হাসান শান্তনু

  ০৯ জানুয়ারি, ২০১৮

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের মুখে অবশেষে হাসি ফুটতে যাচ্ছে। তাদের এমপিওভুক্ত (বেতনের সরকারি অংশ পাওয়া) করার প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর মধ্য দিয়ে তাদের বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষার অবসান হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষকদের দেওয়া আশ্বাসের বাস্তবায়ন হচ্ছে। পাশাপাশি দীর্ঘ সাত বছর ধরে বন্ধ থাকার পর আবারও এমপিওভুক্ত হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে এক যুগেরও বেশি সময় পার করা অনেক প্রতিষ্ঠানও আছে। এগুলোতে পড়াশোনা করছেন প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী।

নতুন এমপিওভুক্তি-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সংশোধিত এমপিও নীতিমালার খসড়াও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এমপিওভুক্তির জন্য বাজেটে প্রায় দেড় শ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেখান থেকে খসড়াটি চূড়ান্ত হয়ে আসার পর শিক্ষক ও কর্মচারীদের কাছে এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন আহ্বান করবে মন্ত্রণালয়। এরপর প্রচলিত নীতিমালা অনুসরণ করে ও যাছাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এমপিওভুক্ত করা হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এটা নির্ভর করছে অর্থ মন্ত্রণালয় এ খাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেটে কত টাকা বরাদ্দ দেয়, তার ওপর। মন্ত্রণালয়ের হিসাবমতে, স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হলে মাসে আরো প্রায় দেড়শ কোটি টাকা খরচ হবে। এমপিওভুক্তির দাবিদার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ঢালাও দেওয়ার সুযোগ নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শর্ত যারা পূরণ করতে পারবে না, তাদের এমপিওভুক্ত করা হবে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যত টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছে, এ ভিত্তিতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে এমপিওভুক্তির আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কয়েকটি বিষয় মূল্যায়ন করা হবে। নীতিমালা অনুযায়ী যাচাই-বাছাইয়ে সব প্রতিষ্ঠান যোগ্য না-ও হতে পারে। শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ কয়েকটি বিষয় মূল্যায়ন করে তাদের এমপিওভুক্তির জন্য নির্বাচন করা হবে।

জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে। বিদ্যমান নীতিমালাটি আরেকটু যুগোপযোগী করার কাজ শুরু হয়েছে।’

জানতে চাইলে নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মাহমুদুন্নবী বলেন, ‘আমরা আশা করছি, শিগগির এমপিওভুক্তি শুরু হবে। কারণ, প্রধানমন্ত্রী আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে কার্যক্রম শুরুর নির্দেশও দিয়েছেন।’

সূত্র জানায়, এমপিওর খাত থেকে ৬১৪ কোটি টাকা গোপনে সরিয়ে ব্যাংকে রেখে লভ্যাংশ খেয়ে আসছে মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী চক্র। এ সময়ের মধ্যে মুনাফার প্রায় ১০০ কোটি টাকা লুটপাট করেন চক্রের সদস্যরা মিলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গোয়েন্দা জালে এসব অনিয়ম ধরা পড়ে। এ টাকা আদায় করে এমপিওভুক্তির কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ খাতের অব্যয়িত ৬১৪ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দিয়ে নিয়মবিহর্ভূতভাবে নিজস্ব হিসাবে (অ্যাকাউন্টে) রেখেছে মাউশি। এমনকি নয় মাস আগে অর্থ মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিলেও অদ্যাবধি সাড়া দেননি সংশ্লিষ্টরা। এমপিও সুবিধা স্থগিত, শিক্ষকের অবসর ও মৃত্যুসহ বিভিন্ন কারণে ব্যয় না হওয়া এ টাকা ১০ বছর ধরে জমা হয়েছে।

গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে (২০০১-২০০৬) শিক্ষকদের সরকারি বেতনের টাকা নিয়ে এভাবে চরম দুর্নীতি শুরু হয়। যা ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ধরা পড়ে। তখন জমে থাকা ১০০ কোটি টাকা ফেরতের উদ্যোগও নেওয়া হয়। তবে সরকার পরিবর্তনের পরপর ফাইল চাপা পড়ে যায় সব উদ্যোগ।

অন্যদিকে এমপিওভুক্তির দাবিতে নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীরা গত কয়েক বছর ধরে আন্দোলন করে আসছেন। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর থেকে তারা টানা অবস্থান কর্মসূচি পালনের পর একপর্যায়ে ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আমরণ অনশন শুরু করেন। গত ২ জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শিক্ষকদের কাছে যান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিওভুক্ত করার আশ্বাস দেন। কিন্তু শিক্ষকরা তার এ আশ্বাস প্রত্যাখ্যান করেন। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস না পাওয়া পর্যন্ত তারা অনশন চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দেন। গত শুক্রবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তার একান্ত সচিব-১ সাজ্জাদুল হাসান অনশনস্থলে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের কথা জানান। এরপর তারা কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন।

জানা যায়, ২০১০ সালে এক হাজার ৬২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছিল। এরপর আর এমপিওভুক্তি হয়নি। তখন সব সংসদ সদস্যের পছন্দ অনুযায়ী এমপিওভুক্ত করা যায়নি। এ কারণে সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে পড়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। ২০১০ সালে এমপিওভুক্তির আগে এ কার্যক্রম বন্ধ ছিল ছয় বছর। ২০১১ সালে এক হাজার বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা এমপিওভুক্তি করার ঘোষণা দেওয়া হলেও তা করা হয়নি।

তীব্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী তিন মাসের মধ্যে এমপিওভুক্ত করার আশ্বাস দেন ২০১২ সালের ডিসেম্বরে। তা আদৌ বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১৪ সালের আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে নতুন এমপিও নীতিমালা তৈরির তাগিদ দেন। সে অনুযায়ী মন্ত্রণালয় নীতিমালাও তৈরি করে। তবে নীতিমালা হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাদ্দ পাচ্ছে না এমপিওর জন্য। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আগেও শিক্ষামন্ত্রী অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে আহ্বান জানান এ খাতে বরাদ্দ রাখতে। তবে বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ নেই। এসব কারণে ২০১৩ সাল থেকে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদনের সময় শর্ত জুড়ে দেওয়া হচ্ছে, এমপিও সুবিধা দাবি করা যাবে না।

মাউশি জানায়, সারা দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে ২৭ হাজার ৮১০টি। এগুলোতে শিক্ষক-কর্মচারী চার লাখ ৯৬ হাজার ৩৬২ জন। তাদের বেতন ও ভাতা বাবদ মাসে খরচ হয় প্রায় ৯৪২ কোটি টাকা। এ খাতে বছরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব বরাদ্দের প্রায় ৬৪ শতাংশ অর্থই খরচ হয়। এর বাইরে স্বীকৃতি পাওয়া নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে পাঁচ হাজার ২৪২টি। এগুলোতে শিক্ষক ও কর্মচারী ৭৫ হাজারের বেশি। স্বীকৃতির বাইরেও দুই হাজারেরও বেশি নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
শিক্ষা মন্ত্রণালয়,বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,নন-এমপিওভুক্ত
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist