হাসান শান্তনু
অযত্নের ছাপ পাঠ্যবইয়ে!
পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী গীতিময় মৌটুসী। জাতীয় পাঠ্যপুস্তক উৎসবের দিন নতুন বই হাতে পেয়েও উচ্ছ্বসিত হতে পারেনি সে। বরং বই পেয়ে ওর মনটা ভীষণ খারাপ। ‘আমার বাংলা’, ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ ও ‘গণিত’ বইয়ে যেন ছাপাখানার ভূত ভর করেছে। কোনো বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠার ওপরের কয়েক লাইন কাটা, কোনো বইয়ের মলাট উল্টো। পাতায় পাতায় ভুল। নিম্নমানের কাগজে ছাপা। ছাপাও অস্পষ্ট। ছবি চেনা দায়। পাঠযোগ্য নয় অনেক পৃষ্ঠা। এমনকি জাতীয় পতাকার লাল ও সবুজ রং পাল্টে গেছে। এমন বই সে নিতে চায়নি।
মৌটুসী পড়ে ঢাকার মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। ওর অভিভাবক পাঠের অযোগ্য এসব বই নিয়ে বিদ্যালয়ে যোগাযোগ করলে শিক্ষকরা বলেন, ‘বইয়ের যে অংশ পড়া যাচ্ছে না, অন্য বই থেকে দেখে সেগুলো আমরা শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করাব।’ বাড়তি বই না থাকায় মৌটুসীর বাবা-মায়ের মতো অনেক অভিভাবক উপায়হীনভাবে এ রকম বই-ই নিচ্ছেন। আবার বিনামূল্যের এসব বই পেয়ে বাড়ি ফিরে পাতা ওল্টাতে গিয়ে পৃষ্ঠা এলোমেলো দেখে ফেরত দিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। দেশের প্রায় সব এলাকায় প্রাথমিক পর্যায়ের বই নিয়ে এমন ঘটনা ঘটছে।
বই ঘেঁটে দেখা যায়, গতবারের ছাগলকে বাদ দিয়ে এবার হরিণকে গাছে তুলে পাতা খাওয়ানো হয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণির ‘আমার বাংলা’ বইয়ে এমন কাণ্ড ঘটানো হয়েছে। এ বইয়ের ১৯ পৃষ্ঠার ছবিতে দেখানো হয়েছে, অনেক হরিণ ‘আক্ষেপ’ করছে আর একটি হরিণ গাছে উঠে পাতা খাচ্ছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে নিম্নমানের কাগজ দিয়ে এবারও পাঠ্যবই ছাপা হওয়ায় এর মান এমন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্পাদনা বিভাগও দায়সারা কাজের প্রতিফলন ঘটেছে বিভিন্ন বইয়ের পৃষ্ঠায়। বই ছাপানোর ক্ষেত্রে এনসিটিবির নির্ধারিত নীতিমালাও কয়েক প্রকাশক মানেননি। এনসিটিবির কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী ইউনিয়নের নেতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা প্রভাবশালী একটি চক্র এর সঙ্গে জড়িত। এনসিটিবির কড়া নজরদারি না থাকায় নিম্নমানের কাগজ দিয়ে অসাধু চক্র বই ছাপানোর সুযোগ নেয় বলে এনসিটিবি এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়।
জানতে চাইলে পাঠ্যবইয়ে এসব ভুলের বিষয়ে শিক্ষাবিদ সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘শিশুদের ভুল বই পড়িয়ে শিক্ষার মান উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। ছোট থেকেই যদি শিশু-কিশোররা ভুল শিখে বড় হয়, তবে মেধার বিকাশ ঘটাতে বাধা সৃষ্টি হবে। এর দায়ভার এনসিটিবির কর্মকর্তাদের। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ভুলের প্রভাব গোটা জাতির ওপর পড়ছে। এ কারণে শিশুদের ভুল দিয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করতে হচ্ছে।’ ভুলে ভরা পাঠ্যবই দ্রুত সংশোধন করার দাবি জানান তিনি।
বইয়ে এসব ভুল ‘স্বাভাবিক আর প্রতিবছর এসব ভুল সংশোধন করা হয়’ বলে প্রতিদিনের সংবাদের কাছে দাবি করেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা। তিনি বলেন, ‘এ বছরও বইয়ের ভুল সংশোধন করা হবে। তবে পাঠ্যবইয়ের ভুলত্রুটি এখনো নির্ণয় করা হয়নি। বিশ্লেষকরা বইগুলো মূল্যায়ন করে থাকেন। সেখানে কোনো অসংগতি বা ভুল ধরা পড়লে তা বছর সংশোধন করা হবে।’ গত শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইয়েও বিভিন্ন ভুল বানান ও বাক্যে অসংগতি ছিল। এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। শিক্ষাবর্ষ শুরুর প্রায় সাড়ে চার মাসের মাথায় এনসিটিবি এ বিষয়ে সংশোধনী পাঠায়।
চলতি শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিকের কয়েকটি বই ঘেঁটে জানা যায়, পঞ্চম শ্রেণির ‘আমার বাংলা’ বইয়ের ভেতরে ছাপা ঝাঁপসা। কোনো বইয়ের পৃষ্ঠা এলোমেলো। ৫৪ পৃষ্ঠার পরে ৫৫ পৃষ্ঠা হওয়ার কথা থাকলেও ৫৪-এর পরের পৃষ্ঠা নম্বর দেওয়া হয়েছে ৭০। বইয়ের ১৬টি পৃষ্ঠা বাদ পড়েছে। বইটির মলাট ওল্টালেই পতাকার একটি পরিষ্কার ছবি পাওয়া যায়। কিন্তু বইয়ের ভেতরের পৃষ্ঠার ছাপা পরিষ্কার নয়। বইয়ের ৩৩ নম্বর পৃষ্ঠায় একটি পতাকার ছবি ছাপা হয়েছে। এতে পতাকার লাল অংশটুকু ফোটেনি। সবুজ রংটুকুও কালচে হয়ে আছে। পঞ্চম শ্রেণির গণিত বইয়ের ৪১ থেকে ৫৭ পৃষ্ঠা পর্যন্ত দুবার ছাপা হয়েছে।
১০৮ পৃষ্ঠায় কবি পরিচিতি অংশে কবি শামসুর রাহমানের ছবি ছাপা হয়েছে। এতই কালিঝুলি মাখা ছবি যে, নিচের নাম না পড়লে বোঝার উপায় নেই, সবার পরিচিত সুদর্শন চেহারার কবি শামসুর রাহমানের ছবি এটি। একই অবস্থা করা হয়েছে ৪৩ পৃষ্ঠায় কবি সুকুমার বড়ুয়া ও ৫৫ পৃষ্ঠায় আহসান হাবিবের ছবিতেও। ঘাসফুল কবিতার কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ছবির দিকে তাকালে মনে হয়, এ ছবির কোনো মুখ নেই। শুধুই কালো রং। ১১১ পৃষ্ঠায় ছাপা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে ছবি দেখে কেউ চিনতেই পারবেন না।
তৃতীয় শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচিতি’ বইয়ের ৬৭ পৃষ্ঠায় দেশের জনসংখ্যা পরিচিতিতে নানা ধরনের ভুল তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এ অধ্যায়ে দেশের জনসংখ্যা নির্ণয়ে ২০১১ সালের আদমশুমারির হিসাব অনুযায়ী জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে, ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৪ জন। একই পৃষ্ঠায় দেশের আয়তন এক লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের সমুদ্রসীমার ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার যোগ হয়েছে বাংলাদেশের সীমানায়। বর্তমান সরকারের একটি বড় অর্জন এটি। এ ঘটনার এক বছর হয়ে গেলেও এনসিটিবির কর্মকর্তাদের কানে হয়তো তা পৌঁছায়নি। এ কারণে পুরনো হিসেবে পাঠ্যবইয়ে তুলে দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, কয়েক বছর ধরে চক্রের বিরুদ্ধে পাঠ্যবই ছাপানো নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এ পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি এনসিটিবি। ২০১৪ শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর ক্ষেত্রে নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করে প্রায় ৮৪ কোটি টাকা লুটে নেওয়ার অভিযোগ আছে কার্যাদেশপ্রাপ্ত কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে বিনামূল্যের পাঠ্যবইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি, ছাপা ও বিতরণ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হয় বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে। এনসিটিবির পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন ও পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনা এবং সরবরাহের সর্বমোট ২০টি ধাপের মধ্যে ১৭টি ধাপে সুশাসনের ঘাটতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয় টিআইবির প্রতিবেদনে। এ কাজে জড়িত জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান থেকে পিয়ন পর্যন্ত জড়িত। সম্মানীর নামে এ বছরের পাঠ্যবইয়ের কাজ থেকে তারা মোট ৫১ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে ১৬ দফা সুপারিশ পেশ করেছে দুর্নীতিবিরোধী এ সংস্থা।
পিডিএসও/হেলাল