তহিদুল ইসলাম, জাবি

  ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯

জাবিতে ৪৯ বছরে ৫ সমাবর্তন, প্রশাসনের ‘আন্তরিকতা’ নিয়ে প্রশ্ন

‘নিয়ম’ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতি বছরই সমাবর্তন অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। অথচ প্রতিষ্ঠার ৪৯ বছরে মাত্র পাঁচবার সমাবর্তনের দেখা পেয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। একবার স্নাতক শেষ করে আরেক স্নাতকের সময় চলে গেলেও মেলে না সমাবর্তনের দেখা। সমাবর্তন আয়োজনে কর্তৃপক্ষের এমন কচ্ছপ গতি নিয়ে সমালোচনামুখর রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। সমাবর্তন নিয়মিত আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ‘আন্তরিকতার অভাব’ রয়েছে বলে অভিযোগ ছাত্র সংগঠনগুলোরও। অন্যদিকে প্রশাসনের দাবি, সদিচ্ছা থাকলেও ক্যাম্পাসের পরিস্থিতির কারণেই যথাসময়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠান করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ পঞ্চম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি। এরপর চার বছর পেরিয়ে গেলেও নতুন সমাবর্তনের কোনও উদ্যোগ এখনো নেয়া হয়নি। অথচ এই চার বছরে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন ৪০তম থেকে ৪৩ তম ব্যাচের প্রায় আট হাজার শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়টির বেশ কিছু বিভাগের ৪৪ ব্যাচের শিক্ষার্থীদেরও স্নাতক সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া পঞ্চম সমাবর্তনে ৩৯ ব্যাচের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তরের সনদ পাননি। ফলে ৩৯তম থেকে ৪৪ তম ব্যাচের অন্তত দশ হাজার শিক্ষার্থী ষষ্ঠ সমাবর্তনের গাউন পরার অপেক্ষায় আছেন।

এদিকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও বিষয়টি শিক্ষার্থীদের আলোচনায় আসে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৪৯ বছরে মাত্র পাঁচ বার সমাবর্তন অনুষ্ঠান হওয়ায় শিক্ষার্থীরা সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। অনেকেই অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা টানে। গত সোমবার অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গত কিছুদিন ধরে বিষয়টি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও আলোচনায় রয়েছে। সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের সমালোচনা-ক্ষোভে সরগরম রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ।

ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী আবির মাহমুদ খবির একটি ফেসবুক গ্রুপে লিখেছেন, জাবিতে ভর্তির পর থেকে শুধু ঢাবি-রাবির সমাবর্তন দেখে যাচ্ছি। আবার জাবিয়ান অনেকেই দেখলাম ঢাবি-রাবির সমাবর্তনের তোলা ছবি নিজের টাইমলাইনে আপলোড করে। সত্যিই খুব খারাপ লাগে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন দেখতে। কবে যে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের ছবি দেখবো। রানিং স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় আদৌ দেখতে পারবো কি না জানি না। তবে দেখার ইচ্ছাটা প্রবল।

প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ১৯৭০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ২৬ বছর পর অর্থাৎ ১৯৯৭ সালে প্রথম সমাবর্তন গাউন পরার সুযোগ মেলে শিক্ষার্থীদের। ওই বছরের ৫ জানুয়ারি প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম চৌধুরী। সেবার চার হাজার ৪৮৪ জন গ্র্যাজুয়েট, এম.ফিল ও পিএইচ.ডি ডিগ্রী অর্জনকারী শিক্ষার্থী সনদ পান। পরবর্তীতে ২০০১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল বায়েসের সময়ে অনুষ্ঠিত ওই সমাবর্তনে সনদ পান পাঁচ হাজার ১২ জন গ্র্যাজুয়েট, এম.ফিল ও পিএইচ.ডি ডিগ্রী অর্জনকারী শিক্ষার্থী । এর পাঁচ বছর পরে ২০০৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তৃতীয় সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান। সেবার সমাবর্তনে চার হাজার ৩৮৩ জন গ্র্যাজুয়েট, এম.ফিল ও পিএইচ.ডি ডিগ্রী অর্জনকারী শিক্ষার্থী সনদ পান। এরপর ২০১০ সালের ৩০ জানুয়ারি চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের সময়ে অনুষ্ঠিত ওই সমাবর্তনে তিন হাজার ৯৪৯ জন গ্র্যাজুয়েট, এম.ফিল ও পিএইচ.ডি ডিগ্রী অর্জনকারী শিক্ষার্থী সনদ পান। সর্বশেষ উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সময়ে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সমাবর্তনে সনদ পান নয় হাজার গ্র্যাজুয়েট, এম.ফিল ও পিএইচ.ডি ডিগ্রী অর্জনকারী শিক্ষার্থী।

এদিকে সমাবর্তন অনুষ্ঠান নিয়মিত না হওয়ার পেছনে কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা। তারা বলছেন, প্রশাসন চাইলেই সমাবর্তন অনুষ্ঠান নিয়মিত আয়োজন করতে পারে।

শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা বলেন, সমাবর্তন পাওয়া সবার একটা স্বপ্ন। কারণ সমাবর্তনের আগে মূল সনদপত্র দেয়া হয় না। তাছাড়া সবাই চায় আচার্যের কাছ থেকে সনদ নিতে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত সমাবর্তন হচ্ছে না। এটা মূলত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আন্তরিকতার অভাব। কারণ তারা চাইলেই সমাবর্তন আয়োজন করতে পারে।

শাখা ছাত্রদলের সভাপতি সোহেল রানা বলেন, সমাবর্তন পাওয়া শিক্ষার্থীদের অধিকার। কিন্তু তারা এটা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিতই হচ্ছে। অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় না। প্রশাসনের সদিচ্ছা ও সক্ষমতার অভাবের কারণে এটা হয় না।

জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম পাপ্পু বলেন, “সমাবর্তন নিয়মিতভাবে হচ্ছে না মানে সেই বিশ্ববিদ্যালয় সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। আসলে সমাবর্তন আয়োজনে সদিচ্ছাই নেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা চিন্তা না করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকাতে সমাবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ভাবার সময় হয়ে উঠছে না তাদের। প্রশাসনকে শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে সমাবর্তন সহ শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট সকল একাডেমিক বিষয় নিয়মিতভাবে নিষ্পত্তি করার আহবান জানাই।”

ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম অনিক বলেন, আমি মনে করি, সমাবর্তন নিয়মিত না হওয়া প্রশাসনিক ব্যর্থতা। আর সদিচ্ছারও অভাব রয়েছে।

তবে পরিকল্পনা থাকলেও ‘অস্থিতিশীল’ পরিস্থিতির কারণে সমাবর্তন অনুষ্ঠান যথাসময়ে হচ্ছে না বলে দাবি হল প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক বশির আহমেদের। তিনি বলেন, “এটাতে (সমাবর্তন আয়োজনে) বিশাল একটা আর্থিক বিষয় থাকে। তবে আমাদের প্লান ছিল আয়োজন করার। কিন্তু ২০১৭ সাল বা তার পরে সিনেট নির্বাচন সহ কিছু ঝামেলা ছিল। এ কারণে হয়নি।”

ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ বলেন, “কর্তৃপক্ষ এটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে।”

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মো. নূরুল আলম বলেন, “সমাবর্তন প্রতি বছর হতে হবে এরকম লিখিত কোনও কিছু আমি কোথাও দেখিনি। তবে সমাবর্তন প্রতি বছর হওয়া উচিৎ। এটা একটা উৎসব। আগে কেন নিয়মিত হয়নি সে বিষয়টি আমি বলতে পারবো না। তবে আমি দায়িত্বে আসার পর সেরকম পরিস্থিতি ছিল না। আমরা আজও এটা নিয়ে কথা বলেছি। এটা (সমাবর্তন) আমাদের চিন্তায় আছে।”

পিডিএসও/রি.মা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জাবি,সমাবর্তন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close