পাঠান সোহাগ

  ২৩ নভেম্বর, ২০১৭

সার্টিফিকেট-সর্বস্ব বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ

অভিভাবকদের ইচ্ছা পূরণের বলি হচ্ছে শিক্ষার্থীরা

দীর্ঘ সিরিয়ালের পর ডাক্তারদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেম্বারে গিয়ে অনেক রোগী কিংবা তাদের স্বজনরা মোহিত হয়ে যান। অনেকে আবার উত্তম সুচিত্রার সিনেমা দেখেও মনে মনে স্বপ্ন দেখেন তাদের ছেলেমেয়েদের ডাক্তার বানাবেন। এ রকম শখের বশবর্তী হয়ে বাবা-মা তাদের সন্তানদের মেডিক্যালে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে তাদের মেধা ঝোঁক ও পছন্দ কিছুই বিবেচনা করা হয় না। পাবলিক মেডিক্যালে সুযোগ না পেলে প্রয়োজনে টাকা ঢেলে বেসরকারি মেডিক্যালে ভর্তি করানো হয়। অনেক কষ্টে অর্জন করা হয় ডাক্তারি সার্টিফিকেট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে পড়ে ডাক্তারি সার্টিফিকেট পাওয়া যায়, কিন্তু ডাক্তার হওয়া যায় না।

ওই শিক্ষার্থী আর মেডিক্যালবিজ্ঞানে আর মেধার পরিচয় দিতে পারেন না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন রোগী এমনকি স্বয়ং সেই চিকিৎসক। অভিভাবক, মেডিক্যাল শিক্ষার্থী, ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও স্বাস্থ্য শিক্ষা চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এমন কথা জানা গেছে।

তারা জানান, সবার ভাগ্যে জোটে না চিকিৎসক হওয়া। সরকারি মেডিক্যাল কলেজের আসনসংখ্যা সীমিত। অভিভাবকদের স্বপ্নপূরণ করতে অনেকেই শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। তখনই এসব প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠে ডাক্তার বানানোর কারখানায়। ওই সব মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার মান নিয়েও আছে প্রশ্ন।

রাজধানীর উত্তরায় মিশু নামে এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় চান্স হয়েছে। কিন্তু মা-বাবার ইচ্ছায় প্রাইভেট মেডিক্যালে ভর্তি হতে হবে। তাদের সিদ্ধান্তই আমাদের মেনে নিতে হয়।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক বলেন, ‘বড় মেয়েকে মেডিক্যালে পড়ানোর ইচ্ছা ছিল। সরকারি মেডিক্যাল কলেজে সিট পাবে না। অপেক্ষমাণ তালিকায় আছে। যেকোনো মূল্যে ভালো একটা প্রাইভেট মেডিক্যালে ভর্তি করাতে চাই।’ টাকার প্রসঙ্গ উঠলেই তিনি বলেন, ‘বাড়িতে কিছু জমি বিক্রি করব। আর কিছু বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করব। কিন্তু মেয়ে জানিয়ে দিয়েছে এত টাকা দিয়ে প্রাইভেট মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছা নেই। অন্য কোথাও চান্স হলে সেখানেই পড়বে।’

৫ নভেম্বর স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরপরই ভর্তি পরীক্ষায় পাসকৃত শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং বিভিন্ন বেসরকারি মেডিক্যাল ভেতওে ভেতরে ভর্তির প্রাথমিক কাজ শুরু করে দিয়েছে। চলছে উভয়পক্ষের আলোচনা। শুরু হয়েছে ভর্তি নিয়ে বাণিজ্য। ন্যূনতম পাস নম্বরপ্রাপ্তদের দৌড়ঝাঁপই বেশি।

উত্তরা এলাকার মিজানুর নামের এক অভিভাবক জানান, তিনি উত্তরা, ধানমন্ডি ও মগবাজারে কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজে গিয়েছিলেন। অপেক্ষমাণ তালিকার পেছন দিকে ছিল তার সন্তান। এজন্য পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা বেশি দাবি করা হয়েছে। ভর্তির সুযোগ পাবেন-এমন আশ্বাস পেয়ে তিনি বেশি টাকা দিতেও রাজি। কিন্তু ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থী বলছেন, অভিভাবক চাইলেও তারা প্রাইভেট মেডিক্যালে ভর্তি হতে চান না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অধ্যাপক ডা. মো. মজিদ ভূঁইয়া প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘ছেলে-মেয়েদের সিদ্ধান্তের ওপর নজর দিতে হবে। তারা যে বিষয়ে পড়তে চায়, সেই বিষয়েই পড়ুক তারা।’ বর্তমানে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলো ‘মেডিক্যাল কিন্ডারগার্টেন’ হিসেবে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, ‘এখানে পড়ে ডাক্তারি সার্টিফিকেট পাওয়া যায়, ডাক্তার হওয়া যায় না। পর্যাপ্ত ভিসেরা ডিলিংস, ডেডবডি ডিসেকশন, প্যাসেন্ট এক্সামিনেশন, অপারেটিভ প্রসিজিউরে অংশগ্রহণ ছাড়া ডাক্তারি শেখা যায় না। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে এ পর্যাপ্ততা নেই।’

তিনি আরো বলেন, ‘সব কিছু কমার্শিয়াল চিন্তা করা যায় না। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে সেখানে শিক্ষার্থী ভর্তি করার অনুরোধ করেন তিনি। স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের জাতীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহাবুব প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘ডাক্তারি পড়ানোর ইচ্ছা সবারই থাকতে পারে। অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে আসন পেতে হবেÑএমন চিন্তা ভালো নয়। এ রকম হলে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সেক্টর যারা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের বিষয়টি ভালোভাবে দেখভাল করতে হবে ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’

নির্দিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সরকার নির্ধারিত ভর্তি ফি ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা। মানের দিক থেকে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম প্রথম দিকে রয়েছে, সেখানে অতিরিক্ত ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে ভর্তি করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বেসরকারি পর্যায়ে ৬৮টি মেডিক্যাল কলেজের ৬ হাজার ২৫০টি আসনে এমবিবিএস ভর্তিতে কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে একটি চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

এদিকে ন্যূনতম পাস নম্বর পাওয়া অনেক শিক্ষার্থী মেডিক্যাল কলেজগুলোর ৫ শতাংশ দরিদ্র শিক্ষার্থী কোটায় অর্থের বিনিময়ে ভর্তির তদবির শুরু করেছেন। এজন্য ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে যোগাযোগ করছেন। এতে দরিদ্র কোটায় প্রকৃত দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এ বিষয়ে অধিদফতরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. এমএ রশিদ বলেন, ‘বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের নীতিমালা বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। গরিব মেধাবীদের জন্য বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে বিনামূল্যে ভর্তির ব্যবস্থা আছে। কলেজভেদে আসনের চাহিদা আছে। তবে অনেক কলেজে আসন খালিও থাকে। দরিদ্র কোটায় অর্থের বিনিময়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অভিযুক্ত কলেজের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

"পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ,সার্টিফিকেট-সর্বস্ব,মেডিক্যাল কলেজ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist