তুহিন খান নিহাল

  ১২ মে, ২০১৮

বাড়ছে আমদানি ছবির বাজার

দেশের অভ্যন্তরীণ সিনেমাশিল্পে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন দরকার। যদিও গত বছর যৌথ প্রযোজনায় চলচ্চিত্র নির্মাণ নীতিমালার চূড়ান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বেশ জোরালো আন্দোলন করেছে চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত চলচ্চিত্র পরিবার। সংগঠনগুলোর সংঘবদ্ধ আন্দোলন সফল হলেও নতুন করে দেখা দিয়েছে আরেক সমস্যা। সেটা হলো সাফটা চুক্তি। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মুক্তবাণিজ্য চুক্তিকেই সংক্ষেপে বলা হয় সাফটা। দিনে দিনে চলচ্চিত্রের বাজারে বাড়ছে এ সাফটার আগ্রাসন।

২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে ইসলামাবাদে সাফটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে মজার বিষয় হলো, সার্কভুক্ত সব কটি দেশের মধ্যে চুক্তি হলেও ছবি আসছে কেবল ভারতের কলকাতা থেকেই। সাফটা তো কেবল কলকাতার সঙ্গেই সীমাবদ্ধ নয়! তবে অন্য দেশের বা ভারতের অন্য প্রদেশের ছবিগুলো কেন আসছে না? তবে কেন শুধু কলকাতার ছবিই আসবে এ দেশে—এমন প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারোরই।

সাফটায় আমদানি করা ওপারের বাংলা ছবিগুলো এগিয়ে থাকায় দেশীয় নির্মাতারা হল না পেয়ে হতাশ হচ্ছেন। মোটকথা, সাফটায় আসা ছবিগুলোর চেয়ে অর্ধেকও হল পায় না এ দেশের ছবিগুলো। ভাষা ও সংস্কৃতিতে মিল থাকায় এ দেশের ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংসে কলকাতার ছবিকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে এ দেশের পরিচালকরা উৎসাহ হারাচ্ছেন ছবি নির্মাণে। আবার যৌথ প্রযোজনার আইনভঙ্গের দায়ে আটকে থাকা ছবিগুলো এখন ভারতীয় ছবি হিসেবে সাফটা চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। সেটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে একই দিনে কিংবা এক সপ্তাহ আগে-পিছে বাংলাদেশ মুক্তি পাচ্ছে।

বর্তমানে লক্ষ করা যাচ্ছে, যৌথ প্রযোজনার নামে নির্মাণাধীন ছবি মুক্তি দিতে কোনোভাবে ব্যর্থ হলে তা হয়ে যায় সাফটা চুক্তির ছবি। মোটকথা, নিয়ম না মেনে তৈরি করা যৌথ প্রযোজনার সিনেমা মুক্তির শেষ হাতিয়ার হচ্ছে সাফটা। আবার ঈদে এ দেশে প্রেক্ষাগৃহে বেশ কয়েকটি সিনেমা মুক্তির কথা থাকলেও এখানেও দেশের সিনেমা প্রভাবিত হচ্ছে সাফটা চুক্তির কাছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের জাজ মাল্টিমিডিয়া ও কলকাতার জিৎ ফিল্ম ওয়ার্কসের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ছবি ‘সুলতান দ্য সোভিয়ার’ নিয়েও ঝরছে অবিরাম কথার বৃষ্টি। গত ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রিভিউ কমিটি থেকে ‘সুলতান’ নির্মাণের আবেদন করে জাজ মাল্টিমিডিয়া। এরপর ছবিটি নির্মাণের অনুমতি পায় জাজ। রাজা চন্দের পরিচালনায় অবশেষে যৌথ প্রযোজনা থেকে নিজেদের নামও সরিয়ে নিয়েছেন এ দেশের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া।

‘সুলতান দ্য সোভিয়ার’ ছবিটি প্রযোজনা করছেন না জাজ। এখানেও ঈদে ছবিটি মুক্তির মূল হাতিয়ার হলো সাফটা। আবার কলকাতার নির্মাতা জয়দেব মুখার্জি পরিচালিত ‘ভাইজান এলো রে’ ছবির শুটিং শেষ করে এসে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতিতে ছবিটি নির্মাণের অনুমতি চেয়ে আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন ছবিটির নির্মাতা। কলকাতার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এস কে মুভিজের প্রযোজনায় আবেদনপত্রে শাকিব খান, শ্রাবন্তী চ্যাটার্জি ও পায়েল সরকার অভিনয় করার কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। আবার নিজেকে এ দেশে পরিচালক সমিতির সদস্য করার জন্যও আবেদন করেছেন জয়দেব। কিন্তু তার আবেদন গ্র্রহণ করেনি পরিচালক সমিতি। এদিকে এই ছবিটিও ঈদে মুক্তির হাতিয়ার সাফটা চুক্তি।

তবে পরিতাপের বিষয়, চলচ্চিত্রের নানা সংকট ও সমস্যা সমাধানে আন্তরিক থাকলেও সাফটার আওতায় ছবি আমদানি রোধ করতে খুব একটা সক্রিয় দেখা যায় না চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সমিতি ও নেতাদের। তবে সাফটা বা বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে কোনো উৎসবে যদি বিদেশি ছবি এ দেশে আসে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো ছবি যদি মুক্তির অপেক্ষায় না থাকে, তাহলেই কেবল বাইরের ছবি সাফটার আওতায় মুক্তি পেতে পারে, এমন কথা চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টরা বললেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই। দিনে দিনে সরকারকে বোকা বানিয়ে, দেশের সিনেমাশিল্পের যে ধস নামানো হচ্ছে, সে বিষয়ে নির্বিকার চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট মানুষরা।

দেশীয় চলচ্চিত্র ধ্বংস করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে এক হতে পারছে না চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সমিতিগুলোও। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও যেন সবকিছু বুঝেও না বোঝার ভান করে আছে। সেন্সর বোর্ডও শাসনের জায়গাটিতে মজবুত হতে পারছে না। ফলাফল, হল দখলের লড়াইয়ে বিদেশি ছবির কাছে দেশীয় ছবির করুণ আত্মসমর্পণ।

সাফটা চুক্তির নামে চলছে অনিয়মের রাজত্ব। ‘একটি ছবি যাবে, একটি ছবি আসবে’ এই নীতিতে ছবি আসার খবরই পাওয়া যায়। যাওয়ার খবরটি কেন জানি অন্তরালে থেকে যায়। খোঁজ করে যেসব ছবির নাম পাওয়া যাচ্ছে, রফতানির তালিকায় সেগুলো উল্টো বিব্রত করে যায়। মানহীন, সুপার ফ্লপ, অপরিচিত সব নির্মাতা, তারকাদের ছবি যাচ্ছে ভারতে। সেগুলো ওপারে কোনো আলোচনাই পাচ্ছে না, পাচ্ছে না কোনো হল। বরং ছবির মানহীনতার জন্য বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে খাটো করে দেখারই বিজ্ঞাপন চলছে।

যারা এ দেশের মানুষই না। আবার তাদের অনেকেই পেয়েছে ভিনদেশের সিনেমা আমদানি-রফতানির ব্যবসা করার লাইসেন্স। তারা কখনো দেশের ছবি বা ভিনদেশের ছবি এসব ভাববে না। কারণ তাদের কাছে ব্যবসাটাই মুখ্য। আর ভাবলেও সে যে দেশের ছবিকেই প্রাধান্য দেবে। বিশেষ একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সহযোগী হয়ে সিনেমা আমদানি করছে তারা। ফ্লপ ছবিগুলো নিয়ে এসে প্রভাব খাটিয়ে হল দখল করছে। যখন ওই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ছবি আসে তখন কিন্তু তারা হলে দেশীয় ছবিই দেখাচ্ছে। যখন নিজের হাউসের ছবি থাকে না, তখন হলে বিদেশি ছবিকে দিয়ে দেশীয় ছবিকে হুমকিতে ফেলা হয়। আর এ দেশ থেকেও ফ্লপ ও মানহীন ছবি ওপারে দিচ্ছে।

চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট মানুষের দাবি, দ্রুতই এ বিষয়ে সমঝোতায় আসা উচিত। চলচ্চিত্র আমদানির বর্তমান পরিস্থিতি ও এর ভয়াবহ পরিণাম তুলে ধরতে হবে। আনতে হবে চুক্তির রদবদল, যাতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বঞ্চিত না হয়, নষ্ট না হয় চলচ্চিত্রের অভ্যন্তরীণ বাজার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশীয় চলচ্চিত্রের স্বার্থে হওয়া সাফটা চুক্তিকে অপব্যবহার করে চলেছেন আমদানিকারকরা। তারা নিজেদের ইচ্ছামতো ওপার থেকে ছবি আনছেন, নিজেদের ইচ্ছামতোই দুর্বল, মানহীন ছবিগুলো ওপারে পাঠাচ্ছেন।

প্রতি সপ্তাহে মুক্তি পাওয়া দেশীয় ছবিগুলোকে কোণঠাসা করে রাখছেন। তাদের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে বুকিং এজেন্ট ও হলমালিকরাও দেশীয় ছবির প্রতি মনোযোগী হতে পারছেন না। আমদানিকরকরা নানাভাবে বুকিং এজেন্ট ও হলমালিকদের প্রভাবিত করেন, পরিচালিত করেন। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বরাবরই বুকিং এজেন্ট ও হলমালিকরা দেশের ছবির দুর্বলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। আর চলচ্চিত্রের এ সংকটময় সময়ে এসব বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের মানুষদের আরো বেশি সোচ্চার হতে হবে। এক হতে হবে সবাইকে।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সাফটা,ভারতীয় ছবি,সিনেমা আমদানি-রফতানি,দেশীয় সিনেমা,চলচ্চিত্র
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist