শুভাশিস ব্যানার্জি

  ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

মতামত

সাইবার ক্রাইম মোকাবিলায়...

বিশ্বায়নের যুগে থেমে নেই বাংলাদেশ। সোস্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে ফেসবুক, টুইটার এবং মাইস্পেসে হাজার হাজার বন্ধু। প্রযুক্তির ক্রমবিকাশের ধারায় কেউ ইন্টারনেটকে নিয়েছে পেশা হিসেবে, কেউ নিয়েছে শখ হিসেবে। আবার কেউ নিয়েছে মানুষের জীবনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে। দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে সাইবার অপরাধীরা।

ইন্টারনেটের মাধ্যমে কম্পিউটারভিত্তিক অপরাধগুলোকে বলা হয় সাইবার ক্রাইম। বর্তমানে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা সারা দিন বসে বসে চ্যাট করে ইন্টারনেটে পরিচয় হওয়া বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে হয় মোবাইলের মাধ্যমে, নয়তো কম্পিউটারের মাধ্যমে। এভাবে কয়েক বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন সাইটে সাইবার ক্রাইম ছড়িয়ে পড়ছে ব্যাপকহারে। এসব প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। মানসম্মানের ভয়ে অনেকে এ অপরাধের শিকার হয়েও থানা-পুলিশ কিংবা অন্য কোনো সংস্থার কাছে অভিযোগ করছে না। দেশে প্রচলিত সাইবার ক্রাইমের মধ্যে রয়েছে প্রতারণা, ক্রেডিট কার্ডের নম্বর চুরি, ব্ল্যাকমেইল,পর্নোগ্রাফি, হ্যারাসমেন্ট প্রভৃতি।

বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম মোকাবিলা করার জন্য কতটা প্রস্তুত তা আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। তবে আশার কথা হলো, সম্প্রতি সাইবার ক্রাইম ঠেকাতে মাঠে নেমেছে বিটিআরসি। সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে একটি বিশেষ টিম গঠন করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। বাংলাদেশ কম্পিউটার সিকিউরিটি ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম (সিএসআইআরটি) নামে একটি দল ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে সাইবার ক্রাইম শনাক্তকরণ কাজ শুরু করেছে বলে বিটিআরসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। সিএসআইআরটি কাজ শুরু করায় সাইবার ক্রাইমের বিষয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি চলবে। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ায়Ñ ওয়েবসাইটগুলোতে এমন বিষয় শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া এই দলের মূল কাজ।

দেশে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারকারী বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে পর্নোগ্রাফি। বর্তমানে পর্নোগ্রাফির করাল থাবা ছড়িয়ে পড়ছে ইন্টারনেটে, ব্লুটুথ-পেনড্রাইভ হয়ে কম্পিউটার থেকে সেলফোনে। দেশে পর্নোগ্রাফির বাজার ধরতে একশ্রেণির পেশাজীবী সাইবার অপরাধী যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় সাধারণরাও জড়িয়ে পড়ছে পর্নোগ্রাফিতে। সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সাইবার ক্রাইম সংঘটিত হয় পর্নোসাইট বা পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসি দেশি অশ্লীল ও পর্নোগ্রাফির ৮৪টি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিলেও বাংলাদেশে এসব সম্পর্কিত ওয়েবসাইটের ব্যবহার কমেনি।

সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত কোনো অপরাধে সরাসরি থানায় মামলা করারই বিধান নেই। নতুন গঠিত সিএসআইআরটি আদালতে মামলা করার পর আদালত নির্দেশ দিলে পুলিশ তা তদন্ত করবে। অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করবে দলটি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপরাধীকে দুই থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সাজা এবং পাঁচ লাখ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হতে পারে। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৬৯ ধারা অনুযায়ী এই শাস্তি দেওয়া হতে পারে। সাইবার অপরাধ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নেট ক্রাফট ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন এবং ফেডারেল কমিউনিকেশন পরিচালিত গবেষণা থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশে সাইবার অপরাধীরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে প্রতারণামূলক ওয়েবসাইট তৈরি ও নারীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ছবি অরুচিকরভাবে প্রকাশ করছে। তা ছাড়া বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট হ্যাক হয়েছে। র‌্যাবের ওয়েবসাইট ও ডিজিটাল বাংলাদেশের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট হ্যাক করার ঘটনাটি বেশ আলোড়ন তুলেছিল। এসব ঘটনায় স্পষ্ট, আমরা সাইবার অপরাধ দমনে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিতে পারিনি।

ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহারে সতর্কতার অভাবে বাড়ছে সাইবার ক্রাইম। এতে প্রতারণা ও সম্মানহানির শিকার হচ্ছে কেউ কেউ। এমনকি আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে অনেকে। সারাদেশে একটি মাত্র সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল থাকলেও তার নির্দিষ্ট এজলাস না থাকায় বিচারপ্রার্থীরা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন বলে জানান পিপি। এছাড়া প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবে এ ধরনের অপরাধ দমনে সরাসরি কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না পুলিশ। যদিও ডিএমপি পুলিশ কমিশনার বলেছেন, ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নগ্ন ছবি ছেড়ে দিয়ে হুমকি প্রদানের ঘটনাগুলো সীমাহীনভাবে ঘটছে। এসব ব্যাপারে পুলিশ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে।

দেশে অব্যাহত সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধের লক্ষ্যে ৮৫ জন সরকারি কর্মকর্তা দেশের বাইরে থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করেছেন। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর এবং ভারতের ইএসআই ট্রেনিং ইনস্টিটিউট তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এ তালিকায় যুক্ত হবেন সব মিলে ২৫০০ সরকারি কর্মকর্তা। আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রও এ ব্যাপারে সহযোগিতা করবে। এ জন্য আর্থিক সহযোগিতা করবে বিশ্বব্যাংক। এলআইসিটি প্রকল্পের অধীনে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা, বিসিসির ডাটা সেন্টারের সম্প্রসারণ, ই-গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠা, সাইবার নিরাপত্তা প্রশিক্ষণসহ বেশ কিছু উদ্যোগ বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক ৫৬০ কোটি টাকা ঋণ-সহায়তা দিচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় সরকার প্রশিক্ষণ ছাড়াও দেশে একটি ন্যাশনাল এন্টারপ্রাইজ ফর আর্কিটেকচার (এনইএ) গড়ে তুলতে চাইছে। এখনই এর লক্ষ্য হচ্ছে, সরকারের এক প্রতিষ্ঠানের তথ্য ও ডাটা যাতে অন্য প্রতিষ্ঠানও শেয়ার করে কাজে লাগাতে পারে সে ব্যবস্থা করা। এ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলা হয়েছে, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দফতর, অধিদফতর ও বিভাগ আলাদাভাবে সফটওয়্যার এবং আইটি সিস্টেম গড়ে তুলেছে। এতে এক প্রতিষ্ঠানের তথ্য ও ডাটা প্রযুক্তি অন্য প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করতে পারে না। তদুপরি ঘটে যায় ডুপ্লিকেশন। এতে করে অযথা শ্রম ও সময়েরও অপচয় ঘটে। অর্থের সাশ্রয়সহ সব মিলিয়ে সরকার তথ্য ও ডাটা ব্যবহারের নিমিত্তে একটি অভিন্ন প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এটা বাস্তবায়ন সম্ভব হলে কাজের গতি বাড়ার পাশাপাশি জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষার আলোকে সরকার এলআইসিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিয়েছে। জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও তরুণদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সহায়ক এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ৭০ মিলিয়ন বা ৭ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।

বাংলাদেশে ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি এলআইসিটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। এ লক্ষ্যে গত বছরের শেষ দিকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ংকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ বছরের জানুয়ারি থেকে তারা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ শতাংশই তরুণ। এমনই চিন্তা থেকে সরকার অন্যান্য খাতের মতো আইটি খাতেও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। এ খাতের বিকাশে মানবসম্পদ তৈরির নানা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এসবের মধ্যে একটি হচ্ছে লিভারেজিং আইসিটি ফর গ্রোথ, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এলআইসিটি) প্রকল্প। প্রকল্পটি গ্রহণে বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সরকার।

এ ব্যাপারে তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব জানান, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সরকার অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রম গ্রামবাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত করেছে। এমনকি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার থেকে মানুষ বিভিন্ন তথ্য ও সেবা পাচ্ছে। তিনি বলেন, অনলাইন কার্যক্রমে ঝুঁকিও রয়েছে। সে-কারণে সাইবার অপরাধ ও আক্রমণ এড়াতে অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্ন ও নিরাপদ রাখতে আড়াই হাজার সরকারি কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সাইবার ক্রাইম মোকাবিলা। প্রযুক্তি যত দ্রুত এগোচ্ছে, প্রযুক্তিনির্ভর সন্ত্রাসীরা তার চেয়ে বেশি গতিতে এগোচ্ছে। তাই এখনই তাদের রুখতে না পারলে পরবর্তীতে তা আরো কঠিন হয়ে পড়বে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সাইবার ক্রাইম,সোস্যাল নেটওয়ার্ক,ফেসবুক,টুইটার,ইন্টারনেট
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist