নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৫ জানুয়ারি, ২০১৯

ডাকসু নির্বাচন ঘিরে ঢাবিতে প্রাণচাঞ্চল্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ ডাকসুর নির্বাচন হতে যাচ্ছে ২৮ বছর পর

দ্বিতীয় পার্লামেন্টখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ ডাকসুর নির্বাচন হতে যাচ্ছে ২৮ বছর পর। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আগামী মার্চের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেছেন, তাদের টার্গেট ৩১ মার্চ। এই টার্গেটকে সামনে রেখেই তারা কাজ করে যাচ্ছেন।

ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র সংগঠনের নেতা ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা মনে করছেন, এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকটের সমাধানসহ সাধারণ ছাত্রদের বিভিন্ন অধিকার আদায়ের পথ সুগম হবে। তেমনি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকাশের পরিবেশ তৈরি হবে। কমবে প্রশাসনের একচ্ছত্র আধিপত্য।

কী চায় ছাত্র সংগঠনগুলো : ডাকসু নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে ১০ জানুয়ারি মতবিনিময় সভা করে। গঠনতন্ত্র পরিমার্জন ও সংশোধনের জন্য গঠিত হয়েছে পাঁচ সদস্যের কমিটি। ডাকসু নির্বাচন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী, ছাত্র সংগঠনের নেতা সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

এই ইতিবাচক উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের প্রত্যাশা, এর মাধ্যমে তরুণ নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে। যারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ে সোচ্চার হবে।

ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগকে ছাত্রলীগসহ প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনও স্বাগত জানিয়েছেন। এ নির্বাচনের মাধ্যমে সাধারণ ছাত্রদের দাবি আদায়ের পাশাপাশি গণতন্ত্রের চর্চা হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন, সেই সঙ্গে প্রশাসনের একচ্ছত্র আধিপত্যও কমবে বলে মনে করেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন। বাম ছাত্র সংগঠনগুলোও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে বেশ আশাবাদী। অন্যদের মতো তারাও সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব হলে সহাবস্থান নিশ্চিত ও ক্যাম্পাস রাজনীতির সমান সুযোগ তৈরির দাবি জানিয়েছেন তারা।

ডাকসুর ভোটার কারা : ডাকসুর গঠনতন্ত্রের ৪ ধারার ১ ও ২ উপধারা অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ও অনাবাসিক সব নিয়মিত শিক্ষার্থীই ডাকসুর সদস্য। তবে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আর্থিক প্রাপ্য পরিশোধ করতে হবে। অনিয়মিত শিক্ষার্থীরাও ডাকসুর সদস্য হতে পারেন, তবে তাদের ডাকসু নির্ধারিত নিবন্ধন ফি দিতে হয়।

৪ ধারার ৩, ৪ ও ৫ উপধারা অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদেরও নিবন্ধন ফির বিনিময়ে ডাকসুর সদস্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এই প্রক্রিয়া দুই ধরনের। একটি হচ্ছে সাধারণ সদস্য ও আরেকটি আজীবন সদস্য। ডাকসুর কার্যনির্বাহী সংসদ চাইলে দেশের যেকোনো বিশিষ্ট নাগরিককে ডাকসুর আজীবন সদস্য ঘোষণা করতে পারে।

৪ ধারার ৬ উপধারায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব প্রিডিগ্রি, বিএফএ, এমফিল ও পিএইচডি শিক্ষার্থীরা ভোটার হতে পারবেন কিন্তু প্রার্থী হতে পারবেন না।

১৯৯১ সালের ১৭ জুন সিন্ডিকেটের সভায় একটি সংশোধনী আনা হয়। এতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, স্নাতকোত্তর বা প্রিলিমিনারি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টসের ডিগ্রি পাস কোর্স, বিএফএ, বিবিএ, ডিপ্লোমা, পরিসংখ্যান ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র সার্টিফিকেট কোর্সের শিক্ষার্থীরা ভোটার হতে পারবেন। কিন্তু তাদের মধ্যে যারা কোনো কোর্সে শিক্ষাবিরতি দিয়ে পুনর্ভর্তি হয়েছেন বা ফি দেওয়ার সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে, তারা সে সুযোগ পাবেন না।

কারা ভোটার হবেন, এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, সবকিছু কমিটি দেখবে। কিছু নিয়ম যে আছে, সেগুলো যথার্থ কি না এবং কোন ক্ষেত্রে কী করা উচিত, সবই দেখবে কমিটি। সবকিছু দেখে তারা একটি সুপারিশ করবে।

গঠনতন্ত্র সংশোধনে কমিটি

ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের প্রাধ্যক্ষ ও আইন বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। কমিটির অন্যরা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হলের প্রাধ্যক্ষ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল, কবি জসীমউদদীন হলের প্রাধ্যক্ষ ও আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. রহমত উল্লাহ, রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জিনাত হুদা এবং শামসুন নাহার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সুপ্রিয়া সাহা।

ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে কমিটির বৈঠক

ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন কমিটির প্রধান আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত হলে ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং তফসিল ঘোষণা করার কথা। বৃহস্পতিবারের ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ক্যাম্পসে সক্রিয় সব ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিরা।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, আমরা গঠনতন্ত্রে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদকের পদ অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছি। যুদ্ধাপরাধী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো যাতে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, সে জন্য তাদের গঠনতান্ত্রিকভাবে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছি। আমরা বলেছি, একাডেমিক ক্যালেন্ডারে পরীক্ষার তারিখ যেন সুনির্দিষ্ট থাকে, সেভাবে ডাকসু নির্বাচনের তারিখও প্রতিবছর সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। ডাকসুর মেয়াদ কোনোভাবেই ৩৬৫ দিন বা এক বছরের বেশি হতে পারবে না। আমরা গঠনতন্ত্রের বাংলা সংস্করণ চেয়েছি।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার বলেন, আমরা সেদিনের বৈঠকে প্রক্টরিয়াল নিরাপত্তা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম। আমাদের নেতাকর্মীরা হলগুলোয় অবস্থান করতে পারছেন না। তারা ক্যাম্পাসেও স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা বা ক্লাস করতে পারেন না। তাই ডাকসু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো ক্যাম্পাসে সহাবস্থান। এই সহাবস্থান নিশ্চিত করা না গেলে ডাকসু নির্বাচন অর্থবহ হবে না।

আর ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মো. ফয়েজ উল্লাহ বলেন, সহাবস্থানের বিষয়টি এককভাবে কোনো ছাত্র সংগঠনের নয়, এটা সবার জন্য। আমার ছাত্র সংগঠনের কিছু সদস্যকেও হলে তুলতে পারিনি। হলগুলো সরকারি ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে। সে জন্য আমরা গঠনতন্ত্রে একটা সংশোধনীর প্রস্তাব দিয়েছি। আর তা হলো, ভোটকেন্দ্রগুলো হলে হলে না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনে করা। হলে যে একটা চাপ থাকে, একাডেমিক ভবনে করলে সেই চাপ থাকবে না। সবাই নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন। আর শতকরা ৬৫ ভাগ ছাত্র হলের বাইরে থাকেন। তবে তিনি বলেন, সবকিছুর ওপরে চাই নির্বাচনটা মার্চের মধ্যে হোক। অনেক দিন পর একটা সুযোগ এসেছে ডাকসু নির্বাচনের।

সহাবস্থানের প্রশ্নে সাদ্দাম হোসেন বলছেন, এটা নিয়ে কেউ রাজনৈতিক বক্তব্য দিলে আলাদা কথা কিন্তু ডাকসুর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রার্থী ও ভোটার হবেন। এ ব্যাপারো কোনো বাধা আসবে বলে আমি মনে করি না। ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধনী প্রস্তাব দেওয়ার সময় গতকাল শেষ হয়েছে। এরপর ১০ কার্যদিবসের মধ্যে ডাকসুর নতুন গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত হবে, তারপর ভোটার তালিকা। তবে ভোটার তালিকার প্রাথমিক কাজ আগেই হয়েছে। গত অক্টোবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি তালিকা তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হলের সঙ্গে সংযুক্ত ও আবাসিক মিলিয়ে মোট ৩৮ হাজার ৪৯৩ জন শিক্ষার্থীর তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৫০৯ জন নারী শিক্ষার্থী ও ২৩ হাজার ৯৮৪ জন পুরুষ শিক্ষার্থী। এটা ধরেই ভোটার তালিকা তৈরি সহজেই কম সময়ে করা যাবে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতারা মনে করেন, মার্চের মাঝামাঝিই নির্বাচন সম্ভব। তাই ফেব্রুয়ারিতেই ডাকসুর তফসিল চাইছে অনেক ছাত্র সংগঠন।

২৮ বছর পর নির্বাচন

ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ৬ জুন। তখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দেশের রাষ্ট্রপতি। ১৯৯৮ সালে ডাকসুর কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। মাঝেমধ্যে ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। সিনেটে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু তাতে ফল হয়নি। ২০১২ সালে বিক্ষোভ, ধর্মঘট, কালো পতাকা মিছিল এবং ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানান সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ’ তৈরি করে লাগাতার কর্মসূচিও চলে বেশ কিছুদিন।

এরপর বিভিন্ন সময় ডাকসুর নির্বাচনের দাবি উঠলেও সেটা খুব জোরালো ছিল না। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে এই দাবি আবার সামনে আসে। ওই বছরের ২৯ জুলাই ছাত্র প্রতিনিধি ছাড়া উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এরপর ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা।

ডাকসু নির্বাচনের নির্দেশনা চেয়ে গত পাঁচ বছরে উচ্চ আদালতে পৃথক দুটি রিট আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু জবাব দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ছয় বছর আগের একটি রিট আবেদনের নিষ্পত্তি করে গত বছর ১৭ জানুয়ারি এক রায়ে হাইকোর্ট ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। কিন্তু সাত মাসেও নির্বাচনের কোনো আয়োজন দৃশ্যমান না হওয়ায় গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে উকিল নোটিস পাঠান রিটকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ অক্টোবর চেম্বার বিচারপতি হাইকোর্টের রায় স্থগিত করে বিষয়টি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান। সেই শুনানি শেষে গত রোববার হাইকোর্ট জানান, মার্চে ডাকসু নির্বাচনের কোনো বাধা নেই।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
প্রাণচাঞ্চল্য,ডাকসু নির্বাচন,ঢাবি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close