ডা. তোফাজ্জেল হক চয়ন
রক্তিম সূর্যে রাঙা হবে স্বাধীনতার নতুন সূর্য
বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন ও লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতা। একটি দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ত্ব পেতে হলে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। আর সেই সার্বভৌমত্ত্বের পেছনের গল্প অনেকরই অজানা থেকে যায়। সেই মহান স্বাধীনতার পেছনের স্মৃতিবহ দিনগুলো বঙ্গবন্ধু ও তারই হাতে গড়া সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতৃত্বে এগিয়েছে। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে শিক্ষাকে সার্বজনীন করার লক্ষ্যে রাজপথে নেমেছিল ছাত্রলীগের কর্মীসহ অন্যান্যরা। শরীফ কমিশনের রিপোর্টকে বাতিল করতে দুঃসাহিক অভিযাত্রায় নেমেছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের দামাল ছেলেরা। পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেয়া সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা। স্বাধীনতাকে অনিবার্য করে তুলতেই বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শীমূলক ৬ দফা ছিল একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের আগাম বার্তা মাত্র।
৬ দফার পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্যদের অত্যাচার নির্যাতন আর মিথ্যা মামলায় জর্জরিত করে তুলে। জাতীয় ও ছাত্র রাজনীতির এমন জটিল সমীকরণ সামাল দিতে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তৈরি করা ১১ দফার মধ্যে ছিল ৬ দফার অন্তর্নিহিত ফলাফল। তাদের কথা ছিল, হাজার দফা রচিত হোক কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু ৬ দফার দাবিই তাতে থাকবে মুখ্য। এ সবই ছিল দলীয় প্রাধান্য না দিয়ে সকল মানুষকে একই মঞ্চে আনার মুখ্য উদ্দেশ্য। আর সেটার জ্বলন্ত প্রমাণ হলো ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান। এই অবিস্মরনীয় গণজোয়ারের কারিগর ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। বন্দিশালা থেকে বের হয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (ছাত্রলীগের ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাস-সাইফুর রহমান সোহাগ, পৃষ্ঠা-১৯৩)।
আগারতলা ষড়যন্ত্র থেকে শুরু করে গণ অভ্যুত্থান পর্যন্তবাঙালির প্রত্যেক ঘরে ঘরে ছিল সঠিকভাবে বেঁচে থাকার ভাবনা। একটি স্বাধীন দেশের ভাবনা, এক মহান নেতার আদর্শকে সত্যি করে তোলার ভাবনা। পিতা কারাগারে রাজপথে যোগ্য সন্তান শেখ হাসিনা। রাজপথের প্রত্যক্ষ আন্দোলনের পাশাপাশি পিতার দিকনির্দেশনায় তিনি তৈরি কৌশল নির্ধারণ করতেন। আন্দোলন সংগ্রামের সরঞ্জাম ক্রয়ের অর্থ বহন করতেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা। যিনি তার অসম্ভব মেধা আর মননে শূণ্য মুজিবের জায়গাকে পূর্ণতা দান করতেন। বুঝতেই দেননি বঙ্গবন্ধুর শূণ্যতা। বাজারের খরচ বাঁচিয়ে, নিজের গহনা বিক্রির টাকা তুলে দিতেন ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে। গ্রেফতারি পরয়োনা মাথায়, পেটে ক্ষুধা, ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে ৩২ নম্বর এর বাসায়, মায়ের ¯েœহে এগিয়ে এসেছেন মুজিব সহধর্মীনী। এমন অপার্থিব মমতা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রেখেছিল সর্বদা। (ছাত্রলীগের ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাস- পৃষ্ঠা-১৯৮)।
২০ জানুয়ারি আসাদকে হত্যার মধ্য দিয়ে তারা যেন মৌচাকে ঢিল ছুড়ে তাদের পতনকে সাদরে আমন্ত্রণ জানালো। সেই জনতার দ্রোহের আগুণে ২৪ জানুয়ারি স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিদায়ের পাগলা ঘণ্টা বেজে ওঠে। দৃশ্যমান বিজয়ের নেশায় পূর্ব বাংলার জনগণ তখন উন্মাতল।
১৯৭০ সাল। যখন শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পারে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা চরমে, তখন নতুন প্রজন্মের মগজ ধোলাই করার প্রয়াসে লিপ্ত হয়। মাধ্যমিক পাঠ্যপুস্তকে ‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি’নামে একটি পাঠ সংযোজন করলে শিক্ষার্থীরা ছাত্র সংগঠনের সাহায্যপ্রার্থী হয়। ছাত্রলীগ স্বাধীনতার জন্য বৃহৎ আন্দোলনে মেতে থাকায় প্রথমে মৌন সমর্থন দিলেও পরবর্তীতে এই আন্দোলনকে মহীরুহে পরিণত করে। ৪ জুন নির্বাচনে শাসকগোষ্ঠী ভেবেছিল বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলায় জয়ী হলেও সম্পূর্ণ পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্টতা পাবে না। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি বানানোর টোপে ৬ ও ১১ দফা থেকে বিচ্যুত করা যাবে। কিন্তু তাদের হিসাবের খাতায় হিসাব ওলটপালট হয়ে গেল।
৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে পল্টনের জনার্কীর্ণ সমাবেশে ছাত্র জনতা সংগ্রাম আদায়ের মন্ত্রে অটল ছিল। সমাবেশে জনতার কঠোর শপথের ফুলকি থেকেই একাত্তর নামক আগ্নেয়গিরি জন্ম নেয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায়, সবুজ জমিন বাংলার চিরসবুজের প্রতীক, লাল সূর্য রক্তে রাঙা হয়ে উঠবে স্বাধীনতার নতুন সূর্য, আর জন্ম নেবে একটি নতুন দেশ, সোনালী আঁশের রঙে হবে তার পরিচয়। এমনই একটি পতাকা সেদিন ছাত্র জনতা বঙ্গবন্ধুকে উপহার দিয়েছিল। ৭ জুন বঙ্গবন্ধু লাল সবুজের পতাকাটি তাদের হাতে তুলে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অত্যাসন্ন ও অনিবার্য সম্মুখ সমরের প্রস্তুতি গ্রহণের চুড়ান্ত নির্দেশনা দিয়েছিলেন। (ছাত্রলীগের ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাস- পৃষ্ঠা-২০৭)
এভাবেই সূচিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার মর্মবাণী ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চে। দিনে দিনে বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনে এসেছে গতিশীলতা। শাসন, ভাষণ ও নির্দেশনার জন্য যে প্রাপ্তিযোগ, সেজন্য এই দিনটি এক অমর অর্জনও বটে। এদিনের আগেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশ পরিচালিত হয়ে আসছিল। যে কারণে এই দিনে পাকির জাঁদরেল সামরিক অফিসার টিক্কা খান সুদূর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উড়ে এসেও এখানে শপথ নিতে পারেননি। কেননা সব বিচারপতি আন্দোলনে থাকায় শপথবাক্য পাঠ করানোর জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি সেদিন। বরং এই দিনে জাতির পিতা স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য ৩৫টি বিধি জারি করেছিলেন (বিধি দ্রষ্টব্য, লেখন, প্রণীত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, পৃষ্ঠা: ৭৭২-৭৮১, দৈনিক পাকিস্তান, ১৫ ও ১৬ মার্চ, ১৯৭১ সাল)।
এরই মধ্যে পাকিস্তান সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। সেদিন পিতা মুজিব বলেছিলেন, বাংলার মানুষের সার্বিক মুক্তির আগে তার জন্মদিন বলে কিছু নেই। জুলফিকার আলী ভুট্টো তার দলবল নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি ২৫ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে জানালেন, মুজিবের ছয় দফার স্বীকৃতি দিতে তিনি খুব কাছাকাছি এসে গেছেন (দ্য পাকিস্তান টাইমস, লাহোর, মার্চ ২৬, ১৯৭১)। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে বঙ্গবন্ধু ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঢাকার পল্টনে ছাত্রলীগের এক জনসভায়জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল।
জনসভার পরবর্তীতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ধানমন্ডির বাসভবনে এলে বঙ্গবন্ধু তাদের অভিবাদন জানিয়েছিলেন। এখানে তিনি সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ এভাবেই বাঙালির হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু গেথেছিলেন স্বাধীন হওয়ার বীজ মন্ত্র। আজ স্বাধীন হয়েছি, বাংলাদেশ পেয়েছি কিন্তু আমাদের বঙ্গবন্ধু নেই। নেই আমাদের সেই চির বীর জনতার বন্ধু তারুণ্যের শেখ মুজিবুর রহমান। পিতার পরম বাণীকে ব্রত হিসেবে পালন করে যাচ্ছেন কন্যা মুজিব। দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালের যবনিকা টানতে হাল ধরে চলেছেন সর্বদা।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আর মাত্র ছয় বছর অতিক্রান্ত হলেই বাঙালি জাতি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে। অথচ স্বাধীনতার খুটিনাটি অনেক কিছুই রয়েছে আমাদের এ প্রজন্মের আয়ত্বের বাহিরে। আমরা ক্রমশ: হারাচ্ছি একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। ইতোমধ্যে অনেক বীর সেনানীদের আমরা হারিয়েছি।বর্তমানে যুদ্ধ পরবর্তী নাগরিকের সংখ্যাই বেশি। যাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের অভিজ্ঞতায় নেই। তাহলে কিভাবে দেশকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে সেসব চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার অভাব ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে । ধীরে ধীরে এ জাতিকে আন্দোলন-সংগ্রামের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা থেকে দূরে সরে যেতে হবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামের অকুতোভয় বীর সন্তান ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যাঁরা জীবিত রয়েছেন, তাঁদের সান্নিধ্যে বেশি বেশি করে আসতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা করতে হবে। নতুবা শেকড় হারিয়ে আমরা পতনের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হব অচিরেই। তারুণ্যের বন্ধু, জাতির পিতার মর্মস্পর্শী বাণীকে সাথে নিয়ে, সোনার বাংলাকে জঙ্গীমুক্ত করে তুলতে শেখ হাসিনার হাতকে আরও বেশি শক্তিশালী করে তুলতে হবে। এটাই হোক স্বাধীনতার অঙ্গিকার। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।লেখক : ডা. তোফাজ্জেল হক চয়ন, সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