ইয়াসমীন রীমা
নারী নির্যাতন
বোবা কান্নায় ভারী হচ্ছে দেশ
মোল্লাবাড়িতে কান্নার রোল। কান্নার শব্দ আর আহাজারি করুণ করে তুলছে পরিবেশ। কাঁদছে মোল্লার বাড়ির বড়কর্তা, কাঁদছে তার গিন্নি। কাঁদছে তাদের পাঁচ ছেলেমেয়ে, প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন। মোল্লার বাড়ির ওপর রৌদ্রঢালা আকাশ যেন ভারী হয়ে আছে। কোথাও কোনো নীরবতা নেই। চারদিকে ভেসে যাচ্ছে কান্নার করুণ সুর। পুরো বাড়ির চৌহদ্দিতে আজ যেন শোকের ছায়া আঁধার করে আছে। কারণ এই বাড়ির সবার প্রিয় বড়কন্যা সুহেলীর লাশ কিছুক্ষণ আগে স্বামীর বাড়ি থেকে আনা হয়েছে কয়েক ঘণ্টার জন্য। জেলা হাসপাতালে পোস্ট মর্টেমের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে পরে।
বুড়িচং উপজেলা বড়ধুশিয়া গ্রাম থেকে সদর হাসপাতাল বেশ দূরের পথ বিধায় লাশের সঙ্গে আসা বুড়িচং থানার দ্বিতীয় দারোগা তাগদা দিচ্ছিলেন বারবার। সুহেলীর মৃত্যুর সংবাদ পৌঁছানো হয় তার মৃত্যুর আট ঘণ্টা পর। জানানো হয়েছে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে বিবাদে সে আত্মহনন করেছে নিজের ঘরের সিলিংয়ের সঙ্গে গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছিল অন্য কথা। তার স্বামী পিটিয়ে মেরেছে তাকে। অগত্যা সুহেলীর পিতা মোল্লাবাড়ির বড়কর্তা আবদুল করিম বুড়িচং থানার ওসিকে জানান দিয়ে কন্যার লাশ আনতে গিয়েছিলেন। পুলিশ সুহেলীর স্বামী মিষ্টির কারিগর আবু বক্কর বা তার শ্বশুরবাড়ির কাউকে বাড়িতে পায়নি। সবাই আত্মগোপন করেছে। সুহেলীর এই করুণ মৃত্যু কিছুতে মানতে পারছিল তার এলাকাবাসী। সবাই এক বাক্যে এর বিচার দাবি করেছে।
কেবল সুহেলী কেন। বাংলাদেশে অধিকাংশ গ্রাম-শহর-শহরতলিতে স্বামী ও তার স্বজনদের দ্বারা অমানবিক নির্যাতনে অহরহ খুন হচ্ছে নারীরা। এ ছাড়া রয়েছে নানা কারণ। কখনো যৌতুকের কারণে, কখনো সংসারের খুঁটিনাটি বিষয় ধরে অথবা স্বামী বা স্ত্রীর পরকীয়া তথা অনৈতিক সম্পর্কের কারণে। তবে বলাই বাহুল্য এর মধ্যে ৮১ ভাগ হত্যাকান্ড ঘটছে যৌতুকের দাবিতে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে দেশে স্বামী ও স্বামীর স্বজনদের হাতে খুন হয়েছে ১ হাজার ১৭৫ জন নারী। শুধু ২০১৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত খুন হয়েছে ১৫৩ জন নারী। এর মধ্যে স্বামীর হাতে খুন হয়েছে ১১২ জন। বাকি ৪১ জনকে খুন করেছে স্বামীর পরিবারের সদস্যরা। এর মধ্যে ২০১৩ সালে স্বামীর হাতে খুন হয়েছে ২১৯ জন ও স্বামীর স্বজনদের হাতে খুন হয়েছে ৪৮ জন, ২০১২ সালে স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ২০৮ জন ও স্বামীর স্বজনদের হাতে খুন হয়েছে ৪৫ জন, ২০১১ সালে স্বামীর হাতে খুন হয়েছে ২০৩ জন ও স্বামীর স্বজনদের হাতে খুন হয়েছে ৪৩ জন, ২০১০ সালে স্বামীর হাতে খুন হয়েছে ২২৫ জন ও স্বামীর স্বজনদের হাতে খুন হয়েছে ৪৭ জন এবং ২০০৯ সালে স্বামীর হাতে খুন হয়েছে ১৯৭ জন ও স্বামীর স্বজনদের হাতে খুন হয়েছে ২৬ জন নারী। হত্যাকান্ডের শিকার হওয়া এসব নারীর অধিকাংশ ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিটি পরিবারেরই ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা থাকে। আর অনেক কারণ একত্রিত হয়ে এ ধরনের পারিবারিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। তবে এর পেছনে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে হতাশা, পরকীয়া, আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমে যাওয়া, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি। এখন মানুষের মধ্যে সুস্থ বিনোদনের অভাব হওয়ায় তাদের আচরণেও ক্রমাগত পরিবর্তন ঘটছে। এতে তারা অন্যের কাছে নিজের আবেগ প্রকাশ করতে পারছে না। একই সঙ্গে প্রযুক্তির কারণে নর-নারীর মধ্যে এখন এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা কাজ করছে। আকাশ সংস্কৃতির কারণে অসুস্থ অনুষ্ঠান দেখে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। মানুষের আচরণ ক্রমেই সহিংস হয়ে পড়ছে। আর এ পরিস্থিতিতে অনেকেই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে আপন মানুষটিকে হত্যা করছে।’
বর্তমানে দেশে ৬৫ থেকে ৮৫ লাখ মানুষ অতিমাত্রায় বিষন্নতায় আক্রান্ত। আর এ কারণে সামাজিক অপরাধ আরো ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলে ষাটের দশকের তুলনায় বর্তমানে বিবাহবহির্ভূত ও বিবাহপূর্ব অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার পরিমাণ তিন গুণ। আর অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, পরকীয়া পারিবারিক হত্যাকান্ডের পেছনে অন্যতম একটি বড় কারণ। তাছাড়া আগের মতো বাংলাদেশে যৌথ পরিবার প্রথা নেই। মানুষ ক্রমেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে প্রযুক্তি ও বিত্ত-বৈভব মানুষের আবেগ এবং মূল্যবোধে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। এখন মানুষ যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ কারণে আপন মানুষটিকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করছে না।
ইউএনএফপিএর সহযোগিতায় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট ওমেন সার্ভে’ জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৮৭ ভাগ নারী কোনো না কোনোভাবে স্বামী ও স্বামীর স্বজনদের নির্যাতনের শিকার হয়। এদের ৬৫ ভাগ শারীরিক নির্যাতন, ৩৬ ভাগ যৌন নির্যাতন, ৮২ ভাগ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং ৫৩ ভাগ অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার। জরিপে অংশ নেওয়া ৭৭ ভাগ নারী বলেছে, বছরের পর বছর ধরে তারা একই ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। শারীরিক নির্যাতনের শিকার নারীদের ৪৫ ভাগ বলেছে, তারা স্বামী ও স্বামীর স্বজনদের চড়, ঘুষি, লাথি, চুল ধরে সজোরে আঘাতে আহত হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ২৬ ভাগকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে এবং একাধিকবার ধারালো অস্ত্র, লাঠি, শক্ত বস্তু দিয়ে শরীরে আঘাত করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার হয়ে সাত ভাগ নারী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। প্রায় ৫০ ভাগ নারী খুন হয় স্বামীর হাতে। আর ৬০ দশমিক ৫০ ভাগ পুরুষ স্ত্রীকে নির্যাতন করা বৈধ বলে মনে করে।
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে খুন বা নির্যাতনের বিরুদ্ধে মামলা না করার কারণে এ ধরনের অপরাধ কমছে না। বরং খুন ও নির্যাতনের মাত্রা এবং পরিধি উভয়েই বেড়ে চলেছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি জানান, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ সালে পাস হলেও ২০১১ সালের ১২ জুলাই ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে প্রথম একজন নারী মামলা দায়ের করেন। অথচ এ আইনটিই মূলত পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ আইন। স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে মামলা করা হলে হয়তো তা খুন পর্যন্ত গড়াবে না। এতে মমতা ও আসমার মতো অনেক অসহায়, নিরীহ নারীর জীবন রক্ষা হবে।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে রাজধানীসহ সব বিভাগীয় শহরে পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার ও উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ইউনিট এবং বড় সরকারি হাসপাতালগুলোতে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার চালু হয়েছে। সরকার নির্যাতিত দুস্থ নারীদের আইনি সহায়তাও দিচ্ছে। পাশাপাশি নির্যাতিত নারীর স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের কাউনসেলিংয়ের কথাও ভাবা হচ্ছে। সমাজে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। সরকারের এসব পদক্ষেপের সঙ্গে সবার সম্মিলিত সহযোগিতা প্রয়োজন। তাহলে আশা করা যায়, নারী খুন-নির্যাতনের মতো নৃশংসতা আমরা প্রতিরোধ করতে পারব।
পারিবারিক হত্যাকান্ডের ঘটনাগুলো সমাজে ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, গত দুই বছরে দেশে সামাজিক অপরাধের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এখনই যদি এ অবস্থা প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তবে সাত-আট বছরের মধ্যে তা মহামারী আকার ধারণ করবে। যা আমাদের কাম্য হতে পারে না। আমরা এর বিপরীতে দাঁড়াতে চাই। সরকার নিশ্চয়ই এ কাজে আমাদের সামনে থেকে মিছিলের নেতৃত্ব দেবে। এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
পিডিএসও/তাজ