প্রতীক ইজাজ

  ০১ এপ্রিল, ২০১৮

কাল শুরু এইচএসসি পরীক্ষা

প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে সতর্ক সরকার

আগামীকাল সোমবার থেকে দেশে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। এবার পরীক্ষায় ১৩ লাখের বেশি পরীক্ষার্থী অংশ নেবে। সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন করতে শেষ মুহূর্তের ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সহযোগী অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত পরীক্ষার্থী। উৎকণ্ঠায় অভিভাবকরাও। প্রতিবারের মতো এবারও সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে।

যদিও সরকার যেকোনো উপায়ে এবার পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে তৎপর; নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগও। কিন্তু শেষপর্যন্ত এসব উদ্যোগ প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে পারবে তো—এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে পরীক্ষার্থী, অভিভাবক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যেও। কেননা ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায়ও একইভাবে প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। অথচ ওই পরীক্ষায় আগাম ঘোষণা দিয়েই ব্যাপক হারে ফাঁস হয়েছিল প্রশ্ন। ভীষণ বিপাকে পড়েছিল পরীক্ষার্থী ও কর্মকর্তারা। তদন্ত কমিটি হয়েছিল। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। এমনকি যেসব বিষয়ে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল, সেসব পরীক্ষা বাতিল হবে, নাকি বহাল থাকবে, সে সিদ্ধান্তও নিতে পারেনি মন্ত্রণালয়। ফলে এবারও প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে ভীষণ উদ্বেগের মধ্যেই শুরু হতে যাচ্ছে পরীক্ষা।

প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে অবশ্য এবার আগের যে কোনোবারের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে শিক্ষক, অভিভাবক, গণমাধ্যমকর্মীসহ সর্বস্তরের জনগণের সহযোগিতা কামনা করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বেশ জোর দিয়েই বলেছেন, অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে এবার পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে এবং প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী এ বলেও সতর্ক করেছেন যে, অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক প্রশ্ন প্রকাশ করে প্রচারণা চালানো হয়। এ ধরনের মিথ্যা প্রচারণা থেকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে সরকারের নানা উদ্যোগের কথা জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, এবার পরীক্ষা শুরুর ২৫ মিনিট আগে লটারির মাধ্যমে প্রশ্নপত্রের সেট নির্ধারণ করা হবে। প্রশ্ন বিতরণ ব্যবস্থায়ও নানা পরিবর্তন আনা হয়েছে। পরীক্ষার্থীদের ৩০ মিনিট আগেই কেন্দ্রে প্রবেশ বাধ্যতামূলক। সরকার কর্মকমিশন (পিএসসি) বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় লটারির মাধ্যমে প্রশ্ন সেট নির্ধারণ করে এলেও পাবলিক পরীক্ষায় এবারই প্রথম একই পদ্ধতি চালু হতে যাচ্ছে। রাজধানীসহ সারাদেশেই কমিয়ে আনা হয়েছে অভিযুক্ত ও অপ্রয়োজনীয় অর্ধ শতাধিক পরীক্ষা কেন্দ্র। প্রশ্নপত্র ট্রেজারি থেকে কেন্দ্রে নিয়ে পরীক্ষা শুরু হওয়া পর্যন্ত একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা সমমর্যাদার কর্মকর্তা সঙ্গে থাকবেন। প্রশ্ন নেওয়ার সময় ব্যবহার করা হবে বিশেষ ধরনের ব্যাগ।

এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, পরীক্ষার ২৫ মিনিট আগে লটারির মাধ্যমে ঢাকা বোর্ড প্রশ্নপত্রের সেট নির্ধারণ করবে। এর আগে কোনো কারণে প্যাকেট খোলার প্রমাণ পাওয়া গেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্রের সব সেট নিরাপত্তার মোড়কে কেন্দ্রে পাঠানো হবে। পরীক্ষার্থীরাও আধাঘণ্টা আগে কেন্দ্রে প্রবেশ করবেন। তবে কত সেট প্রশ্ন ছাপা হবে, তা জানাননি সচিব।

এত কিছুর পরও প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে উদ্বেগ কাটছে না সবার। কেননা এর আগে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এসএসসির প্রায় প্রতিটি পরীক্ষাতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। ফলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। সংসদে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিও ওঠে। এ কারণেই এবার বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছে সরকার। তবে এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় দোষ নিতে নারাজ মন্ত্রণালয়। এ ব্যাপারে শিক্ষা সচিব সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে অন্যের অপরাধের জন্য বিনা কারণে মন্ত্রণালয়কে দোষারোপ করা হয়েছে, যা দুঃখজনক। অন্য কেউ পরীক্ষা নিলেও এর চেয়ে ভালোভাবে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হবে না। তিনি দাবি করেন, সদ্যসমাপ্ত এসএসসি পরীক্ষায় যেসব প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে তাতে খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গড়ে সাড়ে ৭ শতাংশ নম্বরের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। ১৭ পরীক্ষার মধ্যে ১২টিতে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, তবে তাও এমসিকিউ (নৈর্ব্যক্তিক) অংশ। রচনামূলক ৭০ নম্বর ফাঁস হয়নি।

