প্রতীক ইজাজ

  ১১ এপ্রিল, ২০১৮

দ্রুত সংস্কারের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

কোটার আন্দোলনে রাজনীতির শঙ্কা

সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সন্দেহ দেখা দিয়েছে আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে। এটি কি প্রকৃতই সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন; নাকি এর পেছনে সরকারবিরোধী রাজনীতির উসকানি রয়েছে—সামনে চলে এসেছে বিষয়টি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কোটা পদ্ধতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আগামী ৭ মে’র মধ্যে সংস্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানোর সরকারের প্রতিশ্রুতির একাংশের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় এমন সন্দেহ আরো বেড়েছে। বিশেষ করে রোববার গভীর রাতে হঠাৎ করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে ন্যক্কারজনক হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা আন্দোলনের নেপথ্য কারণ নিয়ে সন্দিহান করে তুলেছে সবাইকে। আন্দোলনেও বিভক্তি এসেছে।

গত সোমবার ক্ষমতাসীন দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদের এক বৈঠকে আন্দোলন ৭ মে পর্যন্ত স্থগিতের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। কিন্তু মূল আন্দোলনকারীদের সিদ্ধান্ত অমান্য করে একটি গ্রুপ গতকালও আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। এই অংশকে আন্দোলন স্থগিত করা মূল অংশটি ‘অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্ঠী’ বলে দাবি করেছে। এমনকি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া অংশ মূল কমিটির কেউ নয় এবং এরাই ভিসির বাসায় হামলা করেছে বলেও দাবি করেছে মূল আন্দোলনকারীরা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করাই তাদের মূল লক্ষ্য।

এমন পরিপ্রেক্ষিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলতে শুরু করেছেন। সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ‘রাজনীতির অন্ধ বিদ্বেষ’ ঢুকেছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি এমন সন্দেহের পেছনে ভিসির বাসভবনে হামলা ও স্থগিত ঘোষণার পরও একপক্ষের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়াকে প্রমাণ হিসেবে দেখছেন। তারমতে, যারা সত্যিকার অর্থে কোটা সংস্কার চান, সরকারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে সমঝোতার পর তাদের আন্দোলনে থাকার কথা নয়। তারপরও এক অংশের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অর্থই প্রমাণ করে আন্দোলনে বিদ্বেষপ্রসূত রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। সেই রাজনীতির অন্ধ আক্রোশের শিকার হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেও মনে করেছেন তিনি। এমনকি কোটা সংস্কার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো একপক্ষ শিক্ষার্থীদের উসকানি দিচ্ছে বলেও সতর্ক করেন ওবায়দুল কাদের।

একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান রোববার রাতে তার বাসভবনে হামলার পেছনে বিভীষিকা সৃষ্টি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারকে অচল করার পরিকল্পনা ছিল বলে মন্তব্য করেন। গতকাল তিনি বলেন, দুর্বৃত্তরা চেয়েছিল একটি লাশের রাজনীতি করতে, রক্তের রাজনীতি করতে। এটি একবারেই রাজনৈতিক উদ্দেশে করা হয়েছে। হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে রক্তপাত ঘটিয়ে একটি বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি করে বিশ্ববিদ্যালয়কে অচল করা, সরকারকে অচল করা, অস্থিতিশীল একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা। এই হামলার সঙ্গে কোটার কোনো সম্পর্ক নেই বলেও মনে করেন উপাচার্য।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও উপাচার্যের বাসভবনে হামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করেছেন। অনুরূপভাবে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ‘কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের মধ্যে কতিপয় উদ্দেশ্যমূলকভাবে অন্তর্ঘাত নাশকতার ঘটনা ঘটিয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের এই অন্তর্ঘাত নাশকতার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নাই’ বলে মন্তব্য করেছেন।

তবে কোটা সংস্কারের আন্দোলন ভিন্নখাতে নিতে ‘সরকারের এজেন্টরাই’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বাসভবনে হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, এই হামলা পরিকল্পিত ও রহস্যজনক।

এমন পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত সরকারকে কোটা সংস্কারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পরামর্শ দিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমান। তিনি বলেন, সময় নেওয়া ঠিক হবে না। নতুবা আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার শঙ্কা থেকেই যায়।

এই উপাচার্য বলেন, সাবেক কেবিনেট সচিব বা এমন দক্ষ আমলাদের নিয়ে সরকার একটি সংস্কার কমিটি করতে পারে। সে কমিটি পর্যবেক্ষণ করে সুপারিশ করবে। সে অনুযায়ী, সরকার সংস্কারে উদ্যোগ নিতে পারে। এ ঘোষণাটি সরকারকে দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যেই দেওয়া উচিত। দেরি করা ঠিক হবে না।

এই শিক্ষাবিদ বলেন, কোটা সংস্কারের ব্যাপারে সরকার কিন্তু নীতিগতভাবে ইতিবাচক। প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগেও কিন্তু সংস্কার করতে বলেছেন। বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থায় সুচিন্তিত সংস্কার আনতেই হবে। এমন কিছু কোটা আছে, যেগুলো শতভাগ লাগছে না। সেগুলোর জন্য অযথা সরকার কেন বিতর্কিত হবে। সরকার মেধা থেকে ৭০ শতাংশ ও কোটা থেকে ৩০ শতাংশ নিয়োগ দিতে পারে। কিছু কোটা পুরোটা কাজে লাগছে না। মুক্তিযোদ্ধা ও জেলাসহ বেশকিছু কোটা সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে।

অবশ্য কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থীদের আন্দোলন, আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি এবং আন্দোলনের নেপথ্যে সরকারবিরোধী রাজনীতির ব্যাপারে খুবই সতর্ক ও শক্ত অবস্থান নিয়েছে সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সরকারের সূত্রগুলো বলছে, কোটা সংস্কারের ব্যাপারে সরকার ইতিবাচক। ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার বৈঠকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংস্কারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন। কিছুতেই কোনো পক্ষ এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে যেন কোনো সুযোগ নিতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক অবস্থান নেওয়া হয়েছে এবং সুষ্ঠু সমাধানের পথে এগোচ্ছে। এ জন্য সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে।

পাশাপাশি আন্দোলনে যেন কোনো অনুপ্রবেশকারী ঢুকতে না পারে ও আন্দোলনকে সরকারবিরোধী রাজনীতিতে রূপ দিতে না পারে, সে জন্য দল ও সরকার কঠোর ও শক্ত অবস্থান নিয়েছে বলে জানিয়েছে আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো। দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলেন, কিছুতেই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না। যেহেতু কোটা সংস্কারের ব্যাপারে সরকার খুবই ইতিবাচক, সুতরাং এই আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে দেওয়া হবে না।

আওয়ামী লীগের সূত্রমতে, উপাচার্যের বাসভবনে হামলা সাধারণ বিক্ষোভকারীদের নয়। প্রশিক্ষিত হামলাকারীরা মুখোশ পরে এসেছিল। পরিকল্পিত হামলা বলেই ভবনের ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। অথচ উপাচার্যের সঙ্গে কোটার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। রোববার রাতে যখন দলের নেতাদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের আলোচনা চলছিল, ঠিক তখনই উপাচার্যের বাসভবনে এই পরিকল্পিত হামলা হয়।

হামলাকারীদের কিছুতেই ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা। এ ব্যাপারে ওবায়দুল কাদের বলেন, ওই হামলায় জড়িতদের অনেককে ইতোমধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে ‘তদন্তের স্বার্থে’ বিস্তারিত কিছু জানাননি তিনি। মন্ত্রী আরো বলেন, তদন্ত চলছে, ইতোমধ্যে যারা ক্রিমিনাল অফেন্ডার চিহ্নিত হয়েছে, বাকিরাও চিহ্নিত হবে এবং এই বিচার করতেই হবে, যাতে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে না পারে। তিনি আরো জানান, হামলাকারীরা সিসি টিভি ও হার্ড ডিস্ক খুলে নিলেও প্রমাণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো সিসি টিভি ও গণমাধ্যমের ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ও কঠোর অবস্থানে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চিহ্নিত দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি তাদের পৃষ্টপোষকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়িতে হামলাকারীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। চিহ্নিত করার পর তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি সেদিনের সংঘাতে একজনের মৃত্যুর গুজব ফেসবুকে ছড়ানোর ঘটনায়ও মামলা হবে বলে জানান মন্ত্রী।

একইভাবে মূল আন্দোলনকারীরা আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণার পরও যে বা যারা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে, সে ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা সতর্ক বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগ সূত্রমতে, এদের রাজনৈতিক পরিচয় নেওয়া হচ্ছে। যে একাংশ এখনো আন্দোলন করছে ইতোমধ্যেই তাদের অনেকের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছে সরকার। এমন তথ্যও মিলেছে যে এদের মাধ্যমে আন্দোলনের ব্যাপারে উসকানি দেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের গতকাল সতর্ক করেছেন ওবায়দুল কাদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বিদ্বেষপ্রসূত রাজনীতি ঢুকেছে। এই আন্দোলনে বেশিরভাগ ভূমিকা যারা নিয়েছে তারা কিন্তু ইতোমধ্যে আমাদের সঙ্গে বসেছে। তারা বলেছে সাত মে পর্যন্ত এই আন্দোলন স্থগিত রাখবে। এর মধ্যে দেশের প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। আমি মনে করি, যারা সত্যিকার অর্থে কোটা সংস্কার করতে চান এই সমঝোতার পর তারা এখানে (আন্দোলনে) থাকবে না। যারা থাকবেন তারা এই আন্দোলনের সঙ্গে যে রাজনীতির বিদ্বেষপ্রসূত রাজনীতি ঢুকে পড়েছে, যেই রাজনীতির অন্ধ আক্রোশের শিকার হয়েছেন।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কোটা সংস্কার,সরকারি চাকরিতে নিয়োগ,ভিসির বাসায় হামলা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist