মাহমুদ আহমদ

  ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

নিবন্ধ

বিদায় হজ ও রোহিঙ্গা শিশুদের কান্না

জীবনের হিসাবনিকাশ বুঝে ওঠার আগেই না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছে অনেক নিষ্পাপ শিশু। রোহিঙ্গা অবুঝ শিশুদের নিথর দেহ উপকূলের বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকার দৃশ্য বিবেকবান মানুষের পক্ষে সহ্য করা কঠিন। শিশুদের মৃতদেহ নিশ্চয় সারা বিশ্বকে কাঁদিয়েছে, তারপরও বিশ্ব বিবেকের টনক নড়ছে না। সর্বত্রই যেন অশান্তি আর বিশৃঙ্খলা বিরাজমান। রোহিঙ্গ শিবিরে গেলেই চোখে পড়ে নিষ্পাপ অবুঝ শিশুদের কান্না। রোহিঙ্গা শিশুরা কাঁদছে, মানবতা আজ ডুকরে কাঁদে, দেখার যেন কেউ নেই। ফুটফুটে ছোট্ট শিশুদের নিষ্পাপ মৃত দেহগুলো এখানে সেখানে পড়ে থাকতে দেখে যে কারো হৃদয়ে দাগ ঠিকই কেটেছে, কিন্তু কাটে না শুধু বিশ্ব বিবেকের। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর আক্রমণে এমনই হাজারো নিষ্পাপ শিশুর জীবন অকালেই ঝরে যাচ্ছে কেবল রাজনৈতিক কারণে। মানবতা বলতে যেন আজ কিছুই অবশিষ্ট নেই। অথচ আমাদের প্রিয় নবী (সা.) মানবতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি বিদায় হজের ভাষণেও সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ আজ তারই উম্মত হয়ে আমরা মানবতাবিরোধী যত সব অপরাধ করে যাচ্ছি।

হিজরি নবম বর্ষে মহানবী (সা.) হজ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় এলেন। মুজদালেফা থেকে ফেরার পর হজের রীতি অনুযায়ী তিনি মিনাতে থামেন এবং ১১ জিলহজ তারিখে তিনি (সা.) সমবেত সমস্ত মুসলমানদের সামনে দাঁড়িয়ে এক ভাষণ দান করেন। এই ভাষণে তিনি (সা.) বলেন, ‘হে লোক সকল! আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন। কেননা, আমি জানি না যে, এই বৎসরের পর আর কখনও আমি এই ময়দানে তোমাদের সাথে দাঁড়িয়ে আর কোনো বক্তৃতা দিতে পারব কি না।

‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের জীবন ও তোমাদের সম্পদ একে অপরের হামলা থেকে কেয়ামত পর্যন্ত পবিত্র ও নিরাপদ করে দিয়েছেন। ‘আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক ব্যক্তির উত্তরাধিকারের অংশ নির্ধারিত করে দিয়েছেন। এ ধরনের কোনো ওসিয়্যত বৈধ হবে না, যা কোনো বৈধ উত্তরাধিকারীর ক্ষতির কারণ হয়। যার ঘরে যে সন্তান পয়দা হবে, সে তারই সন্তান হবে এবং কেউ যদি এই সন্তানের পিতৃত্বের ওপর দাবি উত্থাপন করে, তাহলে সে শরীয়ত মোতাবেক প্রাপ্য শাস্তি ভোগ করবে।

‘যে ব্যক্তি অন্য কাউকে নিজের পিতা বলে দাবি করবে, কিংবা কাউকে নিজের মালিক বলে মিথ্যা দাবি করবে, তার ওপর খোদার এবং ফেরেশতাদের এবং সকল মানুষের অভিশাপ বর্ষিত হবে।

‘হে লোক সকল! তোমাদের হাতে এখনও কিছু যুদ্ধবন্দি রয়ে গেছে। আমি তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি যে, তোমরা তাদেরকে তা-ই খাওয়াবেÑযা তোমরা নিজেরা খাও। এবং তাদেরকে তা-ই পরতে দেবে, যা তোমরা নিজেরা পর। যদি তারা এমন কোনো অপরাধ করে ফেলে, যা তোমরা ক্ষমা করতে পার না, তাহলে তাদেরকে অন্যের কাছে দিয়ে দেবে। কেননা, তারা খোদারই বান্দা। তাই, কোনো অবস্থাতেই তাদেরকে কোনোরূপ কষ্ট দেওয়া বৈধ হবে না।

‘হে লোক সকল! আমি তোমাদের যা বলছি, তা শোন এবং ভালোভাবে মনে রেখ। প্রত্যেক মুসলমান প্রত্যেক মুসলমানের ভাই। তোমরা সবাই সমান। সব মানুষ, তা তারা যে কোনো জাতিরই হোক আর যে ধর্মেরই হোক, মানুষ হওয়ার কারণে, পরস্পর সমান। (এই কথা বলার সময় তিনি (সা.) তার উভয় হাত উপরে তুললেন এবং এক হাতের আঙ্গুলগুলোকে অপর হাতের আঙ্গুলগুলোর সঙ্গে মিলালেন এবং বললেন) যেভাবে দুই হাতের আঙ্গুলগুলো পরস্পর সমান, সেভাবেই সকল মানুষ পরস্পর সমান। ‘তোমাদের কোনো অধিকার নেই যে, তোমরা একে অন্যের ওপর কোনো শ্রেষ্ঠত্বের দাবি কর। তোমরা পরস্পর ভাই।’ ‘তোমরা কি জান, এখন কোন মাস? এই এলাকা কোন এলাকা? তোমাদের কি জানা আছে, আজকের দিন কোন্ দিন?’

লোকেরা উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, এই মাস পবিত্র মাস। এই এলাকা পবিত্র এলাকা। আজকের দিন হজের দিন।’ তাদের সকলেরই উত্তর শুনে রাসুলুল্লাহ্ (সা.) বলতে থাকলেন,

‘যেভাবে এই মাস পবিত্র মাস, যেভাবে এই এলাকা পবিত্র এলাকা, যেভাবে এই দিন পবিত্র দিন, তেমনিভাবে আল্লাহতায়ালা প্রতিটি মানুষের জান, মাল ও সম্মান পবিত্র করে দিয়েছেন। এবং কারো জানের ওপরে কিংবা মাল ও সম্মানের ওপর হামলা করা ঠিক তেমনি অবৈধ যেমন অবৈধ এই মাসের এই এলাকায় এই দিনের অমর্যাদা করা। এই হুকুম শুধু আজকের জন্যই নয়, শুধু কালকের জন্যই নয়, বরং সেই দিন পর্যন্ত প্রত্যেক দিনের জন্য যেদিন তোমরা খোদার সঙ্গে গিয়ে মিলিত হবে।’

তিনি (সা.) আরও বললেন, ‘এই সমস্ত কথা যা আমি আজ তোমাদেরকে বলছি তা তোমরা পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছে দিও। কেননা, এমনও হতে পারে যে, যারা আজ আমার কথা আমার কাছ থেকে শুনছে, তাদের চাইতে যারা আমার কাছ থেকে আমার এই কথা শুনছে না, তারা এই সকল কথার ওপরে বেশি আমল করবে, বেশি বেশি পালন করবে।’

এই সংক্ষিপ্ত ভাষণ বলে দিচ্ছে যে, মানুষের মঙ্গল এবং তাদের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য রাসূল করিম (সা.) কত বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন। এবং নারী জাতি ও দুর্বলের অধিকার রক্ষার প্রতি কত বেশি আন্তরিক ছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) জানতেন যে, তার ইহজীবনের দিন শেষ হয়ে আসছে। হয়তো বা আল্লাহতায়ালা তাকে জানিয়েছিলেন যে, তার জীবনের সময় প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তাই তিনি চাননি, যে নারীদের মানব জন্মের আদি থেকেই পুরুষদের দাসী বানিয়ে রাখা হয়েছে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আদেশ-নির্দেশ দেওয়ার পূর্বেই তিনি জগৎ ছেড়ে চলে যান। তিনি চেয়েছিলেন, ওই সব যুদ্ধবন্দি যাদের মানুষেরা ক্রীতদাস বলে আখ্যায়িত করে এবং যাদের ওপর নানা প্রকার অত্যাচার চালাতে থাকে, তাদের অধিকার সুরক্ষিত করার পরই তিনি যেন দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। তিনি চাননি, মানুষে মানুষে যে প্রকাশ্য প্রার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছে, কাউকে পাতালে নিক্ষেপ করা হয়েছে, তা ঘুচিয়ে দেওয়ার আগে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তিনি চাননি, যেসব কারণে জাতিতে জাতিতে দেশে দেশে মতবিরোধ দেখা দেয় এবং যুদ্ধ বিগ্রহের সৃষ্টি হয়, তা সব সাকল্যে দূরীভূত করার আগে তিনি এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। একে অপরের হক আত্মসাৎ করা বা অধিকার খর্ব করা সব সময়েই বর্বর যুগের এক অভিশাপ বলে গণ্য করা হয়, তার অশুভ বাসনাকে যতক্ষণ না হত্যা করা হয়, ততক্ষণ তিনি পৃথিবী ছেড়ে যেতে চাননি। যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষের জান ও মালকে সেই পবিত্রতা সেই নিরাপত্তা দান না করা হয়, যা খোদা তায়ালার পবিত্র মাসগুলোকে খোদা তায়ালার পবিত্র ও কল্যাণমন্ডিত স্থানসমূহকে দান করা হয়েছে, ততক্ষণ তিনি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চাননি।

সব জাতির জন্য নিরাপত্তা ও শান্তি স্থাপনকরণ, মানবজাতির মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠাকরণ ইত্যাদির জন্য এত বেশি গভীর উদ্বেগ ও আন্তরিকতা পৃথিবীর আর কোনো মানুষের মাঝে কেউ কি কখনো দেখেছে? হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত মানবজাতির জন্য এত ভালোবাসা, এত আকুলতা, এত সঙ্কল্প আর কোনো মানুষের মধ্যে কি কখনো দেখা গেছে? স্বাধীনতা ও সাম্যের শিক্ষা ও আদর্শ কেবল ইসলাম, হ্যাঁ, কেবল ইসলামই কায়েম করেছে পৃথিবীতে। আজ যদি মহানবী (সা.)-এর এই ভাষণের ওপর আমল করা হয় তাহলে হয়তো আর কখনই কোনো দেশে আয়লানের মতো নিষ্পাপ শিশুর লাশ পড়ে থাকতে দেখা যাবে না-এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।

লেখক : ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বিদায় হজ,রোহিঙ্গা শিমু,রোহিঙ্গা,রোহিঙ্গা ইস্যু
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist