নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

বাইরে বন্ধের বিজ্ঞপ্তি : ভেতরে ছাত্রছাত্রী

কোচিং বাণিজ্য চলছেই

এসএসসি পরীক্ষা শুরুর আগে থেকে দেশের সব কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হলেও বহাল তবিয়তে চলছে কোচিং বাণিজ্য। রাজধানীর নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ফ্ল্যাট ভাড়া করে কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে কোচিং সেন্টার বন্ধের বিজ্ঞপ্তি লাগিয়ে দিয়েছেন তারা। কেউ আবার কালো ব্যানারে বন্ধের নোটিশ ঝুলিয়ে রেখেছেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী এসএসসি পরীক্ষা চলাকালীন কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখা হয়েছে।’ তবে বাস্তবতা ভিন্ন। এই বন্ধ রাখার নোটিশটা আসলে আইওয়াশ, বাস্তবে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হয়নি। তা চলছে জোরেশোরে। এ যেন সরকারি আদেশের প্রতি বুড়ো আঙুল দেখানো।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের রসায়ন বিষয়ের শিক্ষক ফরহাদ বিন কামাল। তিনি ১১/৩ নম্বর সিদ্ধেশ্বরী এলাকার একটি ফ্ল্যাট বাড়ির দ্বিতীয়তলা ভাড়া নিয়ে কোচিং সেন্টার চালান। তার কোচিংয়ে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকজন শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণির বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী এখানে কোচিং করেন।

গত রোববার দুপুর দেড়টায় সরেজমিন ওই কোচিং সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, ভিকারুননিসার সপ্তম শ্রেণির প্রায় ১৫ শিক্ষার্থীকে কোচিং করানো হচ্ছে। স্কুল ছুটির পর ড্রেস পরেই এসব শিক্ষার্থী কোচিংয়ে আসেন। সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পেয়ে সব শিক্ষার্থীকে বের করে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের বলা হয়, ‘সাংবাদিক এসেছে, সমস্যা আছে। আজ আর পড়ানো হবে না।’

অলিখিত ওই কোচিং সেন্টারের মালিক ভিকারুননিসা স্কুলের শিক্ষক ফরহাদ বিন কামালের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তিনি কিছু না বলে ফ্ল্যাটের লাইট-ফ্যানের সুইচ অফ করে সরে পড়েন। পরে ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়াদের কাছে জানা যায়, প্রায় ১৪ বছর ধরে তিনি এ বাসায় কোচিং সেন্টার পরিচালনা করে আসছেন। তার সঙ্গে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তপন ও ডা. মঞ্জু নামে আরো দুই শিক্ষক রয়েছেন।

১১/৩ নম্বর সিদ্ধেশ্বরীর ওই ফ্ল্যাটের ঠিক পাশের ৪৩ খন্দকার গলিতে ভিকারুননিসার শামসুল হুদা ও গণি স্যারের কোচিং সেন্টার। ওই বাড়ির নিচতলায় কয়েকজন শিক্ষক মিলে ফ্ল্যাট ভাড়া করে কোচিং সেন্টার চালান। সেখানে ঢুকতেই চোখে পড়ে ভিকারুননিসাসহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্ম পরা আট-দশ শিক্ষার্থী বের হয়ে যাচ্ছেন।

এছাড়া সিদ্ধেশ্বরী এলাকার মনোয়ার হাসাপাতালের পাশে বই বিচিত্রা লাইব্রেরির ওপরে ভিকারুননিসার গণিতের শিক্ষক নাসরীন আক্তার, বই ঘরের গলিতে নটর ডেম কলেজের গণিতের শিক্ষক রেজাউল করিম, একই প্রতিষ্ঠানের বিপ্লব স্যার, আইসিটি বিষয়ের শিক্ষক ফরহাদ মঞ্জুর, সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরের পাশে সকাল-বিকাল বিভিন্ন ব্যাচে রসায়ন, পদার্থ, গণিতসহ বিভিন্ন বিষয়ে কোচিং করান ইঞ্জিনিয়ার নীল, খিলগাঁও স্কুল অ্যান্ড কলেজে মৃদুলসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা।

কোচিংয়ে কী পড়ানো হয়—শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাইলে তারা কিছুই বলতে রাজি হননি। তবে কোচিং সেন্টারের ভেতরে অবস্থান করা সুজন নামে এক ব্যক্তি জানান, এখন তো কোচিং বন্ধ, অফিসের কাজে আসা। শিক্ষার্থীরা কেন এখানে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ছাত্রীরা বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে স্যারের কাছে আসেন। তাদের তো বাধা দেয়া যায় না। কারা কোচিং সেন্টারটি পরিচালনা করেন জবাবে তিনি বলেন, ভিকারুননিসাসহ পাশের কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এটি দেখভাল করেন।

এদিকে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশের এলাকার কয়েকটি ফ্ল্যাট বাড়িতেও শিক্ষার্থীদের কোচিং করাতে দেখা যায়। মূলত মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক তাদের নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন এসব কোচিং সেন্টার। তবে সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পেয়ে সেখানেও আসা সব শিক্ষার্থীকে বিদায় করে দেন শিক্ষকরা। তারা নিজেরাও সটকে পড়েন।

সরকারি নির্দেশনার পরও কেন শিক্ষার্থীদের কোচিং সেন্টারে পাঠানো হচ্ছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে কয়েকজন অভিভাবক অভিযোগ করে বলেন, স্যাররা ক্লাসে মনোযোগ দিয়ে পড়ান না। এ কারণে কোচিং সেন্টারে সন্তানকে নিয়ে দৌড়াতে হয়। ক্লাস টিচাররাই তার কোচিংয়ে আসতে শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দিচ্ছেন। তার কাছে কোচিং না করলে নানাভাবে ভয়ভীতিও দেখানো হয়। এ কারণে বাধ্য হয়ে স্কুলের স্যারদের কাছে সন্তানকে পাঠাই।

তারা আরো বলেন, চলতি বছরের দুই মাস পার হওয়ার পথে অথচ সিলেবাসের তেমন কিছুই পড়ানো হয়নি। ক্লাসেও ভালোভাবে পড়ানো হচ্ছে না। তাই কোচিংয়ে পাঠানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এজন্য প্রতি মাসে চড়া বেতন দিতে হচ্ছে শিক্ষকদের।

সরকারি নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে এভাবে ফার্মগেটের হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মিরপুরের মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মিরপুর বাঙলা স্কুল, মিরপুর-২ এ অবস্থিত ন্যাশনাল বাংলা উচ্চবিদ্যালয়সহ ঢাকা মহানগরীর স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা চলমান এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার মধ্যে কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন।

কোচিং খোলা রাখার বিষয়ে খন্দকার গলির কোচিং সেন্টারের পরিচালক ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষক শামসুল হুদা বলেন, গত ২৭ ডিসেম্বর থেকে কোচিং সেন্টার বন্ধ। কিছু শিক্ষার্থী সমস্যা নিয়ে আমার কাছে আসে। আমি তাদের একটু দেখিয়ে দেই। সরকারি নির্দেশনা মেনে কোনো শিক্ষার্থীকে পড়ানো হচ্ছে না।

‘তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে এসে অনুরোধ জানালে তাদের একটু দেখিয়ে দেই মাত্র। আপনারা পারলে অভিভাবকদের আসতে নিষেধ করেন। তারা তাদের সন্তানদের না নিয়ে এলে কোনো শিক্ষক আর কোচিং করাবেন না।’

জানতে চাইলে ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান মু. জিয়াউল হক বলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষা চলাকালীন সব কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেউ কোচিং সেন্টার খোলা রেখেছেন—এমন তথ্য পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ প্রশাসনকে জানিয়ে থাকি। সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক যদি কোচিং করান, সেটা অন্যায় বলে গণ্য হবে। এমন তথ্য পেলে সঙ্গে সঙ্গে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেই।’

ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘পাশাপাশি দুটি পরীক্ষার সময় পিছিয়ে যাওয়ায় ২৭ ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে আগামী ২৯ ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবে। এ কারণে ২৯ ফেব্রুয়ারির আগে কেউ যদি কোচিং সেন্টার খোলা রাখেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

প্রসঙ্গত, গত ২ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষা। এ পরীক্ষা সামনে রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নিরাপত্তাজনিত কারণে ২৭ জানুয়ারি থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের সব কোচিং সেন্টার বন্ধের নির্দেশনা দেয়।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কোচিং বাণিজ্য,ছাত্রছাত্রী,বিজ্ঞপ্তি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close