তবে প্রশ্ন ফাঁসকারীরা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও বিতরণ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রশ্ন ফাঁস বা তার গুজব শিক্ষার্থীদের মানসিকতা দুর্বল করে দেয়। এ কর্মকান্ড অব্যাহত থাকলে শিক্ষাব্যবস্থায় ধস নেমে আসবে। রাষ্ট্রে মেধাবী জাতি তৈরি হবে না। তাই এসব কেলেঙ্কারি বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে একটি শক্তিশালী কমিটি তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের সার্বিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। এ কাজের সঙ্গে জড়িত যেই থাকুক না কেন, অপরাধীর মুখোশ উন্মোচন করে তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিতে হবে।

এই শিক্ষাবিদের মতে, প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নের ধরনে পরিবর্তন আনতে হবে। এমনভাবে প্রশ্ন তৈরি করতে হবে যা ক্লাসে ৫০ শতাংশ মূল্যায়ন হয়েছে। তবেই প্রশ্ন ফাঁসের প্রতি আগ্রহ কমে যাবে। বহুনির্বাচনী প্রশ্ন ক্রমান্বয়ে তুলে দিতে হবে। সৃজনশীলতার দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে পরীক্ষার্থীরা নিজের মেধা খাটিয়ে লিখতে পারে। প্রশ্ন ফাঁস ও কোচিং ব্যবসা বন্ধে তিনি পঞ্চম শ্রেণির পিইসি-সমাপনী ও অষ্টম শ্রেণির জেএসসি-জেডিসির পাবলিক পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানান।

এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা তদন্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রশ্ন ফাঁসের ছয়টি কারণ চিহ্নিত করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিজি প্রেসে প্রশ্ন কম্পোজ, এডিট, প্রিন্ট ও প্যাকেজিং কাজে সম্পৃক্ত অন্তত আড়াই শ কর্মী প্রশ্ন দেখতে পান। তারা প্রশ্ন কপি করতে না পারলেও তার স্মৃতিতে ধারণ করা অসম্ভব ব্যাপার নয়। এদের মধ্যে মাত্র ৩-৪ জনের একটি গ্রুপের পক্ষে প্রশ্ন ফাঁস অসম্ভব কিছু না। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে ট্রেজারি বা নিরাপত্তা হেফাজত থেকে প্রশ্ন গ্রহণ করে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনেক কেন্দ্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন না করার অভিযোগ রয়েছে। অতিরিক্ত কেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হলেও ওইসব কেন্দ্র ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত জনবল নেই। তাছাড়া ভেন্যুগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মূল কেন্দ্র থেকে দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত। ফলে ৩০ মিনিট সময়ের আগেই কেন্দ্র সচিবরা প্রশ্ন খুলতে বাধ্য হচ্ছেন। এতেও প্রশ্ন ফাঁসের ঝুঁকি থেকে যায়।

কর্মকর্তারা আরো বলেন, পরীক্ষার্থী কিংবা পরীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্তদের স্মার্টফোন নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর হয়ে পড়ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসকারীদের চিহ্নিত করতে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতা আরো বৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে। এটা পরীক্ষা শুরুর কমপক্ষে ১৫ দিন পূর্ব হতে করা সম্ভব হলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। গোয়েন্দা সংস্থার লোকবল, অবকাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত স্বল্পতার কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা স্মার্টফোনের মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁস রোধ করতে প্রয়োজনীয় নজরদারি করা সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া বিটিআরসির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন আপলোডকারীদের চিহ্নিত করতে দেখা যাচ্ছে না এবং সন্দেহজনক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

এমনকি গত বছর ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ পাওয়ার পর এ বছর ‘অধিক সতর্কতা’ অবলম্বন করেও সফল হওয়া যায়নি বলে মত দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এজন্য মন্ত্রণালয় সুষ্ঠুভাবে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠানে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সস্থার সহযোগিতা প্রয়োজন বলে সরকারকে আগেভাগেই জানিয়েছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা,প্রশ্ন ফাঁস,শিক্ষা মন্ত্রণালয়
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist