মীর আবদুল আলীম

  ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

বড়লোকের পেটে লাথি মাইরেন না

‘বড়লোকদের ব্যবসা বলে কথা। করতে দেন ভাই, করতে দেন! বড়লোকের পেটে লাথি মাইরেন না।’ বিষয়টি হয়তো এমনই। চালবাজি বন্ধ হলে বড়লোকের পেটেই লাথি পড়বে। প্রশ্ন হলো, চালবাজি তো হচ্ছে অনেক দিন ধরে, বন্ধ হচ্ছে না কেন? চালবাজি করতে করতে চালে দুর্ভিক্ষ লাগিয়ে দেবে নাকি চালবাজরা? হঠাৎ করেই চালের সংকট—এটা একেবারেই অবিশ্বাস্য। সঠিকভাবে চালের গুদামগুলো পর্যবেক্ষণ, চালের বড় ব্যবসায়ীদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই থলের বিড়াল বের হয়ে যাবে। এমন মন্তব্য করেছেন অনেকেই। বাস্তবেই চালের বাজারে সীমাহীন অস্থিরতা চলছে। কোনোভাবেই যেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কয়েক দফা শুল্ক কমিয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কয়েক লাখ টন চাল আমদানি করা হলেও বাজারে তার বিন্দুমাত্র প্রভাব নেই। এতে প্রভাবশালী চাল ব্যবসায়ীরাই লাভবান হয়েছেন।

বিশ্ববাজারে কিন্তু চালের দাম বাড়েনি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চালের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। বিপুল পরিমাণ চাল সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আমদানি করা হয়েছে। আরো আমদানি করা হচ্ছে। দেশে চালের কোনো রকম সংকট নেই। তাহলে চালের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না কেন? অনেকটা রহস্যজনকভাবে চালের দাম বেড়েছে। ২৫ টাকার চাল লাফাতে লাফাতে কোথায় উঠেছে? চালের দাম কমানোর জন্য সরকার মরিয়া। এর অংশ হিসেবে চালের আমদানি শুল্ক ১৮ শতাংশ কমানোও হয়। ফলে প্রতিকেজি চালের আমদানি খরচ ছয় টাকা কমেছে। কিন্তু তাতেও চালের দাম না কমে উল্টো অনেক বেড়েছে।

বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে সস্তায় চাল বিক্রি করছে ভিয়েতনাম। প্রশ্ন হচ্ছে, চালের দাম এভাবে বাড়ছে কেন? এই দাম বাড়া কি স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক? সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, হাওরে বোরো ধানের আবাদ নষ্ট হয়েছে। এ কারণে চালের দাম বেড়েছে। সরকারের তরফ থেকে চালের দাম বাড়ার খবরকে অস্বীকার করা হয়নি। তবে আমরা মনে করি, যথেষ্ট পরিমাণ চাল মজুদ থাকলে হাওরের দুর্যোগের প্রভাব মোকাবিলা করা সরকারের পক্ষে কঠিন হতো না। চালের পর্যাপ্ত মজুদ না থাকার জন্য বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়কে। অনেকে মনে করছেন, খাদ্যমন্ত্রী তার দায়িত্ব পালনে যে ব্যর্থতা দেখিয়েছেন তাতে তার পদত্যাগ করা উচিত। দেশে ভোক্তাস্বার্থ বলে কিছু নেই। যদি থাকত তাহলে চালের বাজারে এমন অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হতো না। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের এমনিতেই কোনো ছলের অভাব হয় না। চালের ক্ষেত্রেও নানা কারণ তারা সামনে এনেছে।

এবার চালের দাম অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বাজারে মোটা চালই এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজিতে। সরু চালের কেজি ৬০ টাকা ছাড়িয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে মোটা চালের দাম রেকর্ড ভাঙায় নিম্ন আয়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মোটা চালের দাম কেজি ৪০ টাকা এবং সরু চাল ৫৬ টাকায় উঠেছিল।

এ দেশে চালের দাম বাড়ে, ডালের দাম বাড়ে, বেগুন, তেল, লবণ, চিনির দাম বাড়ে। কারণে বাড়ে, অকারণে বাড়ে। এখন চালের দাম বেড়ে তো আকাশ ছুঁয়েছে। টিসিবির তথ্যমতে, গত এক বছরে দেশের বাজারে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৪২.১৯ শতাংশ। মোটা চালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সরু চালের দামও। চালের বাজার বলতে গেলে বেসামাল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে মোটা চালের দাম বেশি বেড়েছে। সরু চালের দাম বাড়লে উচ্চবিত্তের তেমন সমস্যা হয় না, যত আপদ বিত্তহীনদের ওপর। এভাবে কেন বাড়ল চালের দাম? এর অনেক ব্যাখ্যা আছে। যে যার মতো করে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। চাহিদা অনুপাতে চালের জোগান যে কম সে কথা বলা যাচ্ছে না। বাজারে চাল আছে। কেউ কেউ মনে করছেন, চালের স্বাভাবিক দাম বাড়ার পেছনে কারসাজি রয়েছে। চাল সিন্ডেকেট চক্রের হাতেই চালের মজুদ রয়েছে। এরাই অব্যাহতভাবে চালের দাম বাড়িয়ে চলেছে। এদিকে দেশে চালের দাম অব্যাহত বৃদ্ধির কারণ স্পষ্ট করতে পারেননি খাদ্যমন্ত্রী। তবে চাল মিল মালিক সমিতির দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, মিলারদের চালের মজুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় দফায় দফায় বাড়ছে চালের মূল্য।

হাওর অঞ্চলের দুর্যোগকেও চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। অথচ চালের বাজারে এর প্রভাব পড়ার কোনোই কারণ নেই বলেই মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। বাজারে নতুন ধানও এসেছে। এ সময় চালের দাম নেমে আসে। এরপরও দাম কেন বাড়ছে?

সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, হাওরে বোরো ধানের আবাদ নষ্ট হয়েছে। এ কারণে চালের দাম বেড়েছে। সরকারের তরফ থেকে চালের দাম বাড়ার খবরকে অস্বীকার করা হয়নি। তবে আমরা মনে করি, যথেষ্ট পরিমাণ চাল মজুদ থাকলে হাওরের দুর্যোগের প্রভাব মোকাবিলা করা সরকারের পক্ষে কঠিন হতো না। সরকার আশা করেছিল, বাজারে বোরো ধান এলে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কিন্তু নতুন চালেও সরকারের আশা পূরণ হয়নি। এখন সরকার আশা করছে চাল আমদানি করা হলে এর দাম কমবে। এক্ষেত্রেও মিলেছে হতাশার খবর। আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বাড়ছে। সরকার চাল আমদানি করতে করতে এর দাম আরো বাড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। আমরা মনে করি, সর্ব প্রথম সিন্ডিকেটওয়ালাদের চালবাজি বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চালের দাম বাড়ার বিষয়ে সরকারের কঠোর নজরদারি থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্টদের নজরদারি কম বলেই মনে হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) ২০১৫ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড়ে খাদ্যশক্তির (ক্যালরি) ৬৫ শতাংশ আসে চাল বা ভাত থেকে। আর প্রতিদিন তারা খাবারের পেছনে যে অর্থ ব্যয় করে, তার ২৭ শতাংশ যায় চাল কিনতে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, দাম বাড়লে গরিব মানুষ ভাত খাওয়া কমিয়ে দিতে হয়। ইফপ্রির জরিপে এর আগে ২০১৬ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে প্রতি কেজি চালের দাম ৩৮ টাকায় উঠেছিল। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রতি কেজি চাল ছিল ৩৬ টাকা। এরপর ২০০৯ সালে ধানের বাম্পার ফলনের পর দেশে চালের দাম কমতে থাকে। ২০১২ সালে প্রতি কেজি চাল ২৬ টাকায় নেমে আসে। ২০১৪ সালের পর চালের দাম আবারও বাড়তে থাকে। ২০১৪ সালে ৩০ এবং ২০১৫ সালে ৩৩ টাকায় ওঠে চালের দাম। ২০১৬ সালে মোটা চাল ৩৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এভাবে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি ভালো লক্ষণ নয়।

পত্রিকার খবরে জানা যায়, আমাদের দেশেই নাকি চালের দাম সবচেয়ে বেশি। চালের মূল্য বেশি থাকা দেশগুলোর মধ্যে আমাদের পরের স্থানই নাকি দখল করে আছে পাকিস্তান, যা বাংলাদেশের চেয়ে ১০ টাকা কম। বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে সস্তায় চাল বিক্রি করছে ভিয়েতনাম। সেখানে চালের দাম গড়ে প্রতি কেজি ৩৩ টাকা ৬২ পয়সা। প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতি কেজি চালের দাম ৩৪ টাকা ৪৩ পয়সা, থাইল্যান্ডে ৩৭ টাকা ৮১ পয়সা ও পাকিস্তানে ৩৮ টাকা ৫৪ পয়সা। সরকারি হিসাবেই দেশে প্রতি কেজি চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮ টাকায়।

আমরা মনে করি, বিত্তহীনদের ব্যাপারে সরকারকে আরো মনোযোগী হতে হবে। বাজারে কীভাবে চালের দাম কমিয়ে আনা যায় সেদিকেই সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নজর দিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন অতি মুনাফাখোর লোভী ব্যবসায়ী ও মিল মালিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। মনে রাখতে হবে, এ দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। ভাতনির্ভর দেশের মানুষ যদি চাহিদা মতো চাল কিনতে না পারে, তবে এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে?

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নিবন্ধ,চাল
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist