রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

বাড়ছে মানুষ কমছে জমি

জাতিসংঘের তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষের জন্য চাষযোগ্য জমি রয়েছে মাত্র ৮০ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। এর এক-চতুর্থাংশই এখন হুমকির মুখে। তাছাড়া বাণিজ্যিক কারণে দেশে প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার ৯৬ বিঘা বা ৬৯২ একর কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে। রূপান্তরিত জমির পুরোটাই অকৃষি খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। জলাশয় ভরাটের ফলে প্রতিদিন মোট কৃষিজমি কমছে ৯৬ বিঘা। তামাক চাষের কারণে প্রতিদিন ৯ হাজার একর কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। এভাবে কৃষিজমি কমতে থাকলে দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা চরম হুমকির সম্মুখীন হবে। উল্লেখ্য, যেখানে বছরে দু’বার ফসল উৎপাদন হতো, বর্ষায় জমত থই থই পানি, সেখানে প্রাকৃতিকভাবে মাছ উৎপাদন হতো। এলাকার সাধারণ মানুষ এমন প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ সংগ্রহ করত। যা ছিল তাদের জীবিকার উৎসও। অথচ চোখের সামনে প্রায় ৫০ একর কৃষিজমির ধরন রাতারাতি বদলে যাচ্ছে।

ময়মনসিংহের ত্রিশালে মহাসড়কসংলগ্ন হামিদ অ্যাগ্রো লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান পুরো জমি কিনে নিয়েছে। সেখানে ঝুলছে শত শত সাইনবোর্ড। জমিতে ইতোমধ্যে ভবন নির্মাণ শুরু করা হয়েছে। দেওয়া হচ্ছে দেয়াল। অল্প দিনের মধ্যেই এক সময়ের কৃষিজমির কোনো স্মৃতি চিহ্নই হয়ত এখানে আর থাকবে না! কৃষিজমি সুরক্ষা আইন না থাকায় এভাবেই বেহাত হচ্ছে ভূমি। সারা দেশের চিত্র ঠিক এমনই। ইচ্ছেমতো জমির ব্যবহার বাড়ছে। চিহ্নিত করা যাচ্ছে না কৃষি ও শিল্পের জমি। রাতারাতি খাল, বিল, ডোবা-নালা ভরাট হচ্ছে। অথচ ছয় বছর ঝুলে আছে কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন। যদিও ভূমিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই আইনটি দ্রুত পাস হবে এমন আশার কথাই বলছেন। ২০১৭ সাল নাগাদ ভূমি জোনিংয়ের লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কৃষিজমি চিহ্নিত করার কথা বলেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমি রক্ষায় রাষ্ট্রের সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা না থাকায় অপরিকল্পিতভাবে চলছে জমির ব্যবহার। যেখানে সেখানে হচ্ছে বাড়ি। নির্মাণ করা হচ্ছে শিল্প-প্রতিষ্ঠান, রাস্তা, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, দোকানসহ বিভিন্ন রকমের স্থাপনা। হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ।

তাছাড়া গ্রামের কৃষিজমি দ্রুত অকৃষি খাতে যাচ্ছে। সংরক্ষিত ভূমি বলতে কিছু নেই। তবে জলাধার, বন রক্ষায় আইন ও নীতিমালা থাকলেও সরকারের মনিটরিংয়ের অভাবে এর তোয়াক্কা করছেন না কেউ। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন জমি কমার মূল কারণ। দ্রুত ভূমি রক্ষায় সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ না করলে সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ নানা কারণেই ফসলি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। বাড়তি মানুষের আবাসস্থল নির্মাণ এবং তাদের বেচে থাকার তাগিদে গড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই ফসলি জমিতে টান ফেলেছে। এক সময় যেসব এলাকায় ধান আর ধান দেখা যেত, দেখা যেত বিভিন্ন ফসলের বাহার, এখন দেখা যায় প্রচুর নতুন নতুন বাড়িঘর আর বৃক্ষরাজির প্রাচুর্য। অর্থাৎ বাড়তি আয়ের জন্য ফসলি জমিতে গড়ে তোলা হয়ছে গাছের বাগান।

বিভিন্ন সংবাদে যথার্থই বলা বলা হয়েছে, গ্রাম-বাংলার ফসলি জমিতে গড়ে উঠছে বসতবাড়ি। ধান আর তেমন দেখা যায় না। হারিয়ে যাচ্ছে ধান চাষের আবাদি জমি। বসতবাড়ি ছাড়াও চাষের জমিতে বেশি আয়ের আশায় রোপণ করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। সংবাদে এও বলা হয়েছে, দক্ষিণাঞ্চলের আবাদি জমিতে মাছের চাষ করা হচ্ছে। হাজার হাজার হেক্টর জমি জুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে মাছের ঘের। আর ওই ঘেরকে কেন্দ্র করে পড়ে আছে ব্যাপক অনাবাদি জমি। চাষিদের অনেকেরই ধারণা, এখন ধান চাষের তুলনায় মাছের ঘের করা এবং গাছপালা রোপণে আয় বেশি। অপরদিকে জমি চাষের হাড়ভাঙা খাটুনিও অনেক কম। তুলনামূলকভাবে খরচও কম। এমনিভাবেই কমছে আবাদি জমির পরিমাণ। এক সময় কাঁচা রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে মাইলের পর মাইল যে ফসলি জমি দেখা যেত, এখন আর তা দেখা যায় না। এখন রাস্তার প্রশস্ততা বৃদ্ধি পাওয়া ও পাকা হওয়ার পর দু’পাশে যেমন গাছের প্রাচুর্য তেমনি দেখা যায় বাড়ি আর বাড়ি। আর ওই বাড়িকে কেন্দ্র করেও দ্বিগুণ, তিনগুণ জমি ব্যবহৃত হচ্ছে বাগান গড়ার জন্য। পরিবেশের জন্য ওই রাস্তার দু’পাশের গাছ আর বাড়ির আঙ্গিনার বাগান অতীব জরুরি হলেও হারিয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি।

এক বিশ্লেষণে বিষয়টি নিয়ে আরো একটি তথ্য উঠে আসছে সন্তর্পণে। মানুষ যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়িঘরও বাড়ছে, বাড়ছে কলকারখানা বা অন্যান্য অনুষঙ্গও। কিন্তু সেই বাড়তি মানুষের খাদ্য আসবে কোথা থেকে? জমি তো কমছে। ভাগ্যিস বর্তমান সরকারের কৃষির ওপর অধিক নজরদারির কারণেই কম জমিতেও অধিক ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে। আর এ সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়। বাড়তি মানুষের জন্য বাড়তি ফসল উৎপাদনের ফলেই দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অথচ সেই স্বয়ংসম্পূর্ণতার অংশীদার হতে পারছে না পুরনো প্রবাদের সেই শস্য ভান্ডার। যদিও মাপের হিসাবে বিভিন্ন বিভাগে জমি বাড়ছে নদীগুলো ছোট হয়ে যাওয়ার কারণে। ফলে সেই পুরনো প্রবাদের নদী-খাল যেমন নেই, তেমনি আর ধানও নেই জমির অপব্যবহার হওয়ায়। আমরা চাই জমির প্রয়োজনীয় ব্যবহার, অপব্যবহার নয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নতুন নতুন বাড়িঘর নির্মাণের কারণে হু হু করে কমছে কৃষিজমি। প্রতিবছর এক শতাংশের ওপর কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে। এর পরিণাম এক সময় ভয়াবহ অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াবে। এ পরিস্থিতিতে দ্রুত কৃষিভূমি রক্ষায় সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ না করা হলে সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। অথচ ছয় বছর ধরে ঝুলে আছে কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন।

ভূমি ও কৃষিজমি রক্ষায় রাষ্ট্রের সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা নেই। যদিও দেশে জলাধার, বন রক্ষায় আইন ও নীতিমালা রয়েছে, কিন্তু সরকারের মনিটরিংয়ের অভাবে কেউ তার তোয়াক্কা করছে না। অথচ বাংলাদেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষের জন্য চাষযোগ্য জমি রয়েছে মাত্র ৮০ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। এখন ওই জমির এক-চতুর্থাংশই হুমকির মুখে। বাণিজ্যিক কারণে দেশে প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার ৯৬ বিঘা বা ৬৯২ একর কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া ৮০ শতাংশ সরকারি খাস জমিতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। নির্মাণকাজের কারণে বছরে বিলীন হচ্ছে তিন হাজার হেক্টর জমি। গত ৩৭ বছরে শুধু ঘরবাড়ি নির্মাণ হয়েছে প্রায় ৬৫ হাজার একর জমিতে। আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকায় প্রতিনিয়তই কমছে কৃষিজমি। চোখের সামনেই এই সর্বনাশা প্রবণতা ঘটে চললেও কেউ কিছু বলছে না। সরকারিভাবে ২০১০ সালে কৃষিজমি সংরক্ষণে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও খসড়াতেই তা এখনো আটকে আছে।

অন্যদিকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ থাকলেও জনবল সঙ্কট ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দুর্গম এলাকা হওয়ায় দশমিনায় তা আলোর মুখ দেখছে না। উপজেলার অনুন্নত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দুর্গম এলাকায় বিশাল জনগোষ্ঠী বসবাস করে, যেখানে পৌঁছায় না জন্মনিয়ন্ত্রণের স্লোগান। আজও অজপাড়াগাঁয়ে বসতিদের মধ্যে ধর্মান্ধ ও কুসংস্কার আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। উপজেলার চর বোরহান, চর শাহজালাল ও চর হাদি তিনটি চর এলাকা সরেজমিনে ঘুরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অস্বাভাবিক চিত্র পাওয়া গেছে। মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এসব চরে প্রায় ১০ হাজার ৫শ’ লোকের বসতি, অপরদিকে প্রতি পরিবারে গড় লোকসংখ্যা সাতজন। অধিক সন্তান, অধিক উপার্জনে বিশ্বাসী চরবাসীরা জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী ব্যবহার করতে নারাজ। সরকারি-বেসরকারি জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী বিতরণ কার্যক্রম একেবারেই অনুপস্থিত। কোনো প্রকার হাট-বাজার কিংবা দোকান না থাকায়, সম্পূর্ণ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত তারা। ২০০৮ সালের জরিপে বসবাসকারী বাড়ির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ২৩০টি। মাত্র ৭ বছরের ব্যবধানে বসবাসকারী নতুন বাড়ি হয়েছে ৫ হাজার ৪২৯টি, যা জনসংখ্যার বিস্ফোরণ, উন্নত ভূমির ব্যবহার আর গ্রামীণ অর্থনীতির খন্ডায়নের চিত্র তুলে ধরে। কৃষিনির্ভর এই উপজেলায় ফসলি জমি হারানো ও জমির আংশিক মালিকানা বৃদ্ধির জন্য বড় কৃষক থেকে সৃষ্টি হচ্ছে মাঝারি কৃষকের, মাঝারি থেকে প্রান্তিক। প্রান্তিক কৃষক পরিবারে অংশীদারিত্বের কারণে ভিক্ষাবৃত্তিও চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। এজন্য উপজেলার বিপন্ন গ্রামীণ অর্থনীতি রক্ষায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ জোরদারের পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজন বোধ করছেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। আর এজন্যই অনেকে বলেন, ‘বাড়ছে মানুষ, কমছে জমি।’ এটিই এখন বাংলাদেশের জন্য একটি অশনিসংকেত।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বাড়ছে মানুষ,কৃষিজমি,জমি কমছে,আবাদি জমি,চাষযোগ্য জমি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist