হাসান শান্তনু

  ২২ নভেম্বর, ২০১৭

জালিয়াতি করে তিন বছরে ঢাবিতে ভর্তি শতাধিক

প্রশ্নফাঁস জালিয়াতির মাধ্যমে গত তিন বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ভর্তি হয়েছেন শতাধিক শিক্ষার্থী। এর জন্য প্রত্যেক পরীক্ষায় লেনদেন হয়েছে চার থেকে সাত লাখ টাকা। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, সরকারি ব্যাংকে নিয়োগ ও মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতিতে বড় চক্র জড়িত। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জালিয়াতির পুরো ঘটনা এতটাই নিখুঁতভাবে সংগঠিত হচ্ছে, শিক্ষার্থী ভর্তির পরও তা জানতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে জালিয়াতির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রশাসনসহ শিক্ষাবিদ, মেধাবী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। প্রতি বছর নতুন পন্থা অনুসরণ করছে জালিয়াতিচক্র। এ অপকর্ম বন্ধ করতে না পারলে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার মান ও গৌরব দুটোই হারাবে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।

সিআইডির অর্গানাইজ ক্রাইম ইউনিট সূত্র জানায়, জালিয়াতি চক্রের দুই ‘হোতা’সহ ভর্তি হওয়া সাত ছাত্রকে সম্প্রতি গ্রেফতারের পর জালিয়াতিচক্র সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। গত ১৪ নভেম্বর এ চক্রের ‘হোতা’ এনামুল হক আকাশকে গাজীপুর ও একই দিন নাবিদ আনজুম তনয়কে রংপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাবিতে জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হওয়া ছাত্রদের গ্রেফতার করা হয়। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্ত আমরা শুধু ঢাবি নয়, ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষা ও মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষাতেও জালিয়াতির তথ্য পেয়েছি। এসব বিষয়েও তদন্ত চলছে। প্রশ্ন ফাঁস ও জালিয়াতির মাধ্যমে প্রত্যেকটি ভর্তি পরীক্ষায় চার থেকে সাত লাখ করে টাকার লেনদেন হয়েছে।’

জানতে চাইলে ঢাবির সদ্য সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক এম আমজাদ আলী এ প্রসঙ্গে বলেন, জালিয়াতির মাধ্যমে ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়ে আটক হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরে ও বাইরের বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে আটক করে কয়েকজনকে নিয়ে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম। দুই থেকে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত চুক্তিতে তারা এ যন্ত্র ব্যবহার করে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন বলে জানান।

তবে কতজন পরীক্ষার্থী জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন, এ বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। ক্রমেই ভর্তি জালিয়াতি পরিণত হচ্ছে রমরমা বাণিজ্যে। প্রতিটি শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে দিতে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চুক্তি করছে জালিয়াতি চক্র। এমনকি জালিয়াতির টাকা ভাগাভাগির জন্য শিক্ষার্থী খুনেরও অভিযোগ রয়েছে। বারবার ধরা পড়লেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে জালিয়াতি চক্রের মূল অপরাধীরা। অসৎ পন্থা অবলম্বনের দায়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে আসা শিক্ষার্থীদের শাস্তি দিয়েই দায় সারছে প্রশাসন। মূল চক্রকে খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনতে পারছে না প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী একটি মহল এ চক্রের সঙ্গে জড়িত আছে বলে অভিযোগ আছে।

চক্রটি ২০১৭-১৮ সালের শিক্ষাবর্ষের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা সামনে রেখে কোটি টাকার মিশনে মাঠে নামে বলেও একটি সূত্রে জানা গেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবার ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে চক্রের সদস্যরা গ্রেফতারও হয়েছেন। যথাযথ বিচারের মুখোমুখি না হওয়া ও প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় চক্রের কর্মকা- দিনে দিনে বাড়ছে।

জানা যায়, গত পাঁচ বছরে ঢাবি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি), শাহজালাল বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ (শাবিপ্রবি) বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি করতে গিয়ে অন্তত চার শ সদস্য আটকও হয়েছেন। তাদের একটা বড় অংশ দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্ত করলে জালিয়াতির মাধ্যমে গত পাঁচ বছরের মধ্যে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কয়েক শ হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিদিনের সংবাদকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘২০১২ সাল থেকে মূলত এ জালিয়াতচক্রটি কাজ করে আসছে। তবে ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে জালিয়াতচক্রের মাধ্যমে শতাধিক ছাত্র ঢাবিতে বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। এ ছাড়া মেডিক্যাল ও ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষায় বড় একটি চক্রের আমরা সন্ধান পেয়েছি। এ নিয়েও কাজ চলছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, নিত্যনতুন প্রযুক্তির সাহায্যে পন্থা অবলম্বন করে জালিয়াতি করার বিষয়ে প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তার প্রযুক্তিগত ধারণা পর্যন্ত নেই। ফলে রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না চক্রকে। পরীক্ষার আগে অসদুপায় রোধে নতুন পদক্ষেপের কথা জানানো হলেও প্রযুক্তির অপব্যবহার বন্ধের বিভিন্ন উদ্যোগ কাজে আসছে না। ফলে ভর্তি পরীক্ষায় ডিজিটাল মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা কৌশলে জালিয়াতি করে যাচ্ছে চক্রটি। কয়েক বছর ধরে চক্রটি হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ভর্তির সুযোগ পাওয়ার ‘শতভাগ গ্যারান্টি’ দিয়ে ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, চক্রটি প্রথমে মুঠোফোনের খুদেবার্তার (এসএমএস) মাধ্যমে উত্তর পাঠিয়ে জালিয়াতি করে। সেই সিমকার্ডে খুদেবার্তা লেনদেনের মাধ্যমে প্রশ্নের উত্তর সমাধান করা হতো। বিষয়টি ধরা পড়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মুঠোফোনের মাধ্যমে জালিয়াতি ঠেকাতে ভর্তি পরীক্ষায় বারকোডের মাধ্যমে প্রশ্নপত্রের সেট কোড প্রবর্তন করে। তবে প্রশাসনের নতুন পদ্ধতিকে ধোঁকা দিতে চক্রটিও আশ্রয় নেয় নতুন পন্থার। বানাচ্ছে নতুন যন্ত্র। বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস, এটিএম কাডের মতো মুঠোফোন ফোন ও স্মার্ট ওয়াচ ব্যবহার করে তারা পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

অধিকাংশ সময় এসব জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকেন প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি। এ ছাড়া জড়িত আছেন অসাধু শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কোচিং সেন্টার। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের রাজনৈতিক কর্মী ও প্রশাসনের একটি মহল জড়িত বলেও অভিযোগ আছে। ফলে জালিয়াতি রোধে পরীক্ষার সময় কেন্দ্রে সব ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হলেও তাতে কাজ হচ্ছে না।

‘‘পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
প্রশ্নফাঁস,প্রশ্নফাঁস জালিয়াতি,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি,জালিয়াতিচক্র
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist