নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৮

অরিত্রীর আত্মহত্যা

সবই আছে তবু ঘরজুড়ে শূন্যতা

মেয়েটা ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ‘কুটুস’ ওর গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত, স্কুলের পোশাক না বদলায়ে আগে ওকে কোলে নিত, বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরত। ওকে খাবার খাইয়ে তারপর নিজের ঘরে যেত। আর যদি কোনো কারণে কোলে না নিত তাহলে মেয়ের পায়ে পায়ে ঘুরত।

সেই ‘কুটুস’ কাল থেকে পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে, অরিত্রীর খাটে গিয়ে শুয়ে থাকছে, আমরা কেউ খাবার দিলেও খাচ্ছে না। অরিত্রী নেই, তাই কিছু খাচ্ছে না ওর আদরের বিড়াল ‘কুটুস’। গতকাল বুধবার ঢাকার শান্তিনগরের বাড়িতে অরিত্রীর প্রিয় বিড়াল কুটুসকে কোলে নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বাবা দিলীপ অধিকারী। এ সময় তার দুই চোখ গড়িয়ে ঝরছিল বাঁধভাঙা অশ্রু।

গত সোমবার থেকে অরিত্রীর বাসাভর্তি আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী। যে আসছে তাকে জড়িয়ে ধরেই কাঁদছেন দিলীপ অধিকারী। একনাগাড়ে বলে যাচ্ছেন মেয়ের কথা, মেয়ের আদরের বিড়ালের কথা। কখনো কালো রঙের ব্যাগ থেকে খুলে সবাইকে দেখাচ্ছেন অরিত্রীর গিটার। গিটার খুঁজতে গিয়ে দেখতে পান সেটা মেঝেতে রাখা। আমার মায়ের গিটার নিচে রেখেছে কে প্রশ্ন করতে করতে নিজেই টেবিলের ওপরে রাখেন। বলেন, মেয়ে গিটার ধরতে দিত না, বলত, টিউন নষ্ট হয়ে যাবে। সেই বিড়াল, সেই গিটার ছেড়ে মেয়েটা চলে গেছে। তার বাসায় তিন দিন ধরে এত এত মানুষ আসছে, কিন্তু পুরো ঘরজুড়ে শূন্যতা, বলেন দিলীপ চৌধুরী।

অরিত্রীর মা বিউটি অধিকারী গত ডিসেম্বরে স্ট্রোক করেছেন। সেই থেকে তিনি অসুস্থ। আর মেয়ের চলে যাওয়াতে তিনি প্রায় বাকরুদ্ধ। নীরবে কেঁদে যাচ্ছে অরিত্রীর ছোট বোন অরুনীমা। খাওয়া বন্ধ তার, কথাও বলছে না কারো সঙ্গে। অরিত্রীর বাড়ি যাওয়ার পর বইয়ের আলমারি, পোশাকের আলমারি, পড়ার টেবিল, পুতুল দেখিয়ে দিলীপ বলেন, কত কিছু করত মেয়েটা, সব শেষ হয়ে গেল আমার। স্পিকার দেখিয়ে বলেন, এটা দিয়ে গান শুনত। সবকিছু রেখে গেল মেয়েটা, কেবল সে চলে গেল, আমি কেমন করে বাঁচব? মেয়ের কাপড়ে হাত বুলিয়ে বাবা বলেন, এসব ড্রেস আর কখন পরবে আমার মেয়েটা।

দিলীপ জানান, তার বড় মেয়ে ছোট থেকেই মেধাবী। ভিকারুননিসা স্কুলে প্রথম শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় তৃতীয় হয় সে। ২০১৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ে সে এপ্লাস পেয়েছে, গোল্ডেন এপ্লাস পেয়েছে অষ্টম শ্রেণিতে। সেই মেয়ে মুঠোফোনে নকল করছিল— এ কথা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য, সে প্রশ্নও তোলেন দিলীপ।

একনাগাড়ে বলতে থাকেন দিলীপ, হয়তো একটা ফোন তার কাছে ছিল, কিন্তু তারা তো একটা সুযোগ আমাকে, আমার মেয়েটাকে দিতে পারত। ওর সামনে দাঁড়িয়ে মাফ চেয়েছি, বলেছি একটা সুযোগ দেন আমাকে। পরীক্ষাটা দিতে দেন, আমি মেয়েকে আর পড়াব না, কিন্তু তারা শোনেনি। শাস্তি হিসেবে স্কুল থেকে টিসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং বাবা-মায়ের অপমান সে সহ্য করতে পারেনি।

স্কুল থেকে বের করে দিলে বাবার মানসম্মান থাকবে না, এটা ভেবেই আমার মেয়ে চলে গেল। ওই স্কুলের কতজন আছে যারা আমাকে চেনে, ওকে চেনে। স্কুলের শিক্ষক, আত্মীয়, বন্ধুদের সামনে আমার অপমান সে সহ্য করতে পারেনি। ওর সামনেই আমাকে, ওর মাকে যে অপমান করেছে। ওর সামনে বলেছে, আপনারা বের হয়ে যান, বের হয়ে যান, তারা দূর -দূর করে আমাকে তাড়িয়ে দিল। এগুলো ও সহ্য করতে পারেনি।

দুই মেয়ের সব সার্টিফিকেট একটা ফাইল করে রেখেছেন এত দিন দিলীপ। সেখান থেকে অরিত্রীর সার্টিফিকেট দেখাতে দেখাতে বলেন, ‘ওর সার্টিফিকেট তো আর কোনো কাজে লাগবে না, ভিকারুননিসা আমাকে শেষ করে দিল। ওই স্কুলে কেন পড়াতে গেলাম আমি, তাহলে আজ আমাকে মেয়ে হারা হতো না।’

অরিত্রীর মা দিপালী অধিকারী অসুস্থ, কিন্তু মৃত্যুর পর তিনি প্রায় পাথর হয়ে গিয়েছেন। কেবল নিজেদের অ্যালবাম বের করে ছবিগুলো দেখছিলেন, দেখাচ্ছিলেন। এ প্রতিবেদককে সেসব ছবি দেখাতে দেখাতে বলেন, ওর জন্ম থেকে শুরু করে প্রতিটি ছবি এখানে আছে, এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে বলেই বোধহয় এত ছবি তুলেছিলাম আমরা।

অরিত্রীর বাসায় আসা আত্মীয়স্বজনরা বলছেন, আমাদের মেয়ে চলে গেছে, তাকে আর ফেরত পাব না। কিন্তু যে জন্য সে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে, আমরা চাই না সে ঘটনা আবার ঘটুক। আর কোনো অরিত্রী অভিমান করে চলে যাক আর কোনো বাবা-মায়ের কোল খালি হোক।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
অরিত্রীর আত্মহত্যা,ছাত্রীর আত্মহত্যা,ভিকারুননিসা,অরিত্রী অধিকারী
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close