড়াছড়ি প্রকৌশল বিভাগ প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা ব্যয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করে তা তীর্থযাত্রী ও পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করেছেন।
এ পুকুরটির পাশ ঘেঁষে থলিপাড়া এলাকা হয়ে বয়ে আসা পাহাড়ি ছড়া থেকে পাথরখেকোরা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করার ফলে এখন হুমকির মুখে পড়েছে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের নুনছড়ি এলাকায় অবস্থিত এ জেলার শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী মাতাই পুকুরী দেশ-বিদেশে (দেবতা পুকুর) নামে পরিচিত জলাশয়টি। ফলে রাঙামাটির মতো আবারও বড়ধরনের পাহাড় ধসের আশঙ্কায় আছেন এলাকাবাসী।
২৫৭ নম্বর মৌজার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কার্বারি থোয়ংগ্য মারমা বলেন, বিএনপি নেতা আইয়ুব আলী এলাকায় সেনাবাহিনীর রাস্তার কাজে ব্যবহার করার কথা বলে, প্রভাব খাটিয়ে ট্রাক্টর দিয়ে ছড়া থেকে পাথর নিয়ে যাচ্ছে। ৫ নম্বর নুনছড়ি হ্যাডম্যান পাড়ার কার্বারি তেজেন্দ্র লাল রোয়াজা বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আম্যে মারমার যোগসাজশে আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াস উদ্দিন (গিয়াস উদ্দিন লিডার) ও আইয়ুব আলী এখান থেকে পাথর তুলে বিক্রি করে।
ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আম্যে মারমা বলেন, আমি একবার গিয়ে পাথর তুলতে দেখেছি, কারা তুলছে তা জানি না। তবে থলিপাড়ার ছড়া থেকে পাথর আনতে গেলে কে বা কারা পাথরবাহী একটি ট্রাক্টর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে বলে শুনেছি। পাথর উত্তোলনের মূল হোতা আইয়ুব আলী ও গিয়াস উদ্দিন লিডার।
এদিকে, খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ জানান, অবৈধভাবে ছড়া থেকে পাথর উত্তোলন করে নিয়ে যাওয়ার সময়, গত ১৩ ফেব্রæয়ারি জেলা সদরের ঘুগড়াছড়ি রাবার বাগান এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় টহলরত যৌথবাহিনীর সহায়তায় পাথর বোঝাই দুইটি ট্রাক্টরসহ দুইজনকে আটক করা হয়। উদ্ধার করা হয় প্রায় ৫২৫ ঘনফুট পাথর, যার বাজার মূল্য সাড়ে ৫২ হাজার টাকা। পরে তাৎক্ষণিক ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড আদায় করে পাথরগুলো ফরেস্টের জিম্মায় রেখে মুচলেকা নিয়ে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে দিনমজুর হিসেবে কাজ করা মনছুর আলম ও মো. আল আমিনকে আটক করে সাজা দিলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে আসল পাথরখেকোরা।
ইউএনও সৈয়দ শামসুল তাবরীজ আরো জানান, বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সেনাবাহিনীর অফিসার পরিচয়ে হারিছ নামের এক লোক পাথর তুলে বলে জেনেছি। ছড়া থেকে পাথর তুলে আনার সময় গাড়িতে সেনাবাহিনীর কাজে নিয়োজিত লেখা দেখে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, এ পাথর সেনাবাহিনীর কোনো কাজের জন্য নয়। তাদের নাম ভাঙিয়ে কিছু অসাধু লোক এই কাজ করছে। সাংবাদিক পরিচয়ে আবদুর রউফসহ একটি সিন্ডিকেট এই কাজের সঙ্গে জড়িত বলেও জানান তিনি।
খাগড়াছড়ি সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল আজম বলেন, আবদুর রউফের মতো কিছু লোক সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে অবৈধ ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ অসামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িত।
এ বিষয়ে আবদুর রউফ জানান, মহালছড়ি সিন্দুকছড়ি সড়কে চলমান কাজের জন্য একজন ঠিকাদার, সেনাবাহিনীকে না জানিয়ে ছড়া থেকে পাথর আনার সময় দুজন লেবারসহ ধরা পড়ে। এই ঘটনার পর উভয় পক্ষের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে তাদের ছাড়িয়ে আনা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, এই ছড়ার পানি দিয়ে জমি চাষাবাদ করে কৃষকরা। অবৈধভাবে পাথর তুলে নেওয়ার কারণে ছড়া শুকিয়ে এখন মরার পথে। এ বিষয়ে বিচিতলা সেনাবাহিনীর সাবজোন, জেলা প্রশাসক, থানাসহ সব জায়গায় জানিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না।
পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোনের সভাপতি প্রদীপ চৌধুরী বলেন, এ অবৈধ পাথর তোলা বন্ধ না হলে আবারও যেকোনো সময় ঘটতে পারে পাহাড় ধসের মতো বড় ধরনের দুর্ঘটনা। এছাড়া নুনছড়ি থলিপাড়া এলাকায় পাহাড়ি ছড়া থেকে অবৈধভাবে পাথর নিয়ে যাওয়ার ফলে, হুমকির মুখে পড়েছে দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করা এই জেলা স্বনামধন্য মাতাই পুকুরী ( দেবতা পুকুরটি)। পরিবেশ ধবংসকারীদের বিরুদ্ধে দ্রæত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনের প্রতি দাবি জানান তিনি। খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. রাশেদুল ইসলাম জানান, অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পিডিএসও/তাজ