মীর আসলাম, রাউজান থেকে
হালদায় ৩ মাসে মারা গেছে ১৬ ডলফিন
ড্রেজারে বালু উত্তোলন বন্ধ দাবি
বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে একের পর এক মারা যাচ্ছে ডলফিন। শুধু ডলফিনই নয়, নানা প্রজাতির মাছও মরে ভেসে উঠছে ওই নদীতে। গত শনিবার ভোরে নদীতে মরে ভেসে উঠছে একটি ডলফিন ও বড় বোয়াল মাছ। গত ২৫ দিনে চারটি মৃত ডলফিন ভেসে উঠেছে হালদা নদী ও সংলগ্ন খালে। গত তিন মাসে এ নিয়ে হালদায় ১৬টি ডলফিন মরেছে।
বালু উত্তোলনকারী ড্রেজারের প্রপেলারের আঘাতে ডলফিন মারা যাচ্ছে বলে জানা গেছে। মৎস্যজীবী ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়মিত ডলফিন মারা যাওয়ার এ চিত্র অত্যন্ত বিপজ্জনক। ডলফিনের মৃত্যুর পর টনক নড়েছে প্রশাসনের, অনুসন্ধানে জেলা মৎস্য অফিসের কর্মকর্তারাও মাঠে নেমেছেন।
নদীতীরবর্তী গড়দুয়ারা গ্রামের মৎস্যজীবী কামাল মেম্বার জানিয়েছেন, শনিবার ভোরে একটি মরা ডলফিন ভেসে উঠেছে গড়দুয়ারার কাছে। একই দিন আট কেজি ওজনের মরা বোয়াল মাছ পাওয়া গেছে বিপরীতে কাগতিয়ার দিকে। নদী পাড়ের অনেকেই বলেছেন এর আগেও বিভিন্ন সময় নদীতে ডলফিন এবং বড় বড় মা মাছ মরে ভেসে উঠেছিল। মারা যাওয়া ডলফিনে জখমের চিহ্ন ছিল বলে জানিয়েছেন তিনি।
নদী পাড়ের লোকজনের অভিযোগ, হালদা নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে প্রতিনিয়ত বালু ওঠানো হচ্ছে। এ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ড্রেজার আর ওঠানো বালু পরিবহন করা হচ্ছে যান্ত্রিক নৌযানে। এই ড্রেজার ও ট্রলারের প্রপেলারে আঘাতে নদীর জলজপ্রাণী প্রতিনিয়ত মারা পড়ছে। এসব কাজে যুক্ত এলাকার প্রভাবশালী মহল। এ কারণে প্রশাসনও কার্যকর অভিযান পরিচালনার থেকে বিরত থাকছে বলে অভিযোগ।
হালদা নদী ও জলজপ্রাণী নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া জানান, গত তিন মাসে হালদায় ১৬ ডলফিন মারা যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে। হালদায় মা মাছ ও ডলফিন মরে ভেসে ওঠার এই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এ ছাড়া সেখানে বালু ব্যবসায়ীদের উৎপাত রয়েছে। তিনি বলেন, এসব জলজপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেলে এই নদী আর নদী থাকবে না। পরিণত হবে মরা নদীতে।
এই বিশেষজ্ঞের দেওয়া তথ্যানুসারে হালদা নদীতে যে প্রজাতির ডলফিন রয়েছে বিশ্বে এই প্রজাতির ডলফিনের সর্বমোট সংখ্যা মাত্র এক হাজার ২০০। এগুলোর অবস্থান বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের বিভিন্ন নদনদীতে। বাংলাদেশের পদ্মা, গঙ্গা শাখা নদীসমূহে অল্প কিছু ডলফিনের বিচরণ রয়েছে। চট্টগ্রামের সাঙ্গু আর কর্ণফুলী নদীতে কয়েক বছর আগে এই প্রাণীর দেখা গেলেও এখন আর দেখা মিলে না।
হালদা বিশেষজ্ঞ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মঞ্জুরুল কিবরিয়া জানান, এখানকার ডলফিনের চোখ নেই। মূলত ইকো সাউন্ড দিয়ে এরা চলাফেরা ও খাবার সন্ধান করে। এদের শরীরের গঠনও নরম প্রকৃতির। ড্রেজারের প্রপেলার বা অন্য কোনো অংশের আঘাত এরা সহ্য করতে পারে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, হালদায় ২০০টির মতো ডলফিন আছে। এর মধ্যে ১৬টি মারা গেল। হালদায় ড্রেজারে বালু উত্তোলন বন্ধ করা এবং নদীটিকে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) ও ডলফিনের অভয়াশ্রম ঘোষণার দাবি জানান তিনি।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হালদা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০ কিলোমিটার। হালদার সঙ্গে সংযুক্ত আছে ১৭টি খাল। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান এই প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র দেশে কার্প জাতীয় মাছের রেণুর প্রধান উৎস। দখল, দূষণ এবং চোরা শিকারির উৎপাতে বিপন্ন হালদার মা মাছও।
পিডিএসও/তাজ