জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না, লালমনিরহাট

  ১৫ আগস্ট, ২০১৮

এমপিওভুক্ত লালমনিরহাট ভুড়িধোয়া দাখিল মাদরাসার পাঠদানের বাস্তব চিত্র

একমাত্র শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক ৩ জন!

প্রথম থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত এবতেদায়ি শাখার ৫টি শ্রেণি মিলে মোট শিক্ষার্থী মাত্র একজন। যার পাঠদানের জন্য সেখানে সরকারি বেতনভুক্ত শিক্ষক রয়েছেন তিন জন। লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুন্ডা ইউনিয়নের মোস্তফি ভুড়িধোয়া দাখিল মাদরাসার বাস্তব চিত্র এটি।

শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জানান, অবহেলিত এ গ্রামের কোমলমতি ছেলে মেয়েদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে স্থানীয়দের উদ্যোগে ১৯৯০ সালে মোস্তফি ভুড়িধোয়া দাখিল মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম দিকে প্রথম শ্রেণি থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের অনুমতি পেলেও পরে দাখিল পর্যন্ত অনুমোদন দেন মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড। এরপর ২০০০ সালের ২৪ এপ্রিল এবতেদায়ি শাখায় ৩ শিক্ষক ও দাখিল শাখায় ১৪ জন শিক্ষক কর্মচারী নিয়ে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। সেই থেকে প্রথম শ্রেণি থেকে দাখিল পর্যন্ত ১০টি শ্রেণির পাঠদান চলে নিভৃত্য পল্লী গ্রামের এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

শিক্ষকরা বেতন ভুক্ত হওয়ার পরে পাঠদানে অবহেলা শুরু করলে শিক্ষার্থীরাও মাদরাসা ছেড়ে যেতে শুরু করে। সরকারি বেতনভুক্ত কর্মচারি হিসেবে সরকারের খাতায় নাম অন্তর্ভুক্ত হলে তা আর কোনোভাবেই মুছে যায় না। এ ধারণায় শিক্ষকরাও ইচ্ছেমত আসেন, স্বাক্ষর করেন আর চলে যান। বেতন ভোগ করলে শ্রম দিতে হয় বা দায়িত্ব পালন করতে হয়। সেটা তাদের অজানা নয়। এছাড়া ভুলেও সরকারি দফতরের কেউ খোঁজ নেন না সরকারি বেতনভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানটির। যার ফলে শিক্ষার পরিবেশ হারিয়ে ফেলেছে। ফলশ্রুতিতে মাদরাসা ছাড়তে শুরু করে শিক্ষার্থীরা।

সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কাগজ কলমে ১০টি শ্রেণিতে ২২৮জন শিক্ষার্থী থাকলেও বাস্তবে ৪০ জন শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া যায় নি। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত কোনো শিক্ষার্থী বা শ্রেণি কক্ষ নেই। পুরো ইবতেদায়ি শাখা মিলে ৫ম শ্রেণিতে রয়েছে একমাত্র শিক্ষার্থী নাঈম মিয়া। পড়াশুনার কোনো পরিবেশ নেই। পাশের বেঞ্চে খেলা করছে দুইটি মুরগি। ওই কক্ষে নাঈমকে পাঠদান করছেন জুনিয়র মৌলভী আক্কাস আলী। তার নিজেরও কোনো প্রস্তুতি নেই। সংবাদকর্মীরা মাদরাসায় এসেছেন শুনে ভোঁ দৌড়ে ছুটে এসে একমাত্র শিক্ষার্থী নাঈম মিয়াকে নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করেন শিক্ষক আক্কাস আলী। পাশেই মুরগিরা খেলা করছে সেটাও ভুলে গেছেন তিনি।

শিক্ষক আক্কাস আলী বলেন, প্রতিদিন ৫/৭ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে। তবে অজ্ঞাত কারনে আজ শিক্ষার্থীরা অনুপস্থিত। এবতেদায়ি শাখার অন্যসব শ্রেণি কক্ষ কোথায় এমন প্রশ্নে - পাশেই সাইকেল রাখা ফাঁকা একমাত্র কক্ষটিকে দেখান তিনি।

৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসে ৫/৮ জন করে শিক্ষার্থী বসে রয়েছেন শিক্ষকের আগমনের অপেক্ষায়। কোনো ক্লাসে শিক্ষক গেলেও প্রস্তুতিহীন। সংবাদকর্মীদের আগমনে পুরো প্রতিষ্ঠান আতংকিত। সকল শিক্ষক কর্মচারীর মাঝে অপরাধ আতংকের ছাপ। শিক্ষক হাজিরা খাতায় ছুটি নেই, স্বাক্ষর দেয়ার ঘরটিও ফাঁকা। তবুও প্রতি মাসে বেতন আসে তাদের। এটা দেখে যে কেউ মনে করবেন প্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্ন থেকে এখানে কোনো দিন সরকারি দফতরের কেউ পরিদর্শন করেননি।

নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক ৮ম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী প্রতিদিনের সংবাদকেকে জানান, কয়েক মাস পরেই জেডিসি পরীক্ষা অথচ তাদের ইংরাজী বিষয়ে দুই অধ্যায়ও পড়ানো হয়নি। সংবাদকর্মীরা এসেছেন শুনে শরীর চর্চার শিক্ষক নুর ইসলাম মিয়া এসেছেন ইংরাজী ক্লাসে। তাদের কোনো ক্লাস রুটিন নেই। যেদিন যখন ইচ্ছে শিক্ষকরা ক্লাসে আসেন। প্রতিদিন দুপুরেই মাদরাসা ছুটি হয়ে যায়। প্রতিবাদ করলে বার্ষিক পরীক্ষায় ফেল করে দেয়ার হুমকি।

মাদরাসার অফিস সুত্রে জানা গেছে, ১০টি শ্রেণিতে মোট শিক্ষার্থী ২২৮ জন। শিক্ষক কর্মচারী মিলে ১৭ জনের বেতন বাবদ প্রতি মাসে সরকারি বরাদ্ধ দুই লাখ ৮৫ হাজার ২২২টাকা। গত দাখিল পরীক্ষায় ২৮জন অংশ নিলেও পাস করেছে ২জন। সেটাও আবার বিগত বছরের ওই দুইজন শিক্ষার্থী। জেডিসি পরীক্ষায় ৩৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিগত বছরের ৩ জনসহ পাস করে মাত্র ১৬জন। মাত্র ৭/৮জন শিক্ষার্থীকে পাস করাতে এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন বাবদ সরকারি খরচ বছরে ৩৪ লাখ ২২ হাজার ৬৬৪টাকা ও দুইটি উৎসব ভাতা।

পাশের গ্রামের মোড়ল ও আজিজার রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, শিক্ষকরা ক্লাস না করায় ছেলেমেয়েরা মাদরাসায় গিয়ে গল্পগুজব করে বাড়ি ফিরে যায়। শিক্ষকরা এক দিন এসে ছয় দিনের স্বাক্ষর করেন হাজিরা খাতায়। লেখাপড়ার পরিবেশ না থাকায় তারা তাদের ছেলেমেয়েকে অন্যত্র পাঠাচ্ছেন। সরকারি উচ্চ মহলের সুষ্ঠ তদন্ত দাবি করেন তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার দুইজন স্কুল শিক্ষক প্রতিদিনের সংবাদকে জানান, পাঠদান না করায় মাদরাসাটির এবতেদায়ি শাখায় কোনো শিক্ষার্থী নেই। উচ্চ মহলের তদন্ত এলে পাশেই ভুড়িধোয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ডেকে নিয়ে দেখানো হয়। মুলতই এবতেদায়ি শাখাটি বন্ধ করে দেয়া উচিৎ বলে মন্তব্য করেন তারা।

মোস্তফি ভুড়িধোয়া দাখিল মাদরাসার সুপার আবুল বাশার নাঈমী প্রতিদিনের সংবাদকে জানান, অজ্ঞাত কারনে প্রথম থেকে ৪র্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ক'দিন ধরে মাদরাসায় আসছে না। তাই পাঠদান হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা না এলে শিক্ষকদের কী করার আছে আপনারাই বলুন? তবে এবতেদায়ি শাখার শিক্ষার্থীর শ্রেণি কক্ষ দেখতে চাইলে তিনি দেখাতে পারেননি। উল্টো একাডেমিক ভবন দাবি করেন।

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
একমাত্র,শিক্ষার্থী,শিক্ষক
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close