হাসান শান্তনু

  ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

মাদরাসার বই থেকে জিহাদি লেখা বাদ

বদলে যাচ্ছে মাদরাসার পাঠ্যবই। কোনো বইয়েই থাকছে না ইসলাম রক্ষার নামে জিহাদ-বিষয়ক উগ্র মতাদর্শের লেখা। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে মাদরাসার বিভিন্ন শ্রেণির ৩৫টি বইয়ের যৌক্তিক মূল্যায়ন করে নতুনরূপে সাজানো হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বর্ণিত মাদরাসার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুসরণ করে বইগুলো থেকে ধর্মীয় উসকানিমূলক লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে। বিতর্কিত লেখার পরিবর্তে নতুন লেখা যুক্ত হয়েছে। নতুনভাবে প্রণীত এসব বই আগামী শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীরা যেন জঙ্গিবাদে উৎসাহিত না হয়, সেজন্য বইগুলো থেকে জিহাদের পাঠ বাদ দেওয়া হয়েছে।

নতুন করে মুদ্রিত পাঠ্যবই পর্যক্ষেণের জন্য প্রথমবারের মতো বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন হচ্ছে। কমিটির সদস্যরা বইগুলোতে নজর রাখবেন। পাঠ্যবইয়ে জঙ্গিবাদসহ বিতর্কিত আর কোনো পাঠ থাকলে তা পরিবর্তনে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়াই কমিটি গঠনের মূল লক্ষ্য। ১৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করার জন্য এর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মাদরাসা বোর্ডকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আরো অন্তত ১৫ জন প্রতিনিধি কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হবেন। সব মিলিয়ে ৩০ সদস্যের কমিটি হতে পারে। আগামী শিক্ষাবর্ষের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়ার আগেই কমিটি গঠন হতে পারে বলে সূত্র জানায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মাদরাসার বিভিন্ন শ্রেণির ৩৫টি পাঠ্যবই ও এগুলোর সহায়ক হিসেবে লেখা পাঁচটি প্রকাশনীর গাইডবইয়ে জঙ্গিবাদকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। সেগুলোতে ধর্মকে অপব্যাখ্যা করার মতো লেখা রয়েছে। সাধারণ শিক্ষার কোনো কোনো বইয়েও জিহাদ সম্পর্কে এমনভাবে লেখা রয়েছে, যা সঠিক নয় বলে মনে করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে এ বিষয়ে যাচাই করে এনসিটিবি গত বছরের ডিসেম্বরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদনও জমা দেয়। প্রতিবেদনে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা থাকার কথা উল্লেখ করে এনসিটিবি। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় নির্দেশ দিলে এর বাস্তবায়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কোনটি জিহাদ আর কোনটি জঙ্গিবাদ, তা পাঠ্যপুস্তকগুলোতে স্পষ্ট করা হয়নি। তাই বিষয়টি স্পষ্ট করে ২০১৮ সালের শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করা হচ্ছে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত যেসব পাঠ্যপুস্তকে জঙ্গিবাদসংশ্লিষ্ট বিষয় ছিল, সেসব বই এনসিটিবি কমিটি গঠন করে যাচাই করে। যাচাইয়ে কয়েকটিতে উসকানিমূলক ও অপব্যাখ্যা করার মতো তথ্য পাওয়া যায়।

অন্যদিকে পাঠ্যবইয়ের কথিত সহযোগী বা গাইডবইয়ের নামে চিহ্নিত পাঁচটি প্রকাশনীর বইয়ে উগ্র বাক্য আছে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করে আসছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে জমা দেওয়া এনসিটিবির প্রতিবেদনেও বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় মনে করে, শিক্ষা আইনের খসড়ায় মাদরাসার পাঠ্যবইয়ের নামে সহযোগী নোট ও গাইডবইকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। আইনটি শিগগিরই প্রণয়ন হবে। ফলে বাজারে গাইডবই থাকবে না।

স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবজানায় এক শিক্ষা সম্মেলনে অংশ নিতে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ দেশটিতে অবস্থান করায় এসব বিষয়ে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। জানতে চাইলে শিক্ষা সচিব (মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ) সোহরাব হোসাইন এ প্রসঙ্গে প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাদরাসা ও কারিগরি বিভাগের মতামত পাওয়ার পর শিক্ষা আইনের খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন আনুষঙ্গিক কিছু কাজ করে শিগগিরই খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে মন্ত্রিসভা থেকে। মন্ত্রণালয় কোচিং, প্রাইভেট টিউশন ও নোট-গাইড বা অনুশীলন বই নিষিদ্ধ করার পক্ষে।’

মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম ছায়েফউল্যাহ এ বিষয়ে বলেন, ‘জঙ্গিবাদবিষয়ক জাতীয় কমিটির পরামর্শের ভিত্তিতে আমরা মাদরাসার কোরআন-হাদিস, আরবি ও ফিকহবিষয়ক বিভিন্ন পাঠ্যবই যৌক্তিক মূল্যায়ন করেছি। বইয়ের যেসব স্থানে বিতর্কিত পাঠ, বিশেষ করে জঙ্গিবাদে উৎসাহিত করার মতো বিষয় ছিল, তা বাদ দেওয়া হয়েছে। এক কথায় মাদরাসার পাঠ্যবই থেকে জিহাদের আড়ালে জঙ্গিবাদের পাঠের দাফন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভবিষ্যতেও এসব বই দেখভালের জন্য জাতীয় কমিটি গঠিত হচ্ছে।’

এনসিটিবির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এনসিটিবি ও মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড প্রণীত ও প্রকাশিত মাদরাসার পাঠ্যবইয়ে থাকা জিহাদসংশ্লিষ্ট পাঠের ভিত্তিতে রচিত বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের গাইডগুলোতে এমন কিছু ‘উদ্দীপক’ বা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যা থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা জঙ্গিবাদে উৎসাহিত হতে পারে। এমনকি মাদরাসা বোর্ডের পাঠ্যপুস্তকের ভিত্তিতে গাইড লেখার কাজে জড়িত লেখকদের মধ্যে কেউ কেউ থাকতে পারেন, যারা নিজেরাই জঙ্গিবাদী মানসিকতা ধারণ করছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, আল ফাতাহ, ইসলামিয়া, ইসলামিয়া কুতুবখানা ও আল ইসলাম প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত গাইড ও বইয়ে জিহাদ বিষয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখান থেকে জঙ্গিবাদ উসকে যেতে পারে।

তথ্যমতে, মাদরাসার পাঠ্যবইয়ে জঙ্গিবাদ বিষয়ে পাঠ্য আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে গত বছরের ২৪ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে মাদরাসার কোরআন, হাদিস, সংবিধান ও জাতীয় চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয় ও কোনো রাজনৈতিক দল সম্পর্কে লেখা প্রবন্ধ বা রচনা বাদ দেওয়ার নির্দেশনা ছিল। জঙ্গিবাদের ‘পাঠ’ বা কোনো ‘গন্ধ’ আছে কি না, তা চিহ্নিত করে বাদ দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একই বছরের মে মাসে নির্দেশ দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মাদরাসা বোর্ড কর্তৃপক্ষ প্রথম থেকে দশম শ্রেণির ৩৫টি বই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেয়। এ লক্ষ্যে আটটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হয়। প্রতিটি বিশেষজ্ঞ কমিটিতে পাঁচজন করে মোট ৪০ জন সদস্য কাজ করেন।

জানা যায়, কমিটিগুলো ৩৫টি পাঠ্যবইয়ের প্রতিটি পাঠের বিষয়বস্তু, স্তর শ্রেণির ক্রমধারা, তথ্য, তত্ত্ব ও ধারণা, অনুশীলনী পর্যালোচনা করে। তাদের দেওয়া প্রতিবেদনের আলোকে বিভিন্ন বইয়ে পরিবর্তন আনা হয়। এসব বই আগামী বছর শিক্ষার্থীদের হাতে যাচ্ছে। বইগুলোতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন নেই বলে জানান মাদরাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মাদ্রাসার বই,জিহাদি,জাতীয় শিক্ষানীতি,মুদ্রিত পাঠ্যবই,মাদরাসার পাঠ্যবই
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist